গল্প - সোমজা দাস


 সমীকরণ


" দাদা শুনছেন? দাদা এই যেআপনাকে বলছি, শুনছেন নাকি?"

অরুন পিছু ফিরে তাকাল তখনই দেখতে পেল লোকটাকে পেছনে ছুটতে ছুটতে আসছে অফিস থেকে বেড়িয়ে আজ কলেজ স্ট্রীট  গিয়েছিল অরুন অনেকদিন ধরে আসব আসব করেও আসা হচ্ছিল না আজ অফিসে চাপ কম ছিল তাই বেড়িয়ে পরার সুযোগ পেল যখন, মনে হল কলেজপাড়ায় হয়েই আসা যাক

লোকটাকে আগে কোথাও দেখেছে বলে মনে পড়লো না ময়লা জামা গায়ে, গালে হপ্তাখানেকের না কাটা দাড়ি, এলোমেলো রূক্ষ চুলের লোকটা ফুটপাত দিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে

"এই যে দাদা, আপনি আপনি, আপনাকে বলছি দাঁড়ান না একটু"

অরুন এদিক ওদিকে পেছনে সর্বত্র তাকিয়ে দেখল না আর কেউ নেই তার মানে লোকটা তাকেই ডাকছে অরুন দাঁড়াল লোকটা ততক্ষণে দৌড়ে একেবারে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে অরুন ভালো করে তাকিয়ে দেখলো লোকটার দিকে লোকটার দৃষ্টিটা কেমন অদ্ভুত চোখের সাদা অংশটা লালচে, নেশা করলে যেমন হয়, কিন্তু চোখের মনি অদ্ভুত  জ্বলজ্বলে তাকালে মনে হয় বুকের ভেতরটা অব্দি পড়ে ফেলছে লোকটা এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে, অরুনের রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছে

"কিছু বলবেন?" অরুন জিজ্ঞাসা করলো

"বলবো তো আরে বলবই তো" লোকটা দাত বার করে হাসছে অরুন এতক্ষনে লক্ষ্য করলো লোকটার দাঁতগুলো কেমন যেন সূঁচোলো মত ফুটপাত ছেড়ে রাস্তায় নেমে এসেছে অরুন, যথেষ্ট ভীড় তাই ভয়ের কিছু নেই কিন্তু লোকটা কি বলতে চায়? পাগল নাকি রে বাবা?

লোকটা এবার হাত পাতে
"একশোটা টাকা হবে দাদা? দিন না খুব দরকার"

এই ব্যাপার টাকা চাই, তাই ডাকাডাকি শখ কত দু'পাঁচ টাকা নয়, সোজা একশোর দাবি অরুন বিরক্ত মুখে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু লোকটা এগোতে দিলে তো? এক লাফে আবার সামনে এসে দাঁড়াল সামনে হাত বাড়িয়ে বলল, "দিন না দাদা একশো টাকা"

অরুন এবার রীতিমতো বিরক্ত আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে তো তাও শুধু পাগল নয়, সেয়ানা পাগল বাসটা আসছে উঠে পড়তে পারলে এই পাগলের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায় আপাতত বাসটা সামনে এসে দাঁড়াতে পাদানিতে পা রাখলো অরুন ভিতরে বেশ ভিড় কিন্তু কি কান্ড ! লোকটাও বাসের সাথে সাথে ছুট লাগিয়েছে বাস একটু গতি নিতে লোকটা কিছুটা পিছিয়ে পড়লো পেছন থেকে চিৎকার করে বললো, "একশোটা টাকা দিয়ে যাবেন কিন্তু দাদা এমনিতেও ওই টাকা দিয়ে কি করবেন আপনি? আর তো মাত্র দুইদিন"

বাসটা দ্রুতগতিতে এগিয়ে একটা বাঁক নিতে লোকটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল কি বললো লোকটাআর মাত্র দুদিন মানে? দুদিন পরে কি হবে? লোকটা কি সত্যি পাগল?

