গদ্য - দীপ্তি রায়


পথ, জীবন ও আমি


আমি কে?

কেন এসেছি?

কোথায় যাব? 

কিসের নেশায় এই অনন্ত পথচলা?


এই প্রশ্ন আমাকে সারাজীবন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেতেই একদিন পথ চলতে শুরু করি।


জানি না পথের শেষ কোথায়? শেষ গন্তব্যে পৌছতে পারব কিনা তাও জানি না। তবুও হেঁটে চলেছি ...


এই অনন্ত পথ চলায় এটুকু বুঝেছি জীবনের এই চলার পথে সুখ -দু:খ, আনন্দ-বেদনা এসবের মধ্যে দিয়েই পথ চলতে হয়। আর এসবের মধ্যেও কিছু না কিছু পাওয়া তো আছেই।


একজন মানুষকে  জীবনের পথ একাই চলতে হয়। সেই পথ সোজা না বক্র! সেটা সে চলতে চলতেই বুঝে যায়। ছোটোবেলায় গুরুজনরা পথপ্রদর্শকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। তারা বলে দিয়েছিলেন এটা তোমার পথ!এগিয়ে চলো। যেদিন থেকে পিতা, মাতার, আত্মীয় স্বজনের হাত ছেড়ে দিয়ে টলমল পায়ে হাঁটতে শিখলাম, ঠিক সেদিন থেকে আমি হেঁটেই চলেছি...


জানিনা এই পথ চলা ঠিক না ভুল! তবে আমি হাঁটছি...  জানি জীবনের পথ চলায় একদিন হাঁটা থেমে যাবে। জানি জীবন সর্বদা অনিশ্চিত! তাই বলে থেমে থাকলে তো চলবে না। আজ আমাকে হয়তো দু:খের সাগর পাড়ি দিতে হচ্ছে, তাই বলে কালও যে আমাকে এটাই করতে হবে, তা কিন্তু নয়। আমি জানি জীবন মাঝে মাঝে মানুষকে সারপ্রাইজ দিতে পছন্দ করে। জীবন হয়তো আমার জন্য আগামী দিনে কোন আনন্দ উপহার সাজিয়ে বসে রয়েছে। আগামীর সেই উপহারকে গ্রহণ না করে আজ আমি কেন আমার জীবনকে কলুষিত করে তুলবো? তাই জীবনে এগিয়ে চলাই আমার কাছে বেঁচে থাকা আর থেমে যাওয়া মানে মৃত্যু।


নিজের পথ নিজেকেই চলতে হয়। অনেকেই হয়তো আমাকে দারুণ পছন্দ করে কিন্তু দিনশেষে  আমি জানি আমার পথটা আমাকেই অতিক্রম করতে হবে। আমি জানি প্রত্যেক মানুষের এগিয়ে চলার গল্প,কষ্টের গল্প ভিন্ন।আমার গল্পটাও আলাদা। আমাকে কেউ এগিয়ে নিয়ে যাবে, তাই ভেবে আমি কখনোই বসে থাকি না। জানি পথ একটাই। ধরে নিলাম সেটা একেবারেই সোজা, লম্বা, শেষে দিগন্তে মিশেছে। বিশ্বাস করি সেই দিগন্তে একদিন আমিও মিশে যাব।


জীবনের চলার পথের সাথে পাহাড়ি পথে চলার বড্ড মিল খুঁজে পেয়েছি। জীবনের এই পথের মতো পাহাড়ি পথও আমাকে বড্ড টানে। পাহাড়ি পথে হাঁটতে গিয়ে কতবার হোঁচট খেয়েছি! কখনও ঋজু মসৃন পথে হেঁটে বেড়িয়েছি। গন্তব্যে পৌঁছেই অপার্থিব দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি! পথের কষ্টটুকু বাদ দিলে আনন্দের ভাগটাই যে বেশি! সে যে কি অপার আনন্দ বলে বোঝাতে পারব না। পেরিয়ে আসতে পারার স্বস্তি। নিজেকে অতিক্রম করার আনন্দ। সাধারণ মানুষের কাছে যা কষ্ট একজন পর্বত আরোহীর কাছে তা আনন্দের। তাতেই তাঁর নেশা।


