গল্প - সুব্রত ভট্টাচার্য



মেঘের  আনাগোনা


খুব সকালে একটা টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রাজীবের। শীতের সকাল। তখন ঠিক কটা বাজে বোঝা গেলনা। বাইরে ভালো করে ভোরের আলো ফোটেনি। রাজীব সকালে এত তাড়াতাড়ি ওঠেনা। ঠিক সাতটায় তার ঘড়িতে  অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। দুবার বা তিনবার অ্যালার্ম বেজে উঠলে রাজীব উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। অ্যালার্ম বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ে বিছানায়। মিনিট পনরো পর আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। তারপর তার দিনের কাজ শুরু হয়। এই শীতের দিনে ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে ওঠাটা বেশ বিরক্তিকর।

 

রাজীব ভেবেছিলো টেলিফোনটা থেমে যাবে। কিন্তু সেটা থামল না। চার পাঁচ বার বেজে তবেই থামল। অসময়ে টেলিফোন এলে বিরক্তি হয় বটে তবে খানিকটা দুশ্চিন্তার মেঘও তাকে ঘিরে ধরে।

  

রাজীবের মায়ের কথা মনে হলো। বাবার মৃত্যুর পর মা যেন কেমন মনমরা হয়ে থাকেন। ছেলে মেয়েরা সকলে যত্ন করলেও কেমন যেন একাকীত্বে ভোগেন। মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। ওরা হাসাহাসি করলে বা মজার কথাবার্তা বললে একটু হাসেন, কিন্তু বেশীক্ষণ একা থাকলেই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। মায়ের অসুস্থতা আছে তবে শরীর মোটামুটি ঠিকভাবেই চলছিলো। গত দু সপ্তাহ থেকে তাঁর খাওয়া দাওয়া হঠাৎ কমে গেছে। অনেক কিছুই হজম হতে চায়না।  টুকুনের ফোন পেয়েছিলো কয়েকদিন আগেই। মেজভাই টুকুনের কাছেই এখন থাকেন মা। 

  

মায়ের শরীর খারাপ হবার খবর শুনে বাড়ী যাবার কথা চিন্তা করেছে রাজীব। আগামী সপ্তাহের শুরুতেই চার পাঁচ দিনের জন্য বাড়ী যাবে তারা সবাই। অফিসে বলে ছুটির ব্যাবস্থা হয়েছে। তবে কি মায়ের অসুস্থতা হঠাৎই  বেড়ে গেলো?  ফোনটা কি তবে টুকুনের? 


বাবা যখন চলে যান, তখন এমনি এক ভোরবেলা ফোন এসেছিলো ছোট ভাই পাপুনের। ফোনের ভল্যুম খুব কমানো ছিলো। আর ছিল বেশ খানিকটা দূরে, টেবিলের ওপরে। খুব ভোরে টেলিফোন এসেছিল। প্রথম দিকে শুনতেই পায়নি রাজীব। তারপর হাল্কা শব্দ শুনে উঠে দেখে পাপুনের ফোন। কথা বলেই দুঃসংবাদটা জানতে পারে সে। কান্নায় ভেঙে পড়ে, দীপিকাকে ডেকে তুলে খবরটা দেয়। দীপিকাও  কান্নায় ভেঙে পড়ে। একে একে ছেলে মেয়েদেরও খবরটা জানায়। আকস্মিক খবরে সবাই হতভম্ব হয়ে যায়।


একটু সামলে নিয়েই বাড়ী যাবার প্রস্তুতি শুরু করে রাজীব। ছেলে মেয়েদের তৈরী হতে বলে। ফোন করে অফিসের বসকে জানায়। এক ঘন্টার ভেতর তৈরী হয়ে রওনা হয় বাড়ীর দিকে।   


রাজীবের রাঙামাসীর কথাও মনে আসছে এ সময়।  রাঙামাসী মায়ের চাইতে বছর পাঁচেকের বড়। রাঙামাসী বেশ কিছুদিন থেকে ভুগছেন। গত সপ্তাহে গজুদাদা ফোন করেছিল। রাঙামাসী বেশ অসুস্থ।  বয়স তো হয়েছেই, গত সপ্তাহে হঠাত কলতলায় পড়ে গিয়েছিলেন। পায়ের হাড়ে চিড় ধরেছে। ডাক্তার বলেছেন দু মাস শয্যাশায়ী থাকতে হবে। বাড়ীতেই তার চিকিৎসা চলছে। এর সাথে আরও কিছু উপসর্গ রয়েছে।


 রাঙামাসী রাজীবদের ভাই বোনদের ভীষন প্রিয়।  ছেলেবেলায় স্কুলের কয়েকটা দিন ছুটি থাকলে তাদের রাঙামাসীর বাড়ী ছিলো বাধা। রাঙামাসীরাও মাঝে মাঝে চলে আসতেন ওদের বাড়ীতে। খুব মজায় কাটত কয়েকটা দিন। শহর থেকে একটু দূরে রাঙামাসীর বাড়ী ছিলো খুব মজার। বাধানিষেধ ছিলো কম। সেখানে খোলা মাঠ, গাছপালা, পুকুর, ধানের ক্ষেত সবকিছুই পাওয়া যেত। অতিরিক্ত পাওয়া যেত বড়দের স্নেহ আর দাদাদের সাহচর্য। ফুটবল খেলা, ঘুড়ি ওড়ানো, ছিপ ফেলে মাছ ধরা এসব ছিল বিরাট আকর্ষণের। গ্রামের টাটকা জিনিষপত্র দিয়ে পছন্দসই খাবার দাবার তৈরী হতো। বারান্দায় সারি বেধে বসে খাওয়া হতো সবাই মিলে।

 

মেসোমশায় ওদের অনেক দুষ্টুমিতে প্রশ্রয় দিতেন। তাতে আরও বেড়ে যেত দুষ্টুমি। ফোনটা গজুদাদার নয়তো? এখন বা কেমন আছেন রাঙামাসী!


