শেষ গান
"শেষের গানটি ছিল তোমারি লাগি, শুনিয়ে যাব, সারা রাতি জাগি.."
পুরোনো গ্রামোফোনটা একেবারে লঝঝড়ে হয়ে গেছে।
চলতে চলতে আটকে যায়। আবার তুলে নিয়ে পিনটা বসিয়ে দ্যান নির্মলা আলতো অভ্যস্ত হাতে।
ইস্কুলের শেষ বছরে বাবা কিনে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি পৌঁছে একটু থিতু হবার পরেই নিয়ে এসেছিলেন সেটাকে। বাড়ির সবাই দু চারটে মন্তব্য, বেঁকা কথা, হাসি ছুঁড়ে দিলেও গায়ে মাখেননি। আর কৌতূহল নিয়ে যন্ত্রটা নাড়াচাড়া করতে আসা লোকজনকেও বেশ অভদ্র হেসে ভাগিয়ে দিয়েছিলেন।
এতে কারো হাত দেয়া চলবে না।
নতুন বউয়ের এহেন আসপদ্দায় তার বরের কাছে নালিশ পৌঁছেছিল।
কিন্তু এক গাল হেসে, আদর করে, লুচি খাইয়ে নির্মল সে ঝড় সামলে নিয়েছিলেন। হ্যাঁ, নির্মল বলেই ডাক দিতেন কর্তা।
গানের এ যন্ত্রের ব্যাপারে কারো কোন হস্তক্ষেপ তাঁর কখনো চলে না।
সে সব কি আজকের কথা?
তিরিশের ও ঢের বেশি বছর আগেকার সব দিন।
নির্মলা ভারি হয়েছেন। চুল রূপোলি। চোখ চশমা ছাড়া কিছুই দ্যাখে না। কপালে নানান নকশার বলিরেখা।
নতুন বর পুরোনো হয়ে, এক দিনের জ্বরে কোভিড হাসপাতালে সেই যে গেলেন। আর দেখা হল না।
মেয়ে বিয়ে হয়ে হায়দ্রাবাদে। ফোনে কেঁদে হাপুস হয়।
কিন্তু উপায় ত নেই।
যে যার ঘরে আটকা।
এক তলার ভাড়াটে এক জোড়া অল্পবয়সী মানুষ।
নতুন বিয়ে হয়েছে বলল।
দু জনেই চাকরি করে।
বর একটু দূরে কোথাও, আর মেয়েটা নাকি কাছেই যায়। তার সুবিধের জন্যই এই দক্ষিণ কলকাতার বাড়ি ভাড়া নেয়া।
নাকি ওদের উত্তর কলকাতায় বাড়িঘর বাবা মায়েরা আছেন।
নির্মলা বেশি নাক গলান না।
মাসের তিন তারিখের মধ্যে ভাড়া দিয়ে যায়। ঘরদোর মোটামুটি পরিস্কারই রেখেছে বলে খবর দেয় কাজের মেয়েটা।
নিচের ওরাও ওকেই রেখেছে ঠিকে কাজের জন্য।
মাঝে মাঝে মুখ বেঁকায় টুসি ঘর মুছতে মুছতে।
মা গো, কি আদিখ্যেতা। দেখতে যদি দিদা। এক জন জামা কাপড় পড়ছেন অন্য জন পাঁউরুটি আদ্দেক খেয়ে বাকি তার মুখে দে এলেন।
বলে, খাও দেখি।
আহা মরে যাই।
হুঁঃ। তা যদি বুঝতাম ভারি রাজভোগ ভাগ করে খাচ্ছিস। রান্না বলতে ত পাঁউরুটি সেঁকা, ঐ কি চিজ না কি পিন্ডি দিয়ে। আর ম্যাগি।
দুপুরে নাকি অপিসে খায়। রাতে রুটি নিয়ে ঢোকে। তড়কার দোকানে খাতা খোলা। ছুটির দিন হয় হোটেল, নয় ফোনে খাবার। আর বেশিরভাগ সময় ত নাকি বাবা মায়ের কাছে দৌড়।
নির্মলা মনে মনে হাসেন।
টুসির বয়েস বেশি না। এদের কাছাকাছিই হবে হয়ত। তার মধ্যেই গোটা চারেক মেয়ে আছে। ছেলে বাচ্চার আশায় চারটে মেয়ে। তারপর আর সহ্য হয়নি। পাশের বাড়ির বউয়ের সাথে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে গিয়ে লাইগেশন করিয়ে এসেছে বাচ্চা হওয়া বন্ধ করতে।
তার জন্য শ্বশুর শ্বাশুড়ি খাপ্পা। তাদের বুদ্ধিতেই চারটি বাচ্চা হয়েছে।
আর ছেলে হওয়ানোর উপায় না থাকার রাগে বর মদ বেশি যে দিন খায় এসে গালি আর মার রেগুলার দিয়ে থাকে।
টুসি জানে এ বাচ্চাদের ও সে খাওয়ায়, আর ছেলে বা মেয়ে যাই হোক আরও বাচ্চা হলেও তাকেই খাওয়াতে হত।
তাই চুপ করে থাকে।
এই কপোত-কপোতীকে দেখে তার হিংসে অস্বাভাবিক কিছু না।
তাই নির্মলা বলেন, যাক গে না। রান্না কম হলে ত তোরই সুবিধে। বাসন কম পড়ে । ওরা কি করে তাতে তোর আর আমার কি? আমরা ত কড়াইশুঁটির কচুরি আর নতুন আলুর দম খাবো।
ওরা খালি পাঁউরুটি আর চুমু খেয়ে পেট ভরাক গিয়ে।
ইসস। কি সব বলে রে দিদা।
হেসেটেসে লাল হয়ে রান্নাঘরে যায় টুসি।
সেইখানে তার জন্য দিদা জলখাবার চাপা দিয়ে রাখে কিনা এলুমিনিয়ামের থালায়।
আলতো হাসি ঠোঁটের কোনায় মেখেও অন্যমনস্ক হন নির্মলা।
গভীর গলার একটা ডাক ভিতরে ভেসে ওঠে।
নির্মল…
আদর কি সবার ভাগ্যে থাকে?
যার থাকে সে কত সৌভাগ্যের কপাল নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে।
মানুষ ভাবে কখনো এ কথা ?
কোন বিয়ের হিসেবে, পাটিপত্র ফর্দে থাকে এ জরুরী তথ্য?
কি ভাবে মানুষ ? আদর ছাড়া বাকি আর সব টাকা ফেলে কেনা সামগ্রীর স্তুপ দিয়ে জীবন চালিয়ে নেবে?
দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বিষন্ন হাসির সাথে নির্মলা।
তাই কখনও হয়?
এই যে আজও পাড়ার সবাই বলে এত বয়েসে মাসিমা কি সুন্দর।
কেউ জানে কি, কি মেখে ?
রুপোলি চুলের মানুষটি প্রিয় গান চালান আবার পুরোনো রেকর্ডের খাঁজে।
সুরের খাঁজ ছুঁয়ে ফিরে ফিরে আসে আদরের আবেশ। লাজুক কিশোরীর ব্রীড়ায় ফাগের রঙ ছড়ায় ধবধবে ফরসা মুখে।
"শুনিয়ে যাব, সারা রাতি জাগি…"
রাত জাগা আদর গড়িয়েছে ভোর অবধি কত দিন।
ঘামে ভেজা ক্লান্ত আদরকর্তা বলেছে,
দেখেছো, মাