গল্প - সুমনা দত্ত (ঘোষ)

 

রি-ইউনিয়ন


মা, সেই কখন থেকে ফোনটা বাজছে তোমার ! পড়ার ঘর থেকে চিৎকার করে  ডাকলো অষ্টাদশী মেয়ে সৌমি । সাইলেন্ট করে রেখে দে না। ব্যস্ত হাতে ঘরকন্নার কাজ সামলাতে সামলাতে বলল তৃষা।



বেশ কিছুদিন ধরে  কাজের মেয়েটা আসছে না। দীপ্তর  অফিস, সৌমির কলেজ সাথে যাবতীয় কাজ এসব নিয়ে ব্যস্ত সে। মনে মনে ভাবতে থাকে শাশুড়ি মায়ের পায়ের ব্যথাটা  ইদানিং বেশ বেড়েছে। আজ একবার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলাটা দরকার।



কই হল?  আমার যে দেরি হয়ে যাচ্ছে!  দ্বীপ্তের  ডাকে সম্বিত পেল তৃষা।  খাবার দিতে দিতেই আবার বেজে উঠলো ফোনটা।  হাত বাড়িয়ে দ্বীপ্ত বলে, "ধরো ,তোমার ফোন এসেছে!" তৃষা বললো,"  এখন আবার কে! "  'বৃষ্টি"......খাবার মুখে পুরতে পুরতে  জবাব দিল দ্বীপ্ত।



বৃষ্টি ,তৃষার ছোটবেলার বন্ধু । স্কুল-কলেজ সব একসাথে। তারপর  ছাড়াছাড়ি। মেয়ের অনেক জোরাজুরিতে  ফেসবুকে একাউন্ট খুলেছিল তৃষা। তার সূত্রেই যোগাযোগ বৃষ্টির সাথে। বৃষ্টিই তৃষাকে  খুঁজে নিয়েছিল ফেসবুকে। তারপর যোগাযোগটা বরাবরই সে-ই রেখে চলেছে। তৃষা হাত নাড়িয়ে বলে থাক, এখন নয় পরে আমিই করে নেব।



একে একে সবাই বেরিয়ে যায় যে যার কাজে। শাশুড়ি মা দুপুরে খাবারের পর প্রতিদিনের মতোই শুয়েছেন। এখন এই একঘন্টা সময় শুধু তৃষার একার। তৃষা বৃষ্টিকে ফোন করতেই খানিকটা অনুযোগের পর বলে, মন দিয়ে শোন আগামী ১৪ ই ফেব্রুয়ারি আমরা ইউনিয়ন করছি। বিল্টু, অর্পণ, দিশা, সৃজা সকলেই আসবে কিন্তু। আর তোকেও আসতে হবে তৃষা বলল চেষ্টা করব। বৃষ্টি বলল ওসব কিছু শুনছি না  তুই আসবি তোকে আসতেই হবে।



রাতে দ্বীপ্ত জিজ্ঞাসা করল বৃষ্টিকে ফোন করেছিলে? কিছু হয়েছে কি? না আসলে বারবার ফোন করছিল তো! ঘরের আলো নিভিয়ে দিতে দিতে তৃষা অস্ফুটে বলল করেছিলাম। গলার স্বর আরো নামিয়ে বলল কলেজের রি-ইউনিয়ন। দীপ্ত বললো বেশ তো  যাও না ঘুরে এসো। এমনিতে তো কোথাও নিয়ে যেতে পারি না  তোমায়! তা কবে? তৃষা বলল ১৪ ই ফেব্রুয়ারি। আর আমি গেলে তোমাদের ভীষণ অসুবিধা হবে। দীপ্ত বলল কিছু অসুবিধা হবে না, একদিনের তো ব্যাপার  সবাই  ঠিক মানিয়ে গুছিয়ে নেব।  প্রয়োজনে ছুটি নিয়ে নেব একদিন। তৃষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল দেখি!