বাড়ি ফিরেও লোকটার কথা কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারল না অরুন যতই পাগলের প্রলাপ ভেবে ভোলার চেষ্টা করছে, মনের মধ্যে চোরা কাটার মত খচখচ করে বিঁধছে যেন লোকটার বলা কথাগুলো রাতে খেতে বসেও বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিল সে রুমাও সেটা লক্ষ্য করেছে জিজ্ঞাসা করছিল, "কি এত ভাবছ?" অরুন মুখে হাসি টেনে স্বাভাবিক থাকার অভিনয় করে গেছে কিন্তু সত্যি স্বাভাবিক সে থাকতে পারছে কই?

অন্যদিন রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ঘন্টাখানেক বই পড়ে অরুন আজ কিছুতেই মন বসাতে পারছে না সে বারবার লোকটার কথা মনে হচ্ছে কি যেন ছিল লোকটার দৃষ্টিতে মোটেই পাগলের চোখ নয় তীব্র, ধারালো দৃষ্টি বইটা বিছানার পাশে টেবিলে রাখলো সে বন্ধ করে আজ আর পড়া হবে না সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে, কিন্তু মন যেন আজ অতিরিক্ত সচেতন

রাত দুটো বাজতে চললো রুমা পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে অরুন উঠে বসে জল খেল অনেকটা গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে বাথরুম থেকে ফিরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে জানলাটা খুলে দাঁড়ালো রাস্তাঘাট শুনশান দূরে কোথাও একটা কুকুর ডেকে উঠতে পাড়ার সারমেয়র দল সমস্বরে "জাগতে রহো" ঘোষণা করলো নিজেদের মাতৃভাষায় অন্ধকার নিঝুম মহানগরীর রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টগুলি বেয়নেটধারী সৈনিকের মত নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে অনমনীয় অধ্যাবসায়ে মাঝে মাঝে একটা দুটো সাইকেল বা গাড়ি হুশ করে বেড়িয়ে যাচ্ছে তাদেরও বাড়ি ফেরবার তাড়া অরুন নিজে কি কখনও বাড়ি ফেরার জন্য কোন আগ্রহ বোধ করেছে? মধ্যবিত্ত মানসিকতার মানুষ, জানে দিনের শেষে বাড়ি ফিরতেই হয় সেটা আগ্রহ নয়, অভ্যেস রুমা অপেক্ষায় থাকে তার ফেরার

মানুষ কত কিছুই তো অভ্যেসবশে করে এই যে নিত্যকার জীবনযাত্রা, সেটাও কি অভ্যেস নয় একটা সময় মনে হয়েছিল, নন্দিনীকে ছাড়া বাঁচবে না অরুন নন্দিনী বিয়ে করে প্রবাসী বরের সঙ্গে সাত সমুদ্দুর পাড়ে সংসার করতে চলে যাওয়ার পরে অরুন তো ভেবেই নিয়েছিল, কোনদিন বিয়ে করবে না আর কাউকে ভালোবাসা সম্ভব হবে না তার পক্ষে কিন্তু মানুষের মন, পরিবর্তন তো হয়ই রুমাকে কি অরুন ভালোবাসে আদৌ, যেমনভাবে নন্দিনীকে বাসতো? নাকি শুধু অভ্যেস? পাশাপাশি এক ছাদের তলায় দু'টি মানুষের দাম্পত্যযাপন জৈবিক নিয়মে রাতের আঁধারে শরীর মেলে, মন মেলে কি? মনের খবর কে রাখে?

সারারাত ধরে দুটি অস্বাভাবিক তীব্র চোখ তাড়া করে বেড়ায় অরুনকে স্নায়ুর যাবতীয় ক্লান্তিকে ছাপিয়ে চোখদুটো জেগে থাকে দীর্ঘ নিদ্রাহীন রাতের পর ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল অরুন রুমার ডাকে ঘুম ভাঙলো

"কি গো, অফিস যাবে না আজ? কত বেলা হয়ে গেল শরীর ঠিক আছে তো?"

