অনুবাদ গল্প - বাংলা অনুবাদ :: অলোক সাহা



উঠোন


অসমীয়া ভাষায় মূল রচনাঃ

মীনাক্ষি বুঢ়াগোঁহাই



    মাটির স্পর্শ আর রোদের কিরণ না পেলেও তার শরীর চিতার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। তার মৃত শরীর বিছানা থেকে তুলে ভাড়া করে আনা স্বর্গরথে নিয়ে বসানো হল।  সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা শরীরটা আশেপাশের উঁচু উঁচু বাড়িগুলোর কারণে কখনই রোদের কিরণ স্পর্শ করতে পারেনি। যদিও আকাশটা ফর্সাই ছিল। ব্যালকনি থেকে তার রথযাত্রা দেখে তার বউমা রিয়া একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সকালের পরিষ্কার আকাশটার মতই ভারশূন্য হয়ে উঠলো তার মন। কাজের মাসিকে নিয়ে শাশুড়ির থাকার ঘরটা পরিষ্কার  করবার জন্য দৌরঝাঁপ শুরু করলো। এই ঘরখানাতে কি কি জিনিস রাখা যাবে বহুদিন আগের থেকেই রিয়া তার পরিকল্পনা করে রেখেছিল।


    ভাড়া করে আনা স্বর্গরথে উঠে পরা সদ্যমৃতা মানুষটির নাম নন্দিতা বরুয়া। প্রয়াত গৌতম বরুয়ার পত্নী। গৌতম বরুয়া কোন বিশিষ্ট বাক্তি ছিলেন না। নন্দিতাও না। তাই একেবারে সাধারণ তার এই শেষ যাত্রা। পরিবার, পরিজন, আত্মীয়স্বজন নির্দিষ্ট কয়েকজন মানুষ পরিবেষ্টিত এই শোভাযাত্রায় তার মরদেহের ওপরে নেই কোন ফুলের মালা। কিন্তু সে এক সময় একজন আধুনিকা নববধূ ছিল। শুধু তাই নয়, ছিল একজন শিক্ষিতা, সুন্দরী যুবতী। কিন্তু তার বৌমা রিয়া ভরদ্বাজ কোন ভাবেই কল্পনা করতে পারে না যে তার শাশুড়ি কখনও একজন সুন্দরী এবং আধুনিকা ছিল। অবশ্য শুধু রিয়াই  নয়, অনেকেই ভুলে যায় যে একটা মৃত শরীরেরও এক বর্ণময় অতীত থাকে।


    বহু বছর আগে নন্দিতা তো তাই ছিল। ছোটবেলায় নন্দিতা এবং তার ভাই একটি বাঁশের কঞ্চির মাথায় সুতো বেঁধে উঠোন জুড়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। তারা উঠোনপোকা ধরার  খেলা করতো। বড় অদ্ভুত ছিল সেই খেলা। মাটির উঠোনের মাঝে মাঝে সরু সরু গর্ত দেখা যায়। সরু একটি কাঠি দিয়ে সেই ফুটো গুলোতে সুতো ঢুকিয়ে দিলে খুব ছোট কেঁচোর মতো এক ধরণের পোকা সুতো গুলোর মাথায় কামড়ে ধরতো। তখন বড়শী টানার মতো সেই সুতোটি ধরে টান মারলে পোকাটি গর্ত থেকে বেরিয়ে আসতো এবং অল্প পরেই মরে যেত। এই পোকাগুলো নাকি যারা জুতো না পরে হাঁটে, তাদের পায়ের তলা খেয়ে খেয়ে ফুটো করে ফেলে। মায়ের পায়ের তলায় এই রকম ছোট ছোট ফুটো আছে সে দেখেছে। ফলে সে পা থেকে কখনই চপ্পল জোড়া খুলত না। উঠোনপোকায় পায়ের তলা খাবার ভয়, জলে ভেজা পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে হাজা হবার ভয় -- ইত্যাদি ভয় তাকে শৈশব থেকে কৈশোরে পদার্পণ করার পরে তাকে একটি অলস বালিকায় পরিণত করলো। ভাইয়ের সাথে বাড়ির গাছের পাকা আম কুড়িয়ে খাওয়া, টোপাকুলের জন্যে ঝগড়া করা, পুকুরে গিয়ে জল ছিটিয়ে স্নান করা -- এই সব কাজ সে খুব ছোটবেলাতেই ছেড়ে দিয়েছিল।


