গল্প - আশিস ধর


লালসা                 


একটু তফাতে সাধন মাথা নিচু কোরে বসে আছে শ্মশান ঘাটে। সম্মুখে শায়িত ওর বাবার মৃতদেহ। ছোট ভাই মনোজ মাচা ছুয়ে বসে। শুষ্ক ক্লিষ্ট চেহারা, অনেকদিন ভুগতে ভুগতে মনোরঞ্জন আজ ভোরেই কোরেছে  দেহ রক্ষা । আর্থিক অনটন থাকা সত্বেও ডাক্তার বদ্যি করে অনেক চেষ্টা কোরেছে সাধন। কিছুতেই কিছু হোলনা।  অশ্রুতে ঝাপসা হয়ে আসছে বার বার চোখদুটো। চোখের সামনে ভাসছে মা’র ছোট বোনের বাবাকে জড়িয়ে ধরে আর্ত চিৎকার। ডাক্তারের ডেথ সার্টিফিকেট। আত্মীয় স্বজন সবার সাথে যোগাযোগ কোরে শ্মশানে আসতে আসতে প্রায় দুপুর বারোটা।


কাগজপত্র জমা দিতে গিয়ে জানা গেল আট নম্বর। মনোরঞ্জনের আট নম্বর ট্যাগ ঝুলে গেল। এখন চার নম্বর চলছে। ইলেকট্রিক চুল্লীতে মোটামুটি একেক জনের পয়তাল্লিশ মিনিট ধরলে তিন সাড়ে তিন ঘন্টা। বিকেল তিন সাড়ে তিনটে। মৃত্যুর পরেও লাইন থেকে রেহাই নেই! অবশ্য সাধন ভাবছে অন্যকথা। মৃত হলেও তবু চোখের সম্মুখে আছে বাবা। একবার চুল্লীতে প্রবেশের অপেক্ষা। এরপর নাম মিটে যাবে চিরতরে।                                                                   
 

বসে থাকতে থাকতে শুনতে পেল। শ্মশানের বাইরে থেকে অনেক মানুষের একসাথে অমর রহে অমর রহে স্লোগান। উৎসুকতা নিয়ে তাকিয়ে দেখলো সাধন। ফুলে ফুলে সাজানো শববাহী গাড়ি ঢুকছে শ্মশানের ভেতর। পেছন পেছন অনেক মানুষ। বুঝতে অসুবিধা হোলনা বড়সর কেউকেটা কোন ব্যক্তি হবে। গাড়ি থেকে শব নামনো হ’লে, চিনতে অসুবিধা হোলনা। সত্যব্রত রায় মিউনিসিপ্যালিটি কাউন্সিলর। ঘৃনায় মুখটা বেকিয়ে গেল সাধনের। টাকার কুমীর জালিয়াত এই মানুষটা। এর জন্য সময়ের আগে মনোকষ্টে ভুগতে ভুগতে অসুস্থ হয়ে চলে গেল সাধনের বাবা। কি ভাগ্যর পরিহাস!


একদিন যাকে জোড় জবরদস্তি করে অন্যায়ভাবে জমি বাড়ি থেকে করেছিলো উৎখাত। আজ তারই পাশে শুয়ে আছে নোংরা মানুষটা। নেতারা মানুষের ভোটে নির্বাচিত হলেও অবজ্ঞা করেন সেই সাধারন মনুষকে। নিজেকে ভাবতে থাকেন সর্বশক্তিমান মসীহা। ভুলে যান মৃত্যুর পর উপর্জিত কোন কিছু নিয়ে যেতে পারবেননা। তবু কিছু মানুষের লোভ লালসার অন্ত নেই। কেউ কেউ বলে থকে, ছেলে পরিবারের ভবিষ্যত তৈরী করে যাবার জন্য তার এই শ্রম।  মিথ্যে কথা। কৌশলে ধন সম্পদ বাড়ানো একটা নেশা। সেই নেশার আগুনে কে মরল না বাচলো পরোয়া নেই। কেবল সম্পদ নয়, সেসাথে মন চায়  ক্ষমতার চূড়ায় বসে রাজ করা।


