গদ্য - প্রণব চক্রবর্তী


যাদুবাস্তব চিলেকুঠুরী 


বস্তুত হারানোই যখন অপ্রতিরোধ্য অভিজ্ঞান, পাওয়ার অভিপ্রায়টিও যে অনিশ্চিত এবং ভঙ্গুরতায় ধূসর হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলো অভিষিক্তা। বিকেলের ক্লান্ত রোদে চিলেকোঠার হলুদ অবসরে যেদিন তার যৌন সিন্দুকে  নিলীমের সুতীব্র প্রবেশ তাকে রক্তাক্ত করেছিলো, সেদিনই বর্ষণের সান্ধ্য উপলে ছাদজুড়ে তাথৈ নেচেছিল তার ক্ষুধার্ত পেখম। আকাশ জলে পরিস্নাতা অভিষিক্তা প্রথম জেনেছিলো পাপ মানুষের এক পবিত্র অধিকার।

    

পরবর্তী জাগরণের আগেই নিলীম আরও গভীর কোনো নীল কুয়াশার দিগন্তলুপ্ত নৌকোভ্রমণে তুলে নিয়েছিলো অরাত্রিকার উষ্ণ আভিজাত্য। অভিষিক্তা কাঁপেনি সে আরোগ্য বার্তায় বরং দুহাতে মেহেন্দীর আলপনা গেঁথে ঘোরলাগা রাত্রির আগে ফিরে এসে বসেছিলো চিলেকোঠার নিঝুম অন্ধকারে যেখান থেকে পাশের জানালাদের অনন্ত তারা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া যায়। অভিষিক্তা ঘুমোয়নি বরং নিজস্ব সুড়ঙ্গ ছুঁয়ে প্রলুব্ধ তানপুরা হয়ে যখন সে উল্লসিতা, সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো আকাশদীর্ঘ এক নগ্ন পুরুষ সারা শরীরজুড়ে ঘন হয়ে জড়িয়ে আছে অন্ধকার, অন্ধকারের সেই উন্মুক্ত উত্থিত পুরুষ-শলাকায় বিদ্ধ তার জানুসন্ধি, পিছল প্রস্তাবনা উপেক্ষা করেই সে অন্ধকার পুরুষ-বাহুতে বাঁধনের যে নিষ্ঠুর আয়োজন তাকে বাক্যহীন করে দিয়ে গেছে, নিলীম যেন শিশু সেই অবগাহনের বন্য শিহরণে!... অভিষিক্তা যেন এও প্রথম জানলো, মৈথুনের তীব্রতাই পুরুষ আধিপত্যকে নস্ম্যাৎ করবার প্রাথমিক বিদ্রোহ। 

 

যেদিন চাঁদ ওঠে সে আর তারপর থেকে কখনও চাঁদের পথে বেড়াতে যায়না, খোঁজে না নিশ্চিত কোনো চিলেকুঠুরীর আঁধার। বরং চারদিক ভেসে যাওয়া রূপালী আলোর উদলা ক্যানভাস থেকে সাঁতরে এসে যে অন্ধকার পুরুষ তার হাত ধরে, তাকেই সে ধারণ করে আপন গহ্বরে। স্ট্র্যাপ খুলে যাবতীয় অন্তর্বাস থেকে মুক্ত করে কাঁপন ও অনুশাসন। সে জেনে গেছে নৈসর্গিক এই বিমূর্ত পুরুষই তার প্রথম প্রয়োজন যে তাকে একা এই জীবন ও জগতের অনুশৃঙ্খল তছনছ কোরে নির্ভয় দাঁড়াবার সাহস জোগাতে পারে লোভ, হিংসা ও অবিশ্বাসের সদা ঘূর্ণায়মান এই গোলকের পিঠে মানুষের পরিচয় নিয়েই। আ-আকাশ নগ্ন সেই আঁধার পুরুষের পায়ে ভূগোল উধাও, দিক অবলুপ্ত, সময় অসহায় স্রোত-যাপনে! তন্তুহীন, নিরাভরণ অভিষিক্তাও যেন এক দোদুল নৌকাভাসান, বৈঠা ধরেছে যেন বিমূর্ত আঁধার যাকে সে চিনেছে এক পুরুষ প্রতীকে! গোপন অক্ষর দিয়ে লিখে রাখে গাছের বাকলে-- নারী যদি সমর্পিতা হবে তুমি ভাবো, সে তবে মহাজীবনের কাছে, পীড়নের বাসর সাজানো ফুলতামাশার সংরক্ষিত খোপ খাপের চৌহদ্দী মেপে নয়। দিগন্তবিস্তৃত খোলা হাওয়ার আয়োজনে সে মুখ দেখবে তার আত্মার আত্মীয়র, পাঁপড়ি দলিয়ে যাবে আকাশ দোলানো মুক্ত অহঙ্কার শিকল-খেলা যার প্রিয় অভিপ্রায়, শৃঙ্খল যার সজ্জা, শিকল তাকে আটকায় না শিকলকে সে বন্দী রাখে ভাঙবে বলেই।... 

 

অন্যদিকে, এ গল্পের শুরুর নিলীম অভিষিক্তা, অরাত্রিকা পেরিয়ে আরও কোনও ঘননীল কুয়াশা সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে ক্রমেই ফিকে হতে হতে ক্রমেই বিলীনতার দিকে চলে যায় সৌখীন উত্তরীয়... 

Comments