ধরমরিয়ে উঠে বসলো অরুন ইশ, কত বেলা হয়ে গেছে অফিসে পৌঁছতে খুব দেরি হয়ে যাবে কালও তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বেড়িয়ে এসেছিল কাজ জমে আছে অনেক বাথরুমে ঢুকে  মুখে চোখে জল দিয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই মনে পড়ে গেল কালকের লোকটার কথা কালকের পর থেকে একটা দিন কেটে গেল আর একটা দিন বাকি কী হবে আরেক দিন পরে? কী বলছিল লোকটা? বলছিল টাকা দিয়ে অরুন কী করবে, আর দুদিন বাকি এসবের মানে কী? লোকটার কি কোন অলৌকিক শক্তি আছে? কি বলতে চাইছিল ? তাহলে কি অরুনের দিন ঘনিয়ে এসেছে? তার মানে কি আর একটা মাত্র দিন এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে অরুন?

অফিসটাইমেই বাড়ি থেকে বেড়িয়েও আজ আর অফিস যেতে ইচ্ছে হল না কিছুক্ষণ বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থেকে পরপর দুটো বাস ছেড়ে দেবার পর অরুনের মনে হল আজ আর অফিস যাবে না সে কিন্তু কী করবে তাহলে? একবার কলেজস্ট্রীটে যাবে? খুঁজে দেখবে লোকটাকে? জানতে চাইবে, লোকটা কী বলতে চায়? কিন্তু ভিতর থেকে কী জানি কেন সেই ইচ্ছেটাও তীব্র হচ্ছে না তেমন কেমন যেন জাগতিক সমস্ত ব্যাপারে নিস্পৃহ লাগছে কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে আর মাত্র একদিন হাতে সময়

সামনে এসে দাঁড়ানো বাসটাতে উঠে পড়ল অরুন, কোথায় যাচ্ছে বাসটা সেটা লক্ষ্য না করেই সারারাস্তা নিজের মধ্যেই ডুবে থাকল , অথচ কী ভাবছে সে নিজেও জানেনা হয়তো কিছুই ভাবছে না মস্তিষ্কের ভিতরে শূন্যতার এক অনন্ত বিস্তার অনুভব করছে অরুনের পাশ দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলেছে এই ব্যস্ত মহানগর শুধু অরুনের কোন ব্যস্ততা নেই, কোন লক্ষ্য নেই, সত্যিকারের কোন গন্তব্য নেই শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছে গাড়িটার অবশিষ্ট সব যাত্রী নেমে গেল একে একে এটাই বাসের লাস্ট স্টপেজ অরুনও নেমে পড়লো স্টেশনে কত লোক, সবাই চলছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে শুধু অরুনের কোন উদ্দেশ্য নেই কেন এসেছে সে এখানে, কিই বা করবে? বাড়ি ফিরে যাবে আবার?

স্টেশনের কাছে একটা চায়ের দোকানে পাতা বেঞ্চের উপর বসলো অরুন সামনে একটা কুকুর ঘুরঘুর করছে, এসে হাটু শুঁকছে নাক উঁচু করে অরুন একটা বিস্কুটের প্যাকেট কিনে বিস্কুটগুলো ছুড়ে ছুড়ে দিল কুকুরটাকে এক প্যাকেট বিস্কুট খেয়ে কুকুরটা আবার এসে শুঁকতে শুরু করলো হঠাৎই মাথা উচু করে তীব্র করুণ সুরে কেঁদে উঠলো কুকুরটা ভর দুপুর দোকানে যথেষ্ট ভিড় বিরক্ত দোকানদার 'হ্যাট হ্যাট' করে তাড়া দিলোতাতেও যায় না কুকুরটার কান্নায় কী যেন ছিল, অরুনের অন্তঃস্থল অব্দি কেঁপে উঠল কুকুরটার চোখদুটো কি বড় বেশী উজ্জ্বল? হাতের কাছে রাখা জলের জাগটা টেনে কুকুরটার দিকে সজোরে ছুড়ে মারল অরুন লাফিয়ে ছুটে পালালো কুকুরটা কুকুর নাকি মৃত্যুর লক্ষণ আগে থেকে টের পায়, কোথায় যেন শুনেছিল অরুন তাহলে কি এই কুকুরটাও বুঝেছে যে অরুনের সময় ফুরিয়ে এসেছে? অরুনের হাতে আর মাত্র একটি মাত্র দিন?