জীবনে চলার পথে দুপাশ থেকে অনেক সম্পর্ক এসে জড়িয়ে ধরেছে। জীবনের শুরুতেই মা-বাবাকে নিয়ে একটু এগোলাম.. তারপরেই এলেন গুরু.. এগোলাম  এলো একপাশে  ভাই আর একপাশে দিদি ও বোন... এগোচ্ছি আরো কিছু  প্রিয়-অপ্রিয় আত্মীয়, স্বজন... বন্ধুবান্ধব, ছাত্রছাত্রী.... স্বামী... ভালোবাসা। সব সম্পর্ক গুলোকে কিন্তু ধারণ করে চলেছি। এ এক আশ্চর্য অনুভূতি! বোধ মিশে যাচ্ছে সম্পর্কে। আমার পাশে পাশে যারা হেঁটে চলছিল..একে একে সরে গেছে কতজন!  আবার রয়েও গেছে কেউ কেউ।  সমুদ্রে  আনমনে ঝিনুক কুড়োনোর মতো সম্পর্ক গুলোর কোনটার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলেছি, কোনোটাকে দেখে মুহূর্তে চমকে গেছি! কোনোটাকে ঝোলায় ভরে নিয়েছি। এই ঝিনুক কুড়োতে গিয়ে কতবার যে রক্তপাত ঘটেছে তবুও কুড়োবার নেশা কাটেনি। মুক্তো পাওয়া কি অতই সহজ! জীবন প্রান্তে এসে দেখি সেই অকিঞ্চিৎকর সঞ্চয়গুলোই ঝোলাতে এক একটা মুক্ত হয়ে ঝলমল করছে। সেই সম্পর্কগুলো আমার কাছে বড্ড দামি।


পথের দুধারের কাটা -ঝোপ, খালা-খন্দ, চড়াই -উৎরাই,  পেরিয়ে পরশ পাথর খুঁজতে খুঁজতে  শুধুই এগিয়ে চলেছি...। পথের শেষ কোথায় জানা নেই। সঞ্চয়ের ঝোলা কতটা ভরবে তাও জানি না। শুধু জানি চলতে হবে। একবার চেরাপুঞ্জিতে 'Dubble Decke Living Root Bridge' তিন হাজার সিঁড়ি  ভেঙে যখন উঠছি! ব্যাগের সামান্য ভারী বোঝাটাও  ভীষণ ভারী লাগছিল ! একে একে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হালকা হয়েছিলাম, সেদিন  কানে  ভেসে আসছিল  রবিঠাকুরের কথা  "এ বোঝা আমার নামাও বন্ধু, নামাও.. / ভাবের বেগেতে চলেছি কোথায়, /এ যাত্রা তুমি থামাও। " হালকা হয়ে হাঁটার আনন্দই আলাদা। জীবনের পথ চলার ক্ষেত্রেও তাই। 


আজও মাঝে মাঝে পথ চলতে চলতে হোঁচট খাই। নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে যায় চলার পথ। পরক্ষনেই দেখতে পাই আমার জ্য্যোতির্ময়  দিশারি, দু:সময়ের সান্ত্বনার অশেষ সুধা যিনি আমায় প্রতিনিয়ত  দেন! আমার সকল শ্রেষ্ঠ, আমার সকল সুখের উৎস রবিঠাকুর পাশে এসে দাঁড়ান। আবার চলতে শুরু করি। আর মনে মনে বলি ...


           "ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,

            পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু। 

               .................................. 

              এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,

             পিছন পানে তাকাই যদি কভু

              ......................................

              সেই ম্লানতা ক্ষমা করো, ক্ষমা করো,

             ক্ষমা করো প্রভু।।"

Comments