     সেই ছোটবেলা থেকে নন্দিতা এই ভাবে একটা দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করে এসেছে। নন্দিতা শইকিয়া নামের যুবতীটি একদিন নন্দিতা বরুয়া হয়ে আর একটা দীর্ঘ পথ পরিক্রমা শুরু করেছিল। জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথম রাতে বিছানার কাছে গিয়ে যখন পরম আকাঙ্খিত মুহূর্তটুকুর জন্যে গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল, ঠিক তখনি তার দ্বিতীয় ননদ, ভারতী, তার ঘুরে ঢুকে এলো। ভারতী সর্ব শরীর একটা বিশেষ ভঙ্গিতে নাচিয়ে, মুখ খানা বিদারিত করে তাকে বললোকালকে  বাড়ির মানুষজন ওঠার আগেই উঠোন, ঘর ঝাড়ু দেওয়া সেরে স্নান করে নেবে।ভারতীর ভাবভঙ্গি এবং আদেশ নন্দিতার মনে যে বিরাগটি জাগিয়ে তুললো, মৃত্যু সময় পর্যন্ত তার হৃদয় থেকে সেই বিরাগ যে অপনীত হয়েছিল, তা বলতে পারি না। নন্দিতার প্রথম সন্তান প্রসবের সময় নন্দিতাকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। সে কারণেও ভারতী তার ওপর অকথ্য ভাষায় গালি বর্ষণ করেছিল। ফলে ভারতীর ওপর তার বিরাগ দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।-আনন্দঅর্থাৎ যে কখনও আনন্দ দিতে পারে না, তাকেই ননদ বা ননন্দ বলা হয়। এই কথাটির সত্যতা যেন ভারতী সেই দিন প্রমাণ করে ছাড়লো।


    বিবাহ রাত্রির বিনিদ্র রাত আর ফুলশয্যার অর্ধনিশি জাগরণের পরে সে শারীরিক ভাবে খুব দুর্বলতা অনুভব করে। তবুও বিরাট উঠোনটা ঝাঁট না দিয়ে উপায় নেই। ঝাঁট তাকে দিতেই হবে। দিচ্ছিলও। তখনই পিছন থেকে শাশুড়ির গলা শুনতে পায় –“আঁচলটা মাথায় তুলে নাও বৌমা। সামনের রাস্তা দিয়ে কত সাধু গুরু বৈষ্ণব চলাচল করে।"


    নন্দিতার ইচ্ছে করছিল ঝাড়ুখানা ছুড়ে ফেলে দিয়ে দৌড়ে ঘরের ভিতর ঢুকে যায়। কিন্তু তা সে করলো না। নন্দিতার হঠাৎ রেগে যাবার স্বভাবের কারণে বাবা তাকে মাঝে মাঝে বলতো-“মেয়ে মানুষের এতো রাগ থাকা ভালো না। পরে, সেই নন্দিতারই বিয়ের পরে রাগ, ক্রোধ সব কোথায় হারিয়ে গেলো !


    জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন,-- ‘ভারতীয় মেয়েরা বিয়ের একমাসের ভেতরে যত কথা শিখে যায়, বিয়ের একমাস আগে সেই কথাগুলো জানা হয়ে গেলে তারা আর বিয়ের পিঁড়িতে বসতে যেত না।


    নন্দিতাও বিয়ের পরে অনেক কথা জেনে গেল, শিখে গেল। শুধু তাই নয়, তার সহ্য শক্তিও এমন ভাবে বেড়ে গেল যে, তা অনুভব করে সে নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল।


