গল্প - চন্দ্রাবলী বন্দ্যোপাধ্যায়



সবার নিচে আসন পাতা


ঘরের আসবাব বলতে একটা তক্তাপোষ, যার উপরে অনেককাল আগের একটা তোষক, তার উপরে জরাজীর্ণ চাদর,বালিশ, একটা ঝোলা। সব কটাই ময়লার আস্তরণ খেতে খেতে নিজেদের রঙ হারিয়েছে।

তার পিছনের নোনা ধরা একটা দেওয়াল । কিছুক্ষণ চেয়ে দেখলে মনে হয় সমুদ্র সৈকতে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ।

আর একপাশের দেওয়ালে বেশ কয়েকটি পেরেক পোঁতা। পেরেকের চারিদিকে অর্ধচন্দ্রাকৃতি দাগ। হয়তো ক্যালেন্ডার দুলে দুলে তার সীমানার প্রতিচ্ছবি রেখে গেছে।

তার নিচে একটা টেবিলের উপস্থিতি আন্দাজ করা যায়। কারণ জিনিসপত্র দেখে বোঝা যায়, সেগুলো টেবিল জাতীয় কিছুর উপর রাখা আছে। কিন্তু জিনিসের ভারে টেবিল বেচারা অদৃশ্য। কি নেই তাতে!! অজস্র পুরোনো পেপার, বই, চামচ, ওষুধের রাংতা, একপাশে ঝোলানো গামছা, বিবর্ণ হয়ে যাওয়া জলের বোতল, কলপের শিশি, আর অজস্র পেন। বেশির ভাগ পেনেরই অর্ধেক শরীর বিলুপ্ত। আর এক পাশে ডাই করা প্লাস্টিকের প্যাকেটে পাণ্ডুলিপি।

এই সবের একচ্ছত্র মালিকানা যার, তাকে আমরা কবি বা লেখক আখ্যা দিতে পারিনা। কারণ সে যতই মহাভারত, রামায়ণ রচনা করুক না কেন, প্রকাশক স্বীকৃতি না দিলে সে কিসের কবি?!

আর একপাশের দেওয়ালে একটা দড়ি, এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত কোনো রকমে অস্তিত্ব রেখে টিকে আছে। ত্রাহি ত্রাহি প্রাণ নিয়ে, যাবতীয় জামাকাপড় নিয়ে ঝুলে আছে। তাকে একসাথে আনলা ও আলমারির দায়িত্ব বহন করতে হচ্ছে।

অন্যপাশের দেওয়াল একেবারে উন্মুক্ত না, তার নিচের দিকে দেখলে মনে হবে কোনো ভাঙারির গোডাউন। শুধু এক চিলতে মেঝে ক্ষমা পেয়েছে হাঁটাচলা করার জন্য।

তারপর দরজা। বন্ধ দরজার গায়ে আঠা, সেলোটেপ দিয়ে সাঁটা রয়েছে কিছু দেব দেবীর ছবি। এক কোণে ধূপকাঠি গোঁজার জায়গাও আছে। 

এই ঘরের পঞ্চাশোর্ধ অধিপতিকে নবীন মুর্মু নামেই চেনে সকলে। এক কালের স্কলার স্টুডেন্ট। দুর্মুখেরা অবশ্য অন্য কথা বলে। বলে সরকারি কোটায় নাকি সব পেয়েছে। তাই তার কবিতা বা গল্প লেখার যোগ্যতা নেই। অগত্যা অবহেলিত নবীন, তার সমস্ত পাণ্ডুলিপি  প্লাস্টিক বন্দী করে রেখেছে। রেখেছে বুকের অনুভুতি টুকুও।

Comments