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামে, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে শিয়ালদা স্টেশনে এখন গৃহাভিমুখী মানুষের ঢল অরুন অলস দৃষ্টি বোলায় সেই জনসমুদ্রের দিকে সবাই ব্যস্ততার সাথে ছুটে চলেছে সারাদিনের কাজের ক্লান্তি ঢেকে তাদের চোখে মুখে এখন প্রিয়জনের কাছে ফেরার আগ্রহ অরুন ভাবে, সে তো কোনদিন রুমার কাছে ফেরার জন্য এরকম আগ্রহ বোধ করেনি ঘরে ফিরেছে, আর কোথাও যাওয়ার নেই বলে রুমার জায়গায় যদি আজ নন্দিনী থাকতো? তাহলেও কি দৃশ্যটা এরকমই হত? নন্দিনীর কথা মনে হতেই বুকের কোথাও একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করে অরুন অরুন যদি সত্যিই মরে যায়, তবে নন্দিনীর সাথে আর দেখা হবে না কোনদিন নন্দিনী যখন জানবে অরুন আর নেই, কি করবে সে? কষ্ট পাবে কি? চোখের জল ফেলবে আদৌ? পুরনো কথা, একসাথে কাটানো মুহূর্তগুলো কি তার স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠবে? কে জানে? নন্দিনী নিজের মত করে নিজের জীবন গুছিয়ে নিয়েছে শুধু অরুনের সময়ই যেন আজও থেমে আছে সে নন্দিনী চলে যাওয়ার মুহূর্তটাতে

আচ্ছা কি হবে, আজ যদি অরুন বাড়ি ফিরে না যায় আর? যদি তার জীবনটা এই খোলা আকাশের নীচে ধীরে ধীরে নিভে আসে চার দেওয়ালের গন্ডীতে কোন বিশেষ পরিচয় নিয়ে নয়, যদি এই অনন্ত বিশ্বচরাচরের মাঝে সে সেই অমোঘের বুকে মিলিয়ে যায়, কেউ জানবে না তারপরের পরিকল্পনাটা বাতিল করে অরুন রুমার বাপের বাড়ির আর্থিক অবস্থা ভাল নয় স্বামী নিরুদ্দেশ হলে লাইফ ইন্স্যুরেন্সের টাকাগুলো পাবে না সে লেখাপড়াও তো তেমন নয় যে নিজে নিজের ভরনপোষণ করতে পারবে অবশ্য বলাও যায়না, অবস্থাগতিকে হয়তো সেও স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে অরুন মরে গেলে রুমা কি করবে? ভীষণ কাঁদবে, সেটা নিশ্চিত মেয়েটা খুব ভালোবাসে তাকে নন্দিনীর মত সুন্দরী নয় সে; তার মত সুন্দর করে গুছিয়ে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেনা; তত্ত্ব, দর্শন, সাহিত্য, সমাজ, রাজনীতির খবর রাখেনা সন্ধ্যে হলেই টিভি চালিয়ে গুছিয়ে বসে বস্তাপচা বাংলা সিরিয়াল দেখে নিজেদের সাতশো স্কোয়ার ফীটের দু'কামরার সংসারেই সে সুখী হতে জানে রুমাকে দেখে মনে হয়না, ওর মধ্যে কোন অপ্রাপ্তির বেদনা আছে, কিংবা অভাববোধ অরুনের হঠাৎ মনে হয় সেও কি পারতো না এভাবেই সুখী হতে, ভালো থাকতে? খুব কঠিন হত কি সেটা? কাল যদি জীবনটা শেষ হয়ে যায়, তাহলে নিজের কাছে কি স্বান্ত্বনা রইলো তার? কার প্রতি দুঃসহ অভিমানে এতদিন ধরে তিলে তিলে নিজেকে কষ্ট দিল সে? সেই মানুষটা কি আদৌ রেখেছে তার মনের খবর? নন্দিনীর প্রতি ঘৃণা জমে জমে পাহাড় হয়ে গিয়েছে বুকের ভিতর নিতান্ত মধ্যবিত্ত হৃদপিন্ড সেই কবে থেকে বিষে নীল হয়ে আছে আজ মনে হচ্ছে যেন কানাকড়ির মূল্যে অরুন বিকিয়ে দিল তার জীবনটা


