গল্প - কাজী রুনালায়লা খানম


সোনালি রোদের গন্ধ


প্রিয়াংশী অপেক্ষা করে। ভোরের। আড়মোড়া ভাঙছে রাত। সুব্রত ঘুমোয়।পাশ ফিরে।গতরাতের হ্যাংওভারে অসাড়ে। পুুকুরের শান্ত জলে ছোট্ট ঢিল পড়লে যেমন সর কাটে। প্রিয়াংশীর ঘোর কাটে তেমন করে।প্রিয়াংশী ওঠে। আলগোছে বাসি কাপড় ছাড়ে। গতরাতের অহেতুক অবমাননাকেও। সময় কতো দ্রত বদলে যায়!মানুষও। বিশ্বাস আর শ্রদ্ধাবোধ না থাকলে যা পড়ে থাকে তা হলো সম্পর্কের খোলস। বয়ে বেড়ানো বড় কষ্টকর।প্রিয়াংশী তো ছেড়েছিলো সবই। ভালোবাসার মানুষ, পি এইচ ডি র স্বপ্ন,নাচ। সব সবটা। বাবার পছন্দের উঁচু মাইনের ছেলের সঙ্গে মানিয়ে নিতে নিতে ভুলেই গিয়েছে তারও নিজস্ব একটা জীবন আছে। সে জীবনেরও কিছু দাবিদাওয়া  আছে। তারও থাকতে পারে নিজস্ব রুচিবোধ। গতসন্ধ্যার পার্টিতে মিঃ বোসের অসভ্যতাটা কিছুতেই ভুলতে পারছেনা প্রিয়াংশী। সবচেয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেছে সুব্রতর আচরণে। প্রতিবাদ তো করেই নি। উল্টে তাকেই "ন্যাকামো কোরো না তো! তুমি আর কি বুঝবে মিঃ বোসের ওপর ডিপেন্ড করছে আমার নেক্সট প্রমোশন! মি বোস তোমাকে পছন্দও করেন। আমার প্রোমোশনের দরকারে একটু ঘনিষ্ঠতা...!" আর কথা বাড়ায়নি প্রিয়াংশী। রাগে ঘেন্নায় বিবমিষা এসেছিলো। ছুটে গিয়ে বাথরুমে দরজা এঁটেছিলো।  


চাবির গোছাটা তুলে নেয়। সদরের তালা খোলে। সামনের পথটা সোজা চলে গেছে কিছুটা। তারপর দুদিকে ভাগ। একদিকে কয়েকটা ইটকাঠের বড় বড় বাড়ি পরপর। কিছুটা ছাড়িয়ে বাজার।বাজারের পাশেই ভাগাড়। সারাক্ষণ কাক কুকুরের খিঁচিমিচি। প্রিয়াংশী ওদিক হাঁটেনা।অন্য পথটা চলে গেছে বিপরীতে। খানিক ঢালু। গ্রাম গ্রাম। বড় বড় গাছ। এদিকে বাড়ি কম। মাঠ বেশি। পথের দু ধারে। সারাবছর ফসলে ভরে থাকে। একটু এগিয়ে প্রাইমারী স্কুল। সামনেই ছোট নদী মালঙ্গী। ধারে বিরাট অশত্থ গাছটা দাঁড়িয়ে আছে কতোকাল। প্রিয়াংশী হাঁটে। একা। এই বিহান বেলাটায় একা হতে ভালো লাগছে ওর। অবাঞ্ছিত সহযাত্রীর চেয়ে একা হাঁটা ভালো।নিজের সাথে চলতে পারাও তো একটা আর্ট! ঘিয়ে রঙের আলো ফুটছে পুবের আকাশে। প্রিয়াংশী মাঠ দেখে। ফসলের ঘ্রাণ নেয়। পুকুরের শান্ত জল দেখে।  পাখিদের ওড়াওড়ি দেখে। প্রিয়াংশীও ওড়ে অদৃশ্য ডানায়।উড়তে উড়তে গিয়ে থামে মেয়েবেলায়। ময়নামতীর মাঠ।পাশেই টলটলে জলের শান্ত পুকুর। এই পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে ঢেউ  তুলতো ওরা। খেলতো।গোল্লাছুট। মধুজা, কেয়া, নিষাদ, আফরিন, সুজান সবাই! দাপিয়ে বেড়াতো মাঠজুড়ে। স্কুল থেকে ফিরেই পিঠের বোঝা ব্যাগটা ফেলে ,জামাকাপড় ছেড়ে। এই ছোট্ট আধা শহরেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো ওরা।


 প্রিয়াংশী বসে। পুকুরপাড়ে রুদ্রপলাশ গাছটির তলায়।


হাতড়ায়।মেয়েবেলা। মুহূর্ত কুড়োয়। উঠে আসে এক আধলা যাপন।মধুজাটা দারুণ বিরিয়ানী বানাতো! কেয়ার ক্র্যাফ্টের নেশাটা এখনো বেঁচে আছে? নিষাদের গানের গলা ছিলো দুর্দান্ত! আফরিন কি যে ভালো পড়াতো ! সুজানের হবি ছিলো ফ্যাশন ডিজাইনিং। কতোরকম জামা বানাতো বাচ্চাদের! পড়াশোনায় তুখোড় প্রিয়াংশীর ধ্যানজ্ঞানই ছিলো ওর নাচ। নাচের জন্য সব ছাড়তে পারতো। সেজন্যই অর্চিষ্মানের মুগ্ধ চোখে কি ছিলো পড়ে দেখা হয়নি। কিন্তু  সত্যিই কি হয়নি! বুঝতে না পারার মতো অতোটাও অনুভবহীন তো ছিলো না প্রিয়াংশী! 


গতরাতটা  নাছোড়। ফের পাশে এসে বসে। প্রিয়াংশীর দু চোখ ভাসায়।একসময় ঠিক মলম লাগায় সময়। ধুয়ে যায় গ্লানি, ক্রোধ, শোক । আস্তে আস্তে  পূর্ণ হয়ে সকালটা ফোটে। প্রিয়াংশীর মনে পড়ে যায় বীরজু মহারাজজী মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন "বেটা নাচই জীবন। নাচই ইবাদত। নাচের মাঝেই মুক্তি। কোনোকিছুর মূল্যে নাচটা ছেড়ো না। এই নাচ তোমাকে একদিন পরিচিতি দেবে।" গুরুজীর কথাগুলো আজ বড় মনে পড়ছে!  অথচ এতোদিন ভুলেছিলো কি করে! ভেতরে ভেতরে চঞ্চল হয়ে ওঠে  প্রিয়াংশী। উঠে পড়ে। পা বাড়ায়। মনও। ঠিক তখনই ডানায় সোনালি রোদের গন্ধ মেখে আকাশের অনেক ওপর দিয়ে একঝাঁক সাদা বক উড়ে যাচ্ছিলো উত্তরের পাহাড়টার দিকে।

Comments