    পরবর্তী সময়ে নারীসুলভ বিভিন্ন গুণে বিভূষিতা করে তার অনেক গুণগান করা হলেও ওই উঠোনটির প্রতি তার বিরাগ কিন্তু আর কখনই দূরীভূত হল না। প্রকাণ্ড ঘরবাড়ি, সামনে পেছনে বিরাট উঠোন পরিবৃত বাড়ির প্রতি অনুরাগ নন্দিতার একেবারেই নেই। বাবার বাড়িতেও, সে বাড়ির বিরাট উঠোনটির প্রতি ছোটবেলা থেকে তার একটা বিরক্তি ছিলই। সেটা ঝাঁট দেবার কাজ যদিও নন্দিতার ওপর ছিল না, তবু, সেটা নোংরা হয়ে থাকলেও নন্দিতার বিরক্তি জন্মাত। খোলামেলা বড় বড় ঘর, তার ভেতরে ছড়ানো ছেটানো জিনিসপত্র, সুপারী বাগানের শেষ মাথায় থাকা মাছে ভরা পুকুরটি, বা বাড়ির, বাইরের উঠোনের একদিকে গোয়াল, পেছন বাড়ির পেছনের উঠোনের মাথায় ধানের গোলা, এই সব বিষয়ের প্রতি হৃদয়ের কোন প্রকোষ্ঠে কোন রকম দুর্বলতা নন্দিতার নেই।


    উঠোনের বদলে তিনটি মানুষ কোনও মতে দাঁড়াতে পারে এই রকম একটি ছোট সুন্দর শহুরে ঘর নন্দিতার ভালো লাগে। এই ঘরগুলি তার মনে হয়েছিল, পরিষ্কার পরিছন্ন রাখা অনেক সহজ। কিশোরী বয়েসে দেখা তার ছোট মাসির ঘরটি তার কাছে ছিল একটি আদর্শ ঘর। পরিপাটি, পরিষ্কার, ছোট একটা ঘর। মানুষগুলির শোয়া, বসা, খাওয়া দাওয়া সব কিছুতেই একটা পারিপাট্য বর্তমান। বাজার থেকে বা বাইরে  কোথাও থেকে এসে  এরা পরে থাকা জুতোটাকে  ছুড়ে  দেয় না অথবাএক ঘটি জল দাওবলে চিৎকার করে না।


    হোস্টেলে থেকে কলেজে পড়ার দিনগুলো খুব ভালো লেগেছিল নন্দিতার। হস্টেলের সীমাবদ্ধ জগত। তার বিছানা, টেবি্লচেয়ার --- এর বাইরে আর কিছু চাইবার প্রয়োজন নেই, কোথাও যাবার প্রয়োজন নেই।


    নতুন বউ হয়ে এসে ওড়নার ফাঁক দিয়ে গৌতমদের রাজপ্রাসাদের মতো প্রকাণ্ড বাড়িটি দেখে আনন্দে শিউরে ওঠার পরিবর্তে মনটা তার অখুশিতে ভরে উঠেছিল। ঘর থেকে ঘরে এটা ওটা আনা নেওয়া করতে করতেই তো হাত পা ব্যথা হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে যখন এই বিরাট উঠোনখানা পরিষ্কার করবার দায়িত্ব নন্দিতার উপরে ন্যাস্ত করা হল, তখন তার বুক চাপড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হল। তবে তার মধ্যে একটা সান্ত্বনা যে এই বাড়িটাতে তাকে বেশি দিন থাকতে হবে না। গৌতমের সঙ্গে সে তার সরকারী কোয়ার্টারে চলে যাবে।