বাড়ি ফিরতে হবে যদি আজকের রাতটাই শেষ রজনী হয়, তাহলে সেটা ঘরে তার অপেক্ষায় থাকা বোকা মেয়েটারই প্রাপ্য বেশ রাতে ক্লান্ত শরীরে অবসন্ন মনে বাড়ি ফেরে অরুন রুমা এসে রোজকার মত হাত থেকে ব্যাগটা নেয় চিন্তিত মুখে জিজ্ঞাসা করে, "এত দেরি হল যে আজ? মুখটা এমন কেন লাগছে গো? শরীর কি খারাপ?"

অরুন চেয়ে দেখে তাঁর জীবনের অর্ধাঙ্গিনীর মুখের দিকে এই যে তার মুখে দুশ্চিন্তার চাপ, সহমর্মিতা, এতে এক বিন্দু খাদ নেই কোথাও হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নেয় রুমাকে বুকের ভিতর জড়িয়ে ধরে তাকে কি সুন্দর গন্ধ রুমার শরীরে, কই এত বছরে তো কোনদিন খেয়াল করেনি অরুন রুমা হয়তো একটু অবাক হয়েছে অরুন তো কখনও কোনদিন এমন করে আদর করেনি তাকে মাথার চুলে আঙুল দিয়ে বিলি কেটে নরম গলায় জিজ্ঞাসা করে, " কি হয়েছে গো তোমার? মন খারাপ?"

অরুন রুমার চুলে মুখ ডুবিয়ে বলে, " উঁহু"

কাল কি হবে অরুন জানে না কিন্তু আজকের রাতটা সম্পূর্ণ তার নিজের সারাজীবন ধরে করে চলা অজস্র ভুল হয়তো একরাতে শোধরানো যাবে না থাক ভুলেরা ভুলের মত আজ শুধু অরুন নিজের মনের কথা শুনতে চায় কান পেতে দু'চোখ মেলে দেখতে চায় মনের কোনে নিঃশব্দে লুকিয়ে থাকা সত্যগুলোকে, যেগুলো কোনদিন দেখার চেষ্টাই করেনি সে আজকের রাতটা তার নিজের থাক

মহাকাল নিষ্ঠুর প্রশাসক তার চরমতম বিদ্রূপ হল, মানুষ যে সময়কে দীর্ঘায়িত করতে চায়, তা যেন দ্বিগুন গতিতে সমাপ্তির পথে ধাবিত হয় রাতটাও ফুরোয় তাই নতুন দিন শুরু হয় অরুনের মন আজ অনেক শান্ত যে কোন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াতে সে মানসিক ভাবে প্রস্তুত স্নান করে বেরিয়ে এসে শুনলো রান্নাঘরে রুমা গুনগুন করছে কোন একটা বাংলা ছবির গানের কলি ভাঁজছে, সুরটা চেনা বাঃ, বেশ তো রুমার গানের গলা নিজের পরিনীতা স্ত্রী সম্বন্ধে না জানি কত কি জানা বাকি রয়ে গেছে আজও। আজকের আগে কখনও কি অরুন রুমার গান শুনেছে? না কি রুমাই গায়নি কখনও হয়তো একটা রাত রুমাকেও বদলে দিয়েছে

অফিসে যায় আজ অরুন যা হওয়ার সবার সামনে হলে রুমাকে একা বিপদে পড়তে হবে না কাজে মন বসানোর প্রাণপন চেষ্টা করে কিন্তু আজ জীবনে প্রথমবার বাড়ির দিকে মনটা টানছে সব ফেলে ছুটে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে রুমার কাছে বারবার মনে হচ্ছে, এখানে এখন যদি কিছু হয়ে যায়, রুমাকে আর দেখতে পাবে না অরুন কিন্তু না, দুর্বল হওয়া চলবে না অরুন তাই মাথা নীচু করে যন্ত্রের মত কাজ করে যায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও সহকর্মীদের সাথে হাসে, আড্ডা মারে, অফিসের সামনে দল বেঁধে দাঁড়িয়ে সিগারেট খায় চাপা উত্তেজনা ছাড়া শরীরে আর কোন কষ্ট বা সমস্যা টের পাচ্ছে না এখনও

