গদ্য - অর্ঘ্য দে


হায়াত মিঞার এসরাজ ও হিজলের আসর 

   

মন খারাপ হলেই পালিয়ে আসি হিজল গাছের কাছে। বিষণ্ণ দিন আর মনখারাপের বিপ্রতীপে যেন হিজল বিছিয়ে রেখেছে ছায়া। পাশ দিয়ে অবিরাম বয়ে চলা নয়ানজুলি যেন জীবনের সমাকৃতি। গাছের তলায় সকাল সকাল ঝরে গেছে লাল-গোলাপি হিজলের ফুল। যেন কেউ কারপেট পেতে রেখেছে। হায়াত মিঞা বসে এসরাজ বাজাচ্ছে। হায়াত মিঞা যখন চারটে তারের ওপর ছড় টানে তখন অদ্ভুত এক সুরের গমকে আন্দোলিত হয় দিকচক্রবাল। অবেলায় খোলা হারমোনিয়াম খাটে রেখে ছুটে এসেছি কতবার। সুরের সন্ধানে। দু’হাত ভরে নিয়ে গেছি কড়ি-কোমল। অবেলা কিংবা কালবেলায় হায়াত মিঞার এসরাজ আমার চিরআশ্রয়। কখন যেন নিজের অজান্তেই গেয়ে উঠি —


“চিরবন্ধু চিরনির্ভর চিরশান্তি

              তুমি হে প্রভু--

তুমি চিরমঙ্গল সখা হে  তোমার জগতে,

              চিরসঙ্গী চিরজীবনে”


সংক্রান্তির দিন বাউল আসে। গুবগুবি বাজিয়ে গান ধরে। মাটির গান এসরাজের সুরের সঙ্গে মিলেমিশে সৃষ্টি করে অদ্ভুত এক মাদকতার। নয়ানজুলির পাশে হিজলের ছায়ায় এসেছে ডাহুক শিকারে ক্লান্ত লক্ষ্যভ্রষ্ট শিকারিশাপলা দিঘিতে কোঁচ দিয়ে যে ছেলেটা মাছ ধরছিল সেও এসেছে। নয়ানজুলির স্রোতে ঘুণি ভেসে থাকে। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল। ভিড়ের মধ্যে মিশে আছে মাতাল বরযে রোজ রাতে বাড়ি ফিরে বউকে মারে। আজ রাতে হয়তো সেও হয়তো ভুলে যাবে কোমরের বেল্ট খুলতে। বউ পেটানো বরচোরা শিকারিমাছশিকারি সবাই সুরের অতলে ডুব দিতে চায়।  সবাই কী আর পারে? পারে না! কবেকার জং ধরা ভটভটি গাড়ি চালিয়ে আসে ঝন্টু, বোঝাই করে অন্ধকার, বিষণ্ণতা.... মফস্‌সলের যাবতীয় বর্জ্য। ধানের গোলার বুড়ো পাহারাদারের চোখে তখনও ভোরের কুয়াশা। লাঠির ওপর ভরে দিয়ে সে খাণিক ঝিমিয়ে নেয়। বোবা রাখাল ঘুরে ঘুরে নাচতে থাকে। এদিক ওদিক থেকে আরও কিছু মানুষ জুটে যায়। ওদের দেখে মনে হয় সবাই যেন ঘরভোলা, আত্মভোলা। সুরসপ্তক ধরে হেঁটে আসা ভিক্ষুক। ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার বা পঞ্চমের মাধুকরী নিয়ে চলে যাবে।  


হায়াত মিঞা যখন বৃন্দাবনী সারং বাজায় তখন জ্যৈষ্ঠে যেন ফাল্গুনের ছোঁয়া লাগে। শুনতে শুনতে আমার ভিতর মূর্ত হয় রাইজন্ম, জন্মান্তরের অভিসার। হিজল ফুলের ঝালরে আমার বাসর সেজে ওঠে। গলায় সাজিয়ে ফেলি সরগম। কিন্তু আমার সেই অনুরাগের স্তর ছিন্ন করে অনভিপ্রেতভাবে বেরিয়ে আসে জোকার। এক ঝাঁক বাদুড় উড়িয়ে চলে যায়। অন্ধ বাদুড়ের ডানায় দেখতে পাই তোমাদের সেই ভিজে, স্যাঁতসেঁতে গন্ধের অন্ধকারাচ্ছন্ন চামচিকির গলি। আমি ভয়ে, ঘেন্নায় এসরাজের তারগুলোকে আঁকড়ে ধরতে চেষ্টা করি। আমার গা ঘিনঘিন করে। ঝনাৎ করে তার ছিঁড়ে যায়, সুর কেটে যায়। হাতের রেখা উপরেখায় ফুটে ওঠে রক্তের রেখা। হাতের তালুতে বইতে থাকে। তুমি টুকরো টুকরো কাগজে ঈশ্বরের নাম লিখতে থাক। দিন জেগেরাত জেগে। কাগজের টুকরোগুলো সেই রুধির ধারায় ভাসিয়ে দিলে আমার আরোগ্য কামনায়। রক্তের লবণহ্রদের নাব্যতায় কাগজের টুকরোগুলো খেয়ার মতো ভেসে থাকে। 

Comments