ছোটকাকার কথাও মনে আসছে রাজীবের। দিন পনরো আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ছোটকাকা। সাত দিন হলো বাড়ীতে ফিরেছেন। কাকাতো ভাই মন্টু মাঝে মাঝে ফোন করে। ওই ফোন করে খবরটা দিয়েছে। রাজীবদের একসময় একান্নবর্তী পরিবার ছিলো। ছোটবেলায় স্কুলে যাবার সময় পালা করে পৌঁছে দিতো বাবা, মা এবং পিসি। ছোটকাকার দায়িত্ব ছিলো নিয়ে আসার। ছোটকাকার খুব আদরের ছিলো রাজীব এবং ভাইবোনেরা। রাজীবদের অনেক আবদার রক্ষা করতে হতো ছোটকাকাকে। সে সময়কার কথা ভুলতে পারেনা রাজীব। কাকাতো ভাই মন্টু এবং বোন রিনি মাঝে মাঝেই খোঁজ নেয় বাবার এবং মায়ের। রাজীব বাড়ীতে গেলে কাকা আর কাকিমাকেও একবার দেখে আসার চেষ্টা করে। ছোটকাকার শরীর আবার খারাপ হলো না তো?    


ফোনটা আবার বেজে উঠলো। আগের নম্বর থেকে হতে পারে বা অন্য নম্বর থেকেও হতে পারে। আসলে দিনের বেলা বেশ কিছু ফোন আসে অচেনা নম্বর থেকে। সেগুলো বেশীরভাগই টেলিফোন কোম্পানী বা অন্য কোনও ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানের। অচেনা নম্বর হলে রাজীব সহজে ধরতে চায় না। তবে সেসব ফোন ভোরবেলা বা অসময়ে আসেনা। 

  

রাজীব খানিকটা দুশ্চিন্তা আর বিরক্তি নিয়ে উঠে পরে বিছানা ছেড়ে। একখানা চাদর কোনও রকমে চাপিয়ে পৌঁছে যায় টেলিফোনের কাছে।    


তিনবার বেজে বন্ধ হয়ে গেলো টেলিফোনটা। রাজীব ফোন খুলে দেখলো একটা অজানা নম্বর থেকেই ফোন দুটো এসেছিলো। পরিচিত মানুষেরাও অনেক সময় নতুন টেলিফোন নম্বর থেকে ফোন করেন। সেরকমই কিছু নয়তো? মায়ের কথা মনে পড়ে, রাঙামাসীর কথা মনে পড়ে, ছোট কাকার কথা মনে পড়ে। তারা সবাই ভালো তো ? কোনও দুঃসংবাদ নেই তো তাদের কারোও? 


দীপিকার ঘুম ভেঙে গেছে। সে রাজীবের কথা শোনার চেষ্টা করছে। এত সকালে দু দুবার ফোন তাকে খানিকটা চিন্তিত করে তুলেছে। রাজীব সে নম্বরটাতে ফোন করে। একটু সময় নিয়ে রিং হওয়া শুরু হয়। কয়েকবার রিং হবার পর ওপ্রান্ত থেকে একটা পুরুষ কন্ঠ ভেসে আসে। কন্ঠটি রাজীবের পরিচিত নয়। রাজীব তাকে জিজ্ঞাসা করে – এ নম্বর থেকে দুটো ফোন এসেছিলো  একটু আগেই। আপনি কে বলছেন?


ওপ্রান্ত থেকে মানুষটি যার খোঁজ জানতে চাইলেন তার সাথে রাজীবের কোনও সম্পর্ক নেই। মানুষটি অনুতপ্ত হলেন – মাফ করবেন, একটা জরুরী খবর দেবার ছিলো, নম্বরটা বোধহয় ভুল হয়ে গেছে। এত সকালে আপনাকে অকারনে কষ্ট দেওয়া হলো। রাজীবের ভীষন রাগ হলো।  কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষটাকে  দু চারটে কথা শুনিয়ে দেবার দরকার ছিলো। কিন্তু রাজীব এখন ভাবছে, তাহলে তার মা, রাঙামাসী অথবা ছোটকাকার কোনও বিপদ হয়নি। বিরক্তির ভেতরেও, দুশ্চিন্তার মেঘটা  কেটে যায়। কিছু না বলে রাজীব টেলিফোনটা কেটে দেয়।   

Comments

  1. চমৎকার গল্প 👌 লেখক গল্পের বুনোটে পাঠককেও মজিয়ে দিয়েছেন। গল্পের শেষটা অসাধারণ। পাঠক অবশ্য খুব খুশীই হয়েছে গল্পের শেষ টা পড়ে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ দাদা ( দেবাশীষ ধর দা) l ভালো থাকবেন l আপনার নামটা আসে নি, মতামত এ l

      Delete

Post a Comment