দীর্ঘ দিনটাও শেষ হয় এক সময়ে সন্ধ্যে নামে ব্যাগ গুটিয়ে অফিস থেকে বার হয় অরুন বাসস্ট্যান্ডে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কি মনে করে কলেজস্ট্রীটগামি বাসে চড়ে বসে সন্ধ্যের বইপাড়ায় ভিড় কম নয় ফুটপাতে ভিড় ঠেলে এগোতে লাগলো অরুন আগেরদিন ঠিক যেখানে দেখা হয়েছিলো লোকটার সাথে, সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো পাশ দিয়ে কত লোক যাওয়া আসা করছে, কিন্তু সেই লোকটা কোথায়? আদৌ কি এখানেই থাকে? লোকটা কি সত্যিই পাগল? আজকের দিনটা কেটে গেল, অরুন তো দিব্যি বেঁচে বর্তে আছে নিজের মানসিক দুর্বলতায় নিজেরই হাসি পায় অরুনের একটা উন্মাদের কথায় গত দুটো দিন প্রতিটি মুহূর্তে মরে মরে কাটিয়েছে অরুন কবজী উল্টে হাতের ঘড়িটা দেখে সে, সাড়ে সাতটা বাজে নাঃ, এবার বাড়ি ফেরা উচিত রুমা অপেক্ষায় আছে

ফিরে আসতে গিয়ে কি মনে করে পাশের দোকানটায় গিয়ে দাঁড়ায় অরুন দোকানদার ভদ্রলোক সারাদিনের বিক্রিবাটার হিসেব মেলাচ্ছিলেন বসে অরুন গলা খাঁকারি দিতে চোখ তুললেন অরুন একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলো, "একটা পাগল মত লোক এখানে ঘোরাফেরা করে কি? দেখেছেন কখনও? গত পরশু আমার কাছে একশো টাকা চেয়েছিল তখন দেওয়া হয়নি তাই দিতে এসেছিলাম"

ভদ্রলোক চশমার কাঁচের উপর দিয়ে এমনভাবে অরুনের দিকে তাকালেন, মনে হল এরকম লোক  তিনি প্রথম দেখছেন জীবনে, যে কেউ বাস ভাড়া দিয়ে পাগলকে টাকা দিতে আসে তারপর বললেন, "রতনের কথা বলছেন? এখানেই তো ছিল একটু আগে দেখুন আশেপাশেই কোথাও হবে "

অরুন নিশ্চিত হল লোকটা এই অঞ্চলেরই স্থায়ী বাসিন্দা জিজ্ঞাসা করলো, "আচ্ছা, এই রতন কি পাগল?"

এবার দোকানদার ভদ্রলোক হাতের খাতাটা নামিয়ে রাখলেন অরুনের দিকে তাকিয়ে বললেন"ব্যাপারটা কি বলুন তো? রতনের খোঁজ করছেন হঠাৎ? তা পাগল তো বটেই আলবাত পাগল অনেক বছর ধরে এই পাড়াতেই আছে তবে শিক্ষিত পাগল শুনেছি লেখাপড়া শেখা ছেলে। এদিক ওদিক থেকে বই কুড়িয়ে ওল্টায় তো দেখি"

অরুন এবার সাহস করে বলেই ফেলে,
"আগের দিন কি সব যেন বলছিল রতন  দু'দিন নাকি সময় আছে আর কিছু বুঝলাম না"

ভদ্রলোক এবার হো হো করে হেসে ওঠেন বলেন, "এই ব্যাপার? আগে বলবেন তো মশাই রতনের এক মনের রোগ ওর রোজই মনে হয় আর দু'দিন পর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে সবাইকে বলে বেড়ায় এই চত্ত্বরে সবাই জানে কেউ পাত্তা দেয় না"