সকালে বাবার মুখে  সবটা শুনে সৌমি জোরাজুরি শুরু করে দিলো। দুপুরে শাশুড়ি মা ও বললেন বৌমা সংসারের জন্য তো করেই যাচ্ছ একদিন নিজের জন্য কিছু ভাবো। যাওনা কাটিয়ে এসে বন্ধুদের সাথে। সৌমির ডাকে ঘুরে তাঁকায় তৃষা, মা কাল তুমি এই শাড়িটা পড়ে যেও। বৃষ্টি আন্টি বাবাকে বলেছে তোমাদের ড্রেসকোড নাকি হলুদ , তাই বাবা এটা কিনে এনেছে তোমার জন্য। তৃষা আড়চোখে সৌমির দিকে তাকালো। ওর হাতে ধরা হলুদ জামদানি,  শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে পরার জন্য গয়না ঠিক করে রেখেছে সৌমি। পাশ থেকে দীপ্ত বলল এত বছর পরে যাচ্ছ বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে  সবার জন্য কিছু না কিছু গিফট নিয়ে যেও।  পাউরুটিতে মাখন লাগাতে লাগাতে তৃষা বলল তোমরা শুধুই ব্যাস্ত হচ্ছো আমি কিন্তু যাচ্ছি না রি-ইউনিয়নে। সৌমি কিছু বলতেই যাচ্ছিল দীপ্ত ইশারায় বারণ করল। সে জানে একবার যে সিদ্ধান্ত তৃষা নিয়ে ফেলেছে তা থেকে তাকে সরানো পসেবল নয়। এর মধ্যে বৃষ্টি ফোন করে বলল তৃষা আমি একটা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ বানিয়েছি তোকেও,  অ্যাড করেছি একটু দেখে নিস। আর কাল তুই তৈরি হয়ে থাকিস যাবার পথে একসাথে চলে যাব।  সবাই একসাথে সারাদিন আড্ডা দেবো। দেখিস তোর ভাল লাগবে । তৃষা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল তোরা যা আমার হবে না। 



আজ একটু সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যায় তৃষার । মেয়ে টিউশনি গেছে,  শ্বাশুড়িমা পূজার ঘরে আর দ্বীপ্ত ল্যাপটপে কাজ করছে। তৃষা প্রতিদিনের মত হাতের কাজ গুলো করলেও কেমন যেন বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল আজ। ফোনটা বেজে উঠলো একটা আননোন নাম্বার  তৃষা ধরল না। আর ধরবেই বা  কেন সে তো আর  রি-ইউনিয়নে যাচ্ছে না। মনে মনে ভাবতে লাগল আচ্ছা সে যাচ্ছেনা বলে কি সকলে রাগ করবে? বাড়ির সকলেই বা কি মনে করছে? তার জন্য কি সবাই অপেক্ষা করবে? সবাই?



তৃষা  ফোনটা নিয়ে অনলাইন হতেই দেখল হোয়াটসঅ্যাপে পরপর অনেক মেসেজ এল। গ্রুপে সবাই যে যার ছবি দিয়েছে সেজেগুজে। কেউ কেউ আবার লিখেছে দেখা হচ্ছে.........। এরই মাঝে  এলো একটা ভিডিও । আংগুল ছোঁয়াতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে অর্পণ। চোখ দুটো লাল কোটরে ঢোকা মৃদু হেসে বলছে," সরি বন্ধুরা আজ আর আমার  যাওয়া হলো না রি-ইউনিয়ন,  ভীষণ ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কি করবো বল? তোদের তো বলাই  হয়নি, কলেজে পড়ার সময় আমার গলায় সমস্যা হয়েছিল। চিকিৎসার পর ঠিকই ছিলাম কিন্তু দীর্ঘ কয়েক বছর যাবৎ আবার আমার  ভোকাল কর্ডে বড় কোনো অসুখ ভালোবেসে ঘর করছে। ডক্টর বলেছিল যখন-তখন ভর্তি হতে হবে হাসপাতালে। তবে সেটা  যে  আজই বুঝতে পারিনি। সকাল থেকে গলায় খুব ব্যথা কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। কাল আমার অপারেশন জানিনা তারপর কি হবে! আদৌ স্বর ফেরত আসবে কিনা, তোদের সঙ্গে আর দেখা হবে কিনা তাও জানিনা!  তোদের খুব মিস করব রে,  তোরা প্রত্যেকে খুব ভালো থাকিস,  বেঁধে বেঁধে থাকিস।  এই দেখ কথা মতো আমিও আজ হলুদ পড়েছি।  যদিও ডক্টর প্রথমে বারণ করেছিল কিন্তু আমার জোরাজুরিতে আর কিছু বলেননি। আজ রাখি গলাটা বুজে আসছে। যদি ফিরে আসি বন্ধু তবে ফের দেখা হবে। এ বছর না হয় আমার রি-ইউনিয়নটা তোলা থাক।"



