গল্প - সজল কুমার মাইতি


অপরাজিতা


এক

ভোর সকালে বউের কনুইের এক ঠেলায় কন্দর্পকান্তি ঘুম থেকে ধড়পড়িয়ে মশারির মধ্যে উঠে বসে। দেবযানী কর্কশকন্ঠে বলে ওঠে,

"শুনতে পাচ্ছ না হুইসেলের শব্দ ? ময়লার গাড়ি এসে গেছে।"

কন্দর্প এক লাফে মশারি তুলে প্রায় দৌড়ে গ্রিলগেটের চাবি নিয়ে দরজার ছিটকিনি খুলে গেটের তালা খুলে দ্রুতপায়ে গেটটা খুলে ফেলল। তড়িৎগতিতে পায়ে চটি গলিয়ে বেরনোর মুহূর্তে মনে পড়ে যায় মাস্ক পরার কথা। ফিরে এসে চশমা ও মাস্ক পরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে থাকে। চারতলা বেয়ে নিচে নামাটা তো চাট্টিখানি কথা নয়! নিচে নেমে কন্দর্প দেখে ময়লার গাড়িওলা হাঁটা লাগিয়েছে। দৌড়তে দৌড়তে কন্দর্প চেঁচিয়ে বলে ওঠে,

 "এই দাঁড়াও।"

কন্দর্পের ডাক শুনে ময়লাওলা দাঁড়িয়ে যায়। কন্দর্প বাঁ হাতের ময়লার প্যাকেট দূর থেকে ছুঁড়ে ময়লার গাড়ির মধ্যে নিখুঁতভাবে ফেলে দেয়। সবার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে প্রায় বাক্যহীন অবস্থায় বাঁ হাতে আজকের  পেপার পেপারওয়ালার কাছ থেকে নেয়। এবারও সিঁড়ি বেয়ে ওপরে নিজেদের তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠে যায়। লিফট থাকলে ও এই করোনাকালে সবাই এটা অ্যাভয়েড করে।

করোনার আতঙ্ক সর্বত্র। রাস্তাঘাটে,  বাজারে, সমস্ত জায়গায় সামাজিক দূরত্ব বজায়ের আপ্রান চেষ্টা। চেনা লোকগুলো কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে। কথা কম ইঙ্গিতেই বেশি কাজকর্ম করার চেষ্টা চলছে। কন্দর্পর ও একই অবস্থা। পার্কে যাওয়া নেই, আড্ডা মারা নেই। কলেজে যাওয়া নেই, গেস্ট আসা নেই। গৃহবন্দি কন্দর্প নিজের মনে মাঝে মধ্যেই গেয়ে ওঠে,

"ও আল্লারাজার দেশ

করবি কি তা বল।

ভাবনা তোর বারোমাস

আছে কি তার শেষ?

চোখের জলের জল সে কই ?

জীবন ভাঁড়ার যে নিঃশেষ।"

পুরো গানটা সব সময় গাওয়া হয় না। দু চার কলিই বেশি সময় গায়, বাকিটা গুন গুন। টাইম পাস আর কি! তবে গায়কি অনেকটা সত্যজিৎ ঘরানার।

লকডাউনের বাজারে রান্নার আর কাজের লোক আসা বারন। চারবেলার রান্না, থালা বাসন মাজা, ঘর পরিষ্কার করা, তার ওপর আছে জামাকাপড় কাচা। কাজের অন্তহীন লিস্ট শেষ হবার নয়। লকডাউনে গৃহবন্দি প্রতি পরিবারের এটাই রোজনামচা। কন্দর্পর ছোট সংসারে তিন সদস্য। স্বামী স্ত্রী ও মেয়ে। অলিখিত নিয়মে নিজেরা নিজেদের কাজ শেয়ার করে নেয়। তবে দেবযানীই বেশিরভাগটা সামলায়। ঘরকন্না করতেই দুপুর গড়িয়ে যায়। দুপুরের খাওয়ার পর বিশ্রামের সময়টুকু জোটে। কন্দর্প তখন ডিভানে শুয়ে টিভিতে সিরিয়াল দেখতে দেখতে বিশ্রাম নেয়। সারাদিনে এ সময়টাই মোবাইল ফোন চালু করে। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে হোটাসআপের মাধ্যমে যোগাযোগ বেশি করে এই সময়ে। আর মোবাইলেই চলে সৃজনশীল কাজ। কন্দর্প ছদ্মনামে গল্প লেখে। এ তো গল্প নয়। চোখ বন্ধ করলেই যেন স্পষ্ট এই ছবি তার চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে। মনে মনে গুনগুনিয়ে ওঠে, "ও আল্লারাজার দেশ... "


দুই

"এই দেবী, দেখে যাও কেমন লাল টুকটুকে কৃষ্ণচূড়ায় গাছ ভরে গেছে। গ্যামন কোম্পানির ছাদে যেন কেউ লাল মখমলের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে।"

 কন্দর্প তার স্ত্রীকে ডেকে তাদের ফ্ল্যাটের পেছনের এই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখায়। দেবযানী বলে,