বাসটা সিগনালে দাঁড়িয়ে আছে মিনিট পাঁচেক  অরুন সীটে হেলান দিয়ে চোখটা বুজল হালকা লাগছে খুব জীবনের সব অপ্রাপ্তির মাঝেও এই ছোট ছোট পাওয়াগুলো নিয়েও বেঁচে থাকা কত মধুর সব চাওয়া হয়তো পাওয়া হয়ে ওঠে না, জীবন বয়ে চলে নিজের শর্তে অরুন আজ পাগলটার কাছে কৃতজ্ঞ সেই তো তাকে চোখে আঙুল দিয়ে তার প্রাপ্তিগুলোকে দেখিয়ে দিয়েছে আজ অরুন খুঁজে পায়নি রতনকে আরেকদিন এসে ওকে টাকাটা দিয়ে যাবে বাসটা খুব ধীরে হেলেদুলে চলছে রাস্তায় বেশ ভিড় আজ বড্ড দেরি হচ্ছে রুমা অপেক্ষা করছে তার ঘরে ফেরার আজ প্রথমবার অরুন ঘরে ফেরার ব্যাকুলতা অনুভব করছে

"এই যে দাদা, টাকাটা দিলেন না তো"

চোখ খুলে তাকাল অরুন পাশে বসা লোকটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার দিকে চোখদুটো যেন অস্বাভাবিক জ্বলজ্বলে

"আমায় বলছেন?" জিজ্ঞাসা করল অরুন

লোকটা হাসল দাঁতগুলো সূচোলো মতন লোকটার
"টাকাটা দিলেন না? একশো টাকা?"

অরুন তাকিয়ে রইল লোকটার দিকে বাসের আলোটা যেন কমে আসছে ধীরে ধীরে আশেপাশে সব কেমন অস্পষ্ট ছায়া ছায়া বোধ হচ্ছে ঘন অন্ধকার কুয়াশার মধ্যে ডুবে যাচ্ছে অরুনের অনুভূতিময় পার্থিব জগত রুমার মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে কী অসম্ভব তীব্র দৃষ্টি রুমার, অদ্ভুত সূচোলো দাঁত উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে অরুন ভিড় ঠেলে টলতে টলতে এগোয় দরজার দিকে সিগনাল ছেড়ে দিয়েছে বাসটা, যেন অসম্ভব দ্রুতগতিতে উড়ে চলেছে অরুনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরছে তীক্ষ্ণ দাঁত আর জ্বলজ্বলে চোখওয়ালা একঝাক মানুষ

"নামব আমি নামব দাঁড় করান গাড়ি" অরুনের কথাগুলি তার নিজের কানেই আর্তনাদের মতন শোনায় কন্ডাক্টর বিরক্ত মুখে ঘুরে তাকাল তার দিকে বাসের আলোটা দপ করে নিভে যাওয়ার আগে অরুন স্পষ্ট দেখে, কন্ডাক্টরের চোখদুটো জ্বলছে, সেই একইরকম সূচোলো দাঁত লাফিয়ে পড়ল অরুন চলন্ত বাস থেকে পড়ে যাওয়ার আগ-মুহুর্তে দরজার কাচে নিজের তীব্র জ্বলন্ত চোখদুটো ভগ্নাংশ মুহুর্তের জন্য চোখে পড়ল অরুনের, চোখদুটি কী তীব্র হননেচ্ছা নিয়ে গিলতে আসছে তার সমগ্র অস্তিত্বকে

সমবেত "গেল, গেল" চিৎকারে ড্রাইভার  সামান্য এগিয়ে সজোরে ব্রেক কষল ভর সন্ধ্যেবেলায় কলকাতার জনবহুল রাস্তায় এমন দুর্ঘটনা, লোক জমে যেতে সময় লাগল না বিশেষ বাসের যাত্রীরাও নেমে এসেছে অফিস ছুটির সময়, সবারই বাড়ি ফেরার তাড়া তবু একঝলক উঁকি মেরে দেখার আগ্রহ ছাড়তে পারেনা কেউই অরুনের শরীরটা বাসের পেছনের চাকার সাথে জড়িয়ে গেছে রক্তে ভেসে যাচ্ছে রাস্তা অরুনের বিস্ফারিত দৃষ্টি আকাশের দিকে, হাতের মুঠিতে ধরা একটা রক্তমাখা একশো টাকার নোট

Comments