তৃষার সমস্ত শরীর কাঁপছে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে সেই হ্যান্ডসাম ছেলেটাকে যে তার দিকে এগিয়ে আসছে  আর বলছে ,"এক্সকিউজ মি তোমার কাছে কি এক্সট্রা পেন আছে"? আর তারপর  ওর হাসি, মজা, কথা বলার ধরন, গানের গলা, কবিতা লেখা, ওর সাথে কাটানো মুহূর্ত ,ভ্যালেন্টাইন ডে, প্রথম গোলাপ.....  আর তারপরই হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে যাওয়া। যদিও দীর্ঘ পাঁচ বছর পর বৃষ্টির মাধ্যমে তৃষাকে জানিয়েছিল ওর পক্ষে আর রিলেশন রাখা সম্ভব নয় তৃষা যেন ভালো ছেলে দেখে বিয়ে করে নেয়। অভিমানী তৃষা বেশ কিছুদিন কেঁদেছিল আর তারপর বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করে ঘর বেধে ছিল। যদিও বিয়ের আগেই সবটাই জানিয়েছিল দীপ্ত কে। দীপ্ত তার স্বভাব সিদ্ধ ভঙ্গিতে বলেছিল, "অতীত ঘেঁটে  কি লাভ তার চেয়ে চলো আমরা বর্তমান নিয়ে বাঁচি।"



তৃষার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে কিছু বুঝতে পারেনা তৃষা কি করবে! মাথায়  একটা চেনা স্পর্শ অনুভব করল ।  ফিরে দেখতেই দ্বীপ্ত  বলল তোমার কি শরীর খারাপ করছে?  তৃষা ফোনটা ওর  দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল , বল এবার আমি কি করব? তুমিই  বলে দাও প্লিজ! দীপ্ত ভিডিওটা দেখে  বলল আমি তোমায় বিশ্বাস করি, শুধু বলবো এত সহজে বন্ধুত্ব ,ভালোবাসা হারিয়ে ফেলো না। যাও  তৈরি হয়ে নাও ...  



চোখে মুখে জল দিয়ে খুব যত্ন করে হলুদ জামদানিটা পড়ল তৃষা।  দীপ্ত সুন্দর করে গয়না দিয়ে সাজিয়ে দিল। ওকে আজ ভীষণ  স্নিগ্ধ লাগছে । ধীরে ধীরে সে বৃষ্টিকে ফোন করল বৃষ্টি ফোন ধরেই বলল তৃষা তোকে বিল্টু ফোন করেছিল আমাদের রি-ইউনিয়নটা  ক্যানসেল হয়েছে তা জানাতে । তুই হয়তো......,  তৃষা বলল তোরা কোথায় আছিস? আমি আসছি ! আর শোন সবাই ড্রেস কোড মেনে ড্রেস পরবি কিন্তু।  বৃষ্টি কিছু বলতেই যাচ্ছিল ওকে থামিয়ে তৃষা বলল এবার  আমাদের রি-ইউনিয়নটা না হয় হাসপাতালেই হোক।।

Comments