"এ তো নতুন নয়, ফি বছরই তো দেখা যায়। আমাদের পেছনে কৃষ্ণচূড়া আর সামনে রাধাচূড়া। তুমি এতদিন দেখার সময় পাওনি। লকডাউনের বাজারে এখন তোমার চোখে পড়েছে।"  

কন্দর্প ভাবে হয়তো তাই l দেখার চোখ ছিল না। হৃদয়বৃত্তি হার মেনেছিল কঠিন বাস্তবের কাছে।

চড়ুই, শালিক কেমন জোড়ায় জোড়ায় বাড়ির ভেতরে চলে এসেছে। ভয়ডরহীন সব যেন নিজ নীড়ে ফিরে এসেছে। লিভিংরুম জুড়ে দাপিয়ে বেড়ায় তারা। এরা সব দেবীর খুব পছন্দের। সে ডেকে ডেকে এদের খাবার দেয়। এই ছোট্ট ছোট্ট পাখির দল তার আদর প্রশয়ে কোন বাধার সৃষ্টি করে না। আচার আচরণে তারা সবাই সাবলীল। যেন গৃহসদস্য। এ দৃশ্য দেবী মৃদু হাসতে হাসতে কন্দর্পকে দেখায়। মাঝে মধ্যে ওদের শাসন ও করে। সকালে অনেক সময় ওদের কিচিরমিচির কানে প্রাকৃতিক সংগীত সুধা ঝরায়। কিন্তু এই দেবীকে কন্দর্পের খুবই অচেনা মনে হয় যখন দেখে মেয়ের ছোট্টখাট্টো ব্যাপারে এই দেবী কি ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। তখন মনে হয় এ যেন ' সুবর্নলতা' র মুক্তো বামনী।

এই করোনাকাল ও লকডাউনের বাজারে রাস্তাঘাট সব শুনশান। অল্প বেলা বাড়ার সঙ্গে  সঙ্গে  শাকওলা তার কর্কশ কণ্ঠের চিৎকারে সকালের নিস্তব্ধতাকে খানখান করে চুরমার করে দেয়। ডাকতে থাকে,

"শাক নেবে গো...... শাক এসে গেছে....। লাউ, কলমি, নটে। পাট শাক, হিঞ্চে শাক। সব ফ্রেশ। বউদি সব সস্তা।"

করোনা ও লকডাউনের জেরে এমন জমজমাট রাস্তা এখন প্রায় মনুষ্যশূন্য। মাঝে মধ্যে  ফেরিওআলাদের আর্ত চিৎকার।

"নেবে গো....সব সস্তা।"

একে একে সব্জিওলা, ফলওলা,  মাছওলা,  ডিমওলা।  যে যার সাইকেল বা ভ্যান রিকশা করে নিজের সামগ্রী নিয়ে হাজির হয় আর চলে ও যায়। দরকষাকষি তো লেগেই আছে দাম ও ওজন নিয়ে। এদের মধ্যে হয়তো কেউ ছিল ডেলিভারি বয়, কেউ কুরিয়ার কর্মচারী, কেউ মলের কর্মী, কেউ আবার ফেরিওআলা বা দোকান কর্মী। সবাই আজ কর্মহীন। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে সবাই আজ এই রাস্তায়। এক অজানা অচেনা ভবিষ্যতের ঠিকানায় পৌঁছনোর দৌড়ে আজ সবাই সামিল।


তিন

করোনা কি শুধুই দিয়েছে হতাশা আর আতঙ্ক ! ভালো কিছুই কি দেওয়ার নেই তার? সকালে ঘুম ভাঙার পর কন্দর্প ও মেয়ের তিনটে করে হাঁচি দেওয়া বরাবরের ওভ্যেস। তা এখন উধাও। আকাশটা অনেক নির্মল দেখাচ্ছে। চাঁদ আরও পরিষ্কার, আরো কাছে মনে হয়। অনেকে তো কাঞ্চনজঙ্ঘা আর মাউন্ট এভারেস্টকে অনেক দূর থেকে ও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। কোথাও কোথাও  বারান্দায় ময়ূরের ও দেখা মিলছে। কন্দর্পর বাড়ির এয়ার পিউরিফায়ারটা এখন সর্বদাই সবুজ দেখায়। এখন তো শ্বাস কষ্টটা আর তেমন বোধ হচ্ছে না! এই সেদিন কন্দর্প পেপারে দেখেছে ওজোনস্তরের ক্ষয়টা এই কদিনে অনেকটাই মেরামত হয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ গাড়ি, কলকারখানার বিষ নির্গমন বন্ধ। প্রাণভরে শ্বাস নেওয়া যাচ্ছে। নির্মল আকাশ, নির্মল বাতাস আজ চাঁদের বুড়িকে আরও স্পষ্ট ও আরো নিকটে এনে দিয়েছে।