            সরকারী কোয়ার্টারে এসে এখানকার দোতলার ব্যালকনি বিহীন দুই কামরার এই বাসস্থানটিকে  নিজের মতো সাজিয়ে নেয় নন্দিতা। নিজের এই সীমাবদ্ধ জগতে সে বহুদিন মগ্ন হয়ে থাকলো। এক দিন তার দুবছরের বাচ্চা ছেলের সঙ্গে খেলতে খেলতে সে ভাবলো এই খানে একটি ব্যালকনি থাকলে বড়ো ভালো হতো। ছেলেটিকে গাছপালা পাখি আকাশ, সমস্ত কিছু দেখাতে সুবিধে হতো। আত্মকেন্দ্রিক বলে বদনামের ভাগী নন্দিতার কাছে ঘরের ভিতর বসে থাকা বিরিক্তিকর মনে হতে লাগলো। একদিন ছেলের হাত ধরে সে বেরিয়ে এলো তাদের সরকারী আবাসন এলাকার মাঝখানে থাকা খোলা জায়গাটিতে। বিকেল বেলা সকল মহিলারা জুটে পরনিন্দা-পরচর্চায় স্থানটি মুখর করে তোলে। কেবল তাই নয়, রাঁধা-বাড়া, শাড়ি-গয়না, গাড়ি-বাড়ি এমন কি সেই সময়ে নতুন প্রাদুর্ভাব হওয়া টিভি নামক বস্তুটির নানা অনুষ্ঠান ইত্যাদি সকল রকম আলোচনাই এই স্থানে হয়ে থাকে। এতদিন চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা নন্দিতাও এই সমস্ত মুখরোচক আলোচনায় ক্রমশ অংশ নিতে থাকে।


          তারই মধ্যে অন্য একটি বিষয় ক্রমশ নন্দিতাকে যন্ত্রণা দিতে লাগলো। ছেলের স্কুলের ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে যখন নন্দিতা গ্রামে তার শ্বশুর শাশুড়ির কাছে যায়, তখন তাকে প্রায়ই একটা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়--- বৌ মার আর বাচ্চা কাচ্চা হয় না কেন ? মাঝে মাঝে পাশের বাড়ির দু একজন মহিলা নন্দিতাকে শুনিয়ে শুনিয়ে ফিস ফিস করে শাশুড়ির কাছে বলে, ‘নন্দিতা কাকবন্ধ্যা নয় তো ?’ ক্রমে এই শব্দটিকে নিয়ে তার স্বামী দেবতার সহকর্মীর পত্নিরা তথা বিকাল বেলার বান্ধবীরা ভেতরে ভেতরে বেশ নাড়াচাড়া করতে লাগলো।


              দিন চলে যায়। ছেলের কথা মতো নন্দিতা ফ্ল্যাট কেনে। বিভিন্ন শহরে শহরে বদলির চাকরীর কারণে বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়ানো গৌতমের ছেলে গ্রামে থাকার কথা কল্পনাই করতে পারে না। আর নন্দিতার তো কথাই নেই। সেই কিশোরীবেলা থেকে নগর মহানগরের প্রতি আকৃষ্ট নন্দিতা মনে করে, জীবন যদি থাকে তো সে আছে মহা নগরে। গ্রামে কিচ্ছুটি নেই।


              স্থানাভাবের কারণে তার ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান করতে হয় বিবাহ ভবনে। বিষয় টা এখন একেবারে স্বাভাবিক। তা ছাড়া, বিবাহ ভবনে বিয়ের কাজও খুব সহজে হয়। কোন ঝামেলা নেই। তথাপি, বধূবরণ করে ঘরে নেবার সময় নন্দিতার বুকটা যেন একটুখানি মোচড় দিয়ে উঠলো। মহানগরের বাসিন্দা হবার পরে অনেক নীতি নিয়ম একেবারে বিদায় নিয়েছে। নববধূ এসে গোয়ালঘর, গোলাঘর ইত্যাদিতে চাল ছড়িয়ে দেবার নিয়মগুলো এখন বিস্মৃতির গর্ভে।


              নন্দিতা নিজের আধুনিকা পুত্রবধুর সঙ্গে সব সময়  মানিয়ে চলবার চেষ্টা করে। তবুও যেন কোথায় শাশুড়ি-বৌয়ের সেই চিরাচরিত রেষারেষি মাথা তুলে দাঁড়ায়। পাশের ঘরে যখন বউমা রিয়া তার স্বামীর কাছে শাশুড়ির দোষ গাইতে থাকে, তখন একটু মুক্ত স্থানে বেরিয়ে আসবার জন্য আকুলি বিকুলি করতে থাকে নন্দিতার মনটা। কিন্তু কোথায় পাবে সেই মুক্ত স্থান? ব্যালকনি নামের ছোট খোলা স্থানটিও ভরে আছে নার্সারি থেকে কিনে আনা নানা হাইব্রিড ফুলের টব আর শুকোতে দেওয়া কাপরে। একটা ছোট উঠোন থাকলে ভালো হতো ! বৌমার অভিযোগ গুলি উপেক্ষা করে সেখানে বসে থাকা যেত !


              ধীরে ধীরে চার পাশের পরিবেশটা তার কাছে অস্বস্তিকর হয়ে উঠলো। গৌতম বরুয়া ইহ সংসার ছেড়ে যাবার পর থেকে একটু খানি মাটির স্পর্শের জন্য তার হৃদয় হাহাকার করতে থাকে। গৌতমের শরীর মাটির সঙ্গে মিলিত হয়ে গেছে। সেই মাটির স্পর্শে যদি গৌতমের শরীরের সেই পরিচিত গন্ধ পাওয়া যায় !


    তিনটে শোবার ঘর নিয়ে নন্দিতাদের এই ফ্ল্যাট খানা পাঁচ তলায়। ভগ্নস্বাস্থ্য, দুর্বল দেহ নিয়ে নন্দিতা এখন শয্যাশায়ী। মৃত্যু পথযাত্রী। যে কোন মুহূর্তে যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে বলে বাড়ির সকল সদস্য ইদানিং খাওয়া দাওয়া খুব তাড়াহুড়ো করে সেরে নেয়। বাড়ির সদস্য মানে পুত্র, পুত্রবধূ এবং নাতি নাতনি দুজন। অবশ্য নন্দিতার এদিকে আর কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। বায়ুতে মিশে যাওয়া গৌতম সূর্যকিরণের সঙ্গে তার শরীরে এসে পড়বে--এই আশায় সে বিছানাটাতে নিঃসার হয়ে পড়ে থাকে।


              তার শ্মশান যাত্রার এগারো দিনের দিন আত্মীয় স্বজন নিয়ে মৎস্যস্পর্শ নিমন্ত্রণ গ্রহণ করতে মন্দিরের সামনের পথটাতে গাড়ির দীর্ঘ সারি দেখা যায়। পুত্রের সহকর্মী, তার বন্ধু-বান্ধব, বৌমার সহকর্মী, তার বন্ধু-বান্ধবী, তাদের পরিবার, গ্রাম থেকে আসা নন্দিতার দেওর (যদিও তার স্ত্রী আসতে পারে নি) এবং অন্যান্য সবাইকে নিয়ে মন্দির প্রাঙ্গণ সেদিন উৎসব-মুখর।


              গৌতম বরুয়ার ইচ্ছানুসারে তার মৃতদেহ তার গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তার শ্রাদ্ধাদির কাজও বাড়ির বিরাট উঠোনখানাতে করা হয়ে ছিল। কিন্তু নন্দিতা মৃত্যু্র আগে  সেরকম কোন ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। এই কারণে পুত্র-পুত্রবধুর পক্ষে কাজটা সহজ হয়ে এলো। একটা বিরাট উঠোনে সমবেত স্বজন-পরিজনের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে তাদেরকে মাতৃশ্রাদ্ধ সম্পন্ন করতে হলো না।


    বাড়ির উঠোনের অভাবেই আজ বরুয়া পরিবারের বড়বৌয়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠান মন্দিরে করতে হলো। মৃতা বৌদির মৎস্যমুখীর নিমন্ত্রণ খেতে বসে গ্রাম থেকে আসা তার দেওরের চোখ দুটো জলে ভরে উঠলো। তার চার পাশে হাসি তামাসা করতে করতে নিমন্ত্রণ খেতে থাকা মানুষগুলো পাছে তার অকারণ অশ্রু দেখে অবাক হয়, এই কারণে সে সংকুচিত হয়ে পড়লো। কিন্তু সরল সে মানুষটা জানতেও পারলো না, আশেপাশের কারো এখন তার চোখের জল দেখবার সময় নেই।

Comments