গদ্য - বাবলি সূত্রধর সাহা


মনের ঘর 


"তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা, মন জাননা " ---- সত্যি মনের ঘরে কে যে থাকে আর কে নয় তা বোধহয় কোন মানুষই জানতে পারেনি আজ পর্যন্ত। সেই যে কত বছর আগে শ্রাবণেই ফুটেছিল অনাঘ্রাত শিউলি, আমাদের মাটির বাড়িতে সে বার হাঁটুজল হয়েছিল। জলের তলা দিয়ে কত ছোট মাছ, কেঁচো,আরও কত পোকামাকড় দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছিল পেছনের মজা পুকুরের দিকে। আমি আর আমার বোন ( বনি)  ভয়ে ভয়ে পা ফেলে কুয়োর দিকে যাচ্ছিলাম জল তুলতে। ঠিক তখনই দেখলাম ছোট্ট শিউলি গাছটায় একটাই ফুল ফুটে লাজুক ভীরু চোখে তাকিয়ে আছে আমার মনে তখন অপার বিস্ময়!  আর বনি বলছে, দ্যাখ দিদি এখন তো শরৎ নয় তবে কেন ফুটল শিউলি!  উত্তরে বলেছিলাম 'কে জানে রে!' প্রকৃতির মনেই বা কি আছে!  আর বিধাতার মনে কি আছে আমরা জানিনা৷ পাশে বসে থাকা, শুযে থাকা এবং, দুঃখ ভাগ করে নেওয়া আমার ছোট বোনটা বাস্তব ছেড়ে, চাঁদের আলোর দেশে চলে যাবে। ওর পাশে বসেই কবিতা লিখতাম৷ আর ও বীরাঙ্গনা পড়ত। জনা, তারা, রুক্মিণীদের ছোঁয়ার চেষ্টা করত। খুব স্পষ্ট উচ্চারণে রিডিং পড়ত। দুচোখে আলো সাজিয়ে বসে থাকত চারপাশ আলোকিত করবে বলে অলৌকিক মায়া, বিষাদগ্রস্ত বর্ষার রাতে ঘরের চাল দিয়ে জল পড়লে আমরা উঠে বালতি কিংবা গামলা দিয়ে রাখতাম। লোনা জল আর আকাশের জল একাকার হয়ে মনের গভীরে কুলকুল করে বয়ে যেত। তবু সে ছিল পাশটিতে। বলত, 'দিদি শুয় পড়। কালকে লিখিস, তোর মনেই তো সাজানো আছে সব'।  মনে মনে বলতাম, কার মনে যে কি আছে সে তুমিই জান ঈশ্বর। 


ছন্দে, বর্ণে, গন্ধে নির্মাণ করে যাই কবিতা, শুদ্ধ হই, পবিত্র হই। ছাঁচে ঢেলে সাজাতে পারলেই একেবারে ছক্কা। না হলে সন্তুষ্টি আসেনা৷ ছুঁতে পারিনা কবিতাকে। "তারে ধরি ধরি মনে করি, ধরতে গেলেম আর পেলেমনা"... তরুণী বেলায় কোন এক অবসন্ন দুপুরে একটা পেন্সিল দিয়ে কয়েকটা শব্দ সাজালাম। বেশ কিছু লাইন হয়ে একটা অবয়ব হয়ে গেল কবিতার। তখনও বুঝিনি কবিতার নির্মাণ, ভাঙা গড়া, কৌশল, ম্যাজিক জন্ম অথবা মৃত্যু। এখনও বুঝে উঠতে পারিনি কবিতার ঘর কোথায়!  মনে, মাথায় নাকি ডাইমেনশনহীন অতলান্তে। যার কোন কূল নেই, কিনারাও নেই৷ "আমায় ডুবাইলি রে.....  আমায় ভাসাইলি রে......."


নদীজল মায়া জাগায় আবার মোহ সৃষ্টি করে। যেমন প্রথম ট্রেনে চড়ে ব্রহ্মপুত্র পাড় হওয়ার সময় বনি চিৎকার করে বলেছিল নদীর জল......  নদীর জল!  হারিয়ে গেল সেই নদীতেই ওর নাভিপদ্ম। ওর সাধের সংসার। রইল পড়ে বিবর্ণ স্মৃতির নুড়ি পাথর। 


মনের ঘরে বসত করে অন্তহীন চরাচর। বসত করে কবিতার চকমকি আলেয়া আর আমার বোনের  অসহায় মুখ৷ আমার দ্বিতীয় সংসার কবিতা৷ যে সংসারে জটিলতা নেই,অশান্তি নেই। রান্নাবান্না নেই৷ শুধু আছে শব্দের সাথে মনের মায়াজাল বিস্তার। অনুভূতির রেশমি পরশ৷ অনাঘ্রাত শিউলির মতো লাজুক ভীরু চোখের দৃষ্টি আমার দেখে যাবে মৃত্যু পর্যন্ত। মনের দৃষ্টি না বাড়ালে কখনই চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়না। তাই বুঝি লিখতে পারি "তোমাকে দেখার মতো স্বচ্ছ অন্তর্দৃষ্টি নেই"। হে ঈশ্বর, তোমাকে দেখি কবিতায়, তোমাকে দেখি আত্মজর চোখে আর মা হারা একরত্তি ছেলেটার মুখে। কবিতাকে ছুঁয়ে থাকি মনের ঘরেতে। আর মন ছুঁয়ে থাকে একজন, যে বলে "তোর মনেই  তো সাজানো গোছানো আছে সব। কালকে লিখিস "। কাল তো মিশে যায় কালের গর্ভেই। মনের সাথে তার কিই বা লেনাদেনা।

Comments

  1. দারুন লিখেছো দিদি , ভাবাবেগ আর বিষাদ মিলেমিশে শিউলি হয়েই ঝরে যায় কালের নিয়মে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবা। ভালোবাসা

      Delete
    2. আন্তরিক ধন্যবাদ । শুভেচ্ছা রইল ।

      Delete

Post a Comment