কাউন্সিলর সত্যব্রত রায়ের বাবার সময় থেকে। বাড়ির পাশে ছিল সাধনদের ঠাকুর্দার কাচা বাড়ি। বাড়ির সামনে ছিলো সাধনের বাবা মনোরঞ্জনের গালামালের দোকান। সেই দোকানের বিক্রিবাটা থেকে ভাল মন্দ মিশিয়ে সংসার চলে যেত। কিন্তু প্রতাপশালী কাউন্সিলর সাহেবের সাধনদের জমিটার দিকে ছিলো নজর। কেননা দশ কাঠা জমির ওপর ওনার পাকা বাড়িটা নাকি ছোট হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য ছলেবলে কেবল মনোরঞ্জনের পাঁচ কাঠা জমি নয়। ওপাশের হরিপদ মন্ডলের তিন কাঠা জমিটাও। বেআইনি দখল নেবার চেষ্টা নরমে গরমে চালিয়ে যেতে লাগলো।                    


একদিন মনোরঞ্জনকে কে ডেকে কাউন্সিলর খুব নরম গলায় বললেন-তোমার বাবা নিবারণ কাকু খুব ভাল মানুষ ছিলেন, আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ওর বিপদে আপদে আমি সবসময় পাশে ছিলাম। তুমি তখন অনেক ছোট। তুমি জান কিনা জানিনা। অনেক টাকা লেগেছে, তোমার মায়ের কঠিন রোগে। যখনই টাকার দরকার হোত কাকু আমার সামনে দাড়াতো। আমি আবার অন্যের দুঃখ সহ্য করতে পারিনা! কত হাজার টাকা দিয়েছি লেখাজোখা নেই। নিজেকে সম্বরণ কোরে ভারী গলায় আবার বললেন-অনেক চেষ্টা করেও তোমার মাকে বাচাতে পারলাম না। 


মনোরঞ্জন কাউন্সিলর সাহেবের কথাগুলো শুনছিলো মনযোগ দিয়ে।  মা খুব অসুস্থ হয়ে ছোট বেলায় মারা গিয়েছিল, একথা সত্যি। কিন্তু ওনার কাছ থেকে বাবা অনেক টাকা কর্জ করেছিল, একথা কখনো শোনেনি। বাবা মারা গিয়েছেন কয়েক বছর হয়ে গেলো। মাও মারা মারা গিয়েছেন অনেক দিন হোল এখন তো জানার আর কোন উপায় নেই।


একটু চুপ থেকে কাউন্সিলর সাহেব আবার বললেন- তোমরা তো আমাকে চেন। মানুষের দুঃখে আমার হৃদয় কাঁদে। আজ তোমরা চেয়েছিলে বোলে আমি কাউন্সিলর। কাউন্সিলর থাকি বা না থাকি, কেউ কোন সমস্যা নিয়ে সামনে দাড়ালে ফেরাতে পারিনা। মনোরঞ্জন, কোন প্রত্যাশা নিয়ে কিন্তু তোমার বাবাকে টাকা দেইনি। কিন্তু নিবারণ কাকু কিছুতেই মানলো না। তোমাদের বসত বাড়ি সহ পাঁচ কাঠা জমি আমার নামে লিখে দিল। দলিল ও আমার কাছে আছে।


মনোরঞ্জনের যেন ইলেকট্রিক শক্ লাগলো। লোকটা বলে কি! বাবা লিখে দিয়ে গেছে? হতেই পারে না। মিনমিন কোরে বলল- কই আমাদের তো কখনো বলেনি বাবা। এত বড় একটা কথা বাবা কি কোরে চেপে গেলো। বুঝতে পারছি না।


-তুমি আমায় ভুল বুঝোনা। আমি টাকা পয়সার ব্যপারে একবারের জন্য কিছু বলিনি। কিন্তু উনি খুবই সৎ মানুষ। আমার কথা শুনলো না। আমাকে বলল-বিপদের সময় যেভাবে পাশে এসে দাড়িয়েছিলে, তার ঋণ টাকা পয়সা দিয়ে শোধ করা যায়না। তবু আমার যতটুকু সামর্থ। আমি আমার বাড়ি, যৎসমান্য জমি যা আছে, তোমার নামে লিখে দিলাম। তুমি না করবে না।


মনোরঞ্জন দম বন্ধ কোরে কথাগুলো শুনছিলো। বুঝতে পারছিলো বিরাট হাঙ্গরের সামনে পড়েছে। এখন ওদের সবকিছু গিলে খাবে। তবু মিনমিন কোরে বলল- স্যার, বাবা মারা গেছে বেশ ক’বছর হয়েছে। কেন এতদিন আমাদের বলেননি।
         