এই লকডাউনের বাজারে ও কন্দর্পের রোজকার রুটিনে কোন পরিবর্তন হয় নি। রোজই বাজার যাচ্ছে সে। যদিও রীতিমতো মাস্ক পরে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে। স্বল্প সময়ের মধ্যে বাজার সেরে ফিরে আসে। অবশ্যই একটু  বেলায় বাজার যায়। বাড়ি ফিরে কন্দর্প সব কিছু স্যানিটাইজ করে হাত পা কুড়ি সেকেন্ড ধরে সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার হয়ে বারান্দায় একটু সময় কাটায়। আকাশ দেখে। আর শোনে সবুজ গাছপালায় বসে থাকা রং বেরং এর নানা পাখির কলকাকলি। রাস্তা এখন একদম ফাঁকা। হঠাৎ দেখে বিচিত্রভাবে মাস্ক পরা কিম্ভূত আদিম আকৃতির একটা লোক ধীরে ধীরে গন্তব্যে রওনা হচ্ছে। কন্দর্পর মনের কল্পনায় ভেসে ওঠে যেন রঁদার ভাস্কর্য হেঁটে চলছে। ওমা ! পেছনে কে? রঙিন মাস্ক পরা কে এই সুন্দরী 'ধীরলয়ে চকিত চরণে করে পলায়ন' ? এতো পিকাসোর নরম তুলির টান। এই লকডাউন পিরিয়ডে এমনিতেই লোকজন কম। তাও সকালের দিকে অল্পস্বল্প লোকজন থাকে আর এই বেলায় জনমানবশূন্য। ওই দূরে ঘন ঘন অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ শোনা যায় l হয়তো কোন করোনা পজেটিভ রোগী মিলেছে l বিষন্ন মনে কন্দর্প আনমনে গুন গুন করে গাইতে থাকে,

"ও আল্লারাজার দেশ..."

হঠাৎ কন্দর্পর চোখে পড়ে মলিন চুড়িদার পরা এক ষোড়শী। আরে এ তো পাশের বস্তির সেই মেয়েটা। ভগ্নপ্রায় সাইকেলে একটা ক্রেটে কিছু ফল নিয়ে চলেছে l ক্ষীণ কণ্ঠের আর্তি,

"ফল নেবে গো....."  

ধীরে ধীরে সে ও চোখের আড়ালে চলে যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামে। কন্দর্প সন্ধের চাঁদ দেখছিল। আকারে বড় মিষ্টি চাঁদ। হঠাৎ চোখে পড়ে ওইতো সেই মেয়েটা না! ক্লান্ত শরীরে ফিরছে। তবে ক্রেটে এখন ফল নেই, মনে হয় আছে হয়তো কিছুটা চাল আলু এসব। আসলে পাশের বস্তির বাসায় ফিরে এই চাল আলু রান্না করে অসুস্থ বাবা মাকে খাওয়ায়।  তাদের শোয়ার ব্যবস্থা করে l তারপরে নিজে খেতে বসে। অবশিষ্ট যা থাকে তাতে কখনও পেট ভরে আবার কখনো আধপেটা থাকতে হয়। কি আর করা! বেশি ফল কেনার মূলধন নেই তার, লকডাউনের বাজারে বিক্রিবাট্টা বড়ই কম। তবুও কেটে যাচ্ছিল দিনগুলি। হঠাৎ করে ধুম জ্বর ধরে বসল বাবাকে। কিছুতেই জ্বর নামতে চায় না। আজ থেকে মা ও কাঁপুনি দিয়ে জ্বরে আক্রান্ত। মা বাবার সেবা করতে গেলে পেট চলে না। আবার পেট চালাতে গেলে মা বাবার সেবা হয় না। এমন এক পরিস্থিতিতে, সন্ধেয় ষোড়শী ফিরছে নিত্য দিনের মতো চাল আলু নিয়ে ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে। বস্তির সামনে এসে দেখে লোকেদের জটলা। জটলা থেকে এগিয়ে এসে বিপুলকাকা বলে উঠল,

"বড্ড দেরি করলি রে মা, সব শেষ।"

ষোড়শী নির্বাক নিশ্চল পলকহীন। দোপাট্টায় মুখনাক ঢাকা। শুধু দুফোঁটা চোখের জলে ভেজা দোপাট্টা। সাইকেলটা একপাশে পড়ে আছে। আলু চাল আজ কিছুটা ডাল ও জোগাড় করেছিল। সবই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। চিৎকার করে বিপুলকাকাকে বলতে শোনা যায়,

"জ্বরের খবর শুনে মিউনিসিপ্যালিটি থেকে গাড়ি এসেছিল। স্যাম্পেল নিয়ে গিয়েছিল। রিপোর্ট আসার আগেই সব শেষ। পরে রিপোর্ট এল, পজেটিভ।"

নিস্তব্ধতার খোলস খুলে হঠাৎই পাড়ার পাগলা দাশু গেয়ে ওঠে,

"ও আল্লারাজার দেশ

করবি কি তা বল।

ভাবনা তোর বরোমাস

আছে কি তার শেষ?

চোখের জলের জল সে কই?

জীবন ভাঁড়ার যে নিঃশেষ।"

Comments