কাউন্সিলর সাহেব ততোধিক নরম গলায় বললেন- তোমার বাবার মৃত্যুর পর তোমাদের ছন্নছাড়া অবস্থা বিচার কোরে এতদিন কিছু বলিনি। কিন্তু এখন আমাদের বাড়ির যায়গার সংকুলান হচ্ছেনা। তাই তোমাদের যায়গাটা আমার দরকার হয়ে পড়েছে। গলায় দৃঢ়তা এনে আাবার বললেন- আমি একমাস সময় দিলাম। এরমধ্যে যয়গাটা ছেড়ে দিলে খুশি হব।
         

মনোরঞ্জন থতমত খেয়ে কি জবাব দেবে ভেবে পেলনা। পরে আস্তে আস্তে বলল- স্যার, ছেলেমেয়ে পরিবার দোকান ফেলে কোথায় যাবো?  দোকানটার বিক্রিবাটা থেকে আমাদের সংসার চলে। আমরা তো না খেয়ে মরবো। আপনি বিচার করুন।
         

কাউন্সিলর সাহেব রাগত স্বরে বললেন- তোমরা কি করবে তোমরা ঠিক করবে। আমি তো তোমার বাবাকে না করেছিলাম। যে টাকাটা আমি দিয়েছি, সেটা চিকিৎসার জন্য। জনগনের সেবক আমি। জানবে, কোনদিন তোমার বাবাকে টাকার কথা কিছু বলিনি। লোকে আমার কাছে অনুনয় বিনয় করে ৠন মকুব করার জন্য। আর তোমার বাবা স্বইচ্ছায় আমার নামে লিখে দিল জমি বাড়ি সব। আমি এমন মানুষ কোনদিন দেখিনি!                                                                                                              
           
মাথা নিচু কোরে চুপচাপ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসলো মনোরঞ্জন। নিজের মনেই বিড়বিড় করতে লাগলো। সত্যব্রত রায় কি রকম চামার, সবাই ভালো কোরে জানে। বিশ্বাস হচ্ছেনা, দলিলটা ওঁর হাতে আছে। সবই জাল মনে হয়। কয়েকদিন আগেই তোরঙ্গে দেখেছিল দলিলটা। ঢপ দিচ্ছে। কিছুতেই বাড়ি ছাড়বো না। দেখি ঠকবাজটা কি কোরতে পারে। ঘরে এসে বড় আশা নিয়ে তোরঙ্গ খুললো। না দলিল নেই। ঘর তোলপাড় করেও খুঁজে পেলনা দলিলটা। মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে। নিশ্চয়ই কাউকে দিয়ে চুরি করিয়েছে দলিলটা্। পরে ওর বাবার নামে জাল চিঠি বানিয়েছে চশমখোর লোকটা।                                                                 
 
মনোরঞ্জন ভলোই জানে, এসব ধরিবাজ লোক সরকারী পদের অপব্যবহার কোরে নিজের আখের গোছানোই এদের উদ্দশ্য। পুলিশ প্রশাসন এদের কথাতে ওঠে বসে। তবু শেষ দেখে ছাড়বে।
          

কিছুদিন পর কোর্ট থেকে শমন পেল। একদিন থানা থেকে ওকে ডেকে পাঠিয়ে খুব ধমক ধামক দিল পুলিশ। মনোরঞ্জন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারলো, জলে থেকে কুমীরের সাথে বৈরী করার অর্থ ধনে প্রাণে শেষ। এদিকে কাউন্সিলর সাহেব বুঝতে পারছেন এভাবে হবেনা। মিডিয়ার সাথে সাথে শত্রু মিত্র সবাই ওর দিকে আঙ্গুল তুলবে। তখন পালাবার পথ পাবেনা। যাবে মান, সেসাথে সাধের কাউন্সিলারগিরিটিও। অনেক অনেক আগুপিছু চিন্তা কোরে, কাউন্সিলর সত্যব্রত রায় ডাকলেন মনোরঞ্জনকে। ধানাই পানাই করে নমনীয় গলায় বললেন-বুঝতে পারছি, একটা যায়গা থেকে সবাইকে নিয়ে উঠে যাওয়া সত্যি কষ্টকর। নদীর পাড়ে আমার সাড়ে তিন কাঠার মত জমি আছে। জমিটা তোমার নামে লিখে দেব। কিছু টাকাও দেব। চিন্তা কোরনা, আমি আছি। বিপদে আপদে ষখনই দরকার হবে, আমাকে জানাবে।
        

অসম লড়াইতে হার মানতে হোল। মনোরঞ্জন বুঝতে পারলো, সবই কথার কথা। মানে মানে বাপ ঠাকুর্দার জমি ছেড়ে বনবাসে যেতে হবে। যেতেই হবে। না গেলে যে হিংস্র লোক, হয়তো জীবন্ত পুড়িয়ে মারবে ওদের। এটা ভাববার যথেষ্ট কারন আছে। ওপাশে ছিল নবীন মন্ডলের বাড়ি। শুনতে পেয়েছে, ওকেও নাকি গুম খুনের হুমকি দিয়ে কোরেছে জমি ছাড়া। মনোরঞ্জন পরিবার নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে চলে গেছে সব কিছু ছেড়ে। নদীর পাড়ে সত্যব্রত রায়ের সাড়ে তিন কাঠা জমিতে কোনমতে বসেছে বাড়ি দোকান বানিয়ে। ছেলে সাধনের বয়স ছিল তখন বারো বছর। এই অঞ্চল লোক সমাগম সেভাবে নেই। দোকানেও তথৈবচ ছিল বিক্রিবাটা।
    
       
মনোকষ্টে শরীর মন অসুস্থ হয়ে বিাছানা নিল মনোরঞ্জন। একমাত্র ছেলে সাধন পড়াশশুনা ছেড়ে দোকানে বসলো। এরমধ্যে কয়েক বছর পর সাধন পুরানো পাড়ার রাস্তা দিয়ে সাইকেলে যাচ্ছিলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো, পুরানো বাড়িগুলো ভেঙ্গে গড়ে উঠেছে বিশাল দোতলা বাড়ি। এত বড় বাড়ি এই তল্লাটে নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেল। নানা প্রশ্ন জাগে মনে। গরীব বলে ওদের এভাবে প্রতারিত হ’তে হোল। এর কয়েক বছর পর চলচ্ছক্তিহীন হয়ে বিছানায় কাটিয়ে আজ চলে গেল মনোরঞ্জন।
 
       
সাধন মুখ ফিরিয়ে দেখলো। সত্যব্রত রায়ের শায়িত শবদেহ থেকে, ইতিমধ্যে সমস্ত শরীর ঢাকা রজনীগন্ধার ফুলের মালাগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে একপাশে। শ্মশান ঘাটের বেওয়ারিশ ছাগল গুলো মুদ্রিত নেত্রে খুশিতে চর্বণ করছে ফুলগুলো। না কোন ফুল জোটেনি ওর বাবার শবদেহে! পয়সাওয়ালা নেতা তো নয়। সামান্য মুদিওয়ালা। কে খবর রাখে। অবাক হয়ে দেখলো সাধন। আশেপাশে বাঁশের বাতার ওপর রাখা সব শবদেহগুলো সাদা কাপড়ে ঢাকা। ধনী দরিদ্র জাতে কোন ভাগাভাগি নেই।
      
       
নেই পালঙ্ক, চাকচিক্য, নেই নরম তুলতুলে গদি। শুয়ে আছে আর পাঁচ জনের সাথে মিশে বিলাস ব্যসণে  জীবন কাটানো সত্যব্রত রায়! উম্মুক্ত আকাশের নিচে ফুট দেড়েক চওড়া বাঁশের বাতার ওপর। অন্যান্য শবদেহের মত। অপেক্ষায় আছে ইলেকট্রিক চুল্লির গহ্বরে ঢোকার। এখনই লোকজন সব কেটে পড়েছে। অমর রহে স্লোগান মনে পড়ছে। এসব লোক আর কতদিন মানুষের মনে অমর থাকবে সময়ই বলবে! প্রতিটি মানুষ জানে একদিন মরতে হবে। সবই রেখে যেতে হবে এখানে। কিছু লোক, তবু মিথ্যে ক্ষমতার লোভ, বৈভব, টাকার লালসায় মানবতাকে বিকিয়ে দিতেও কসুর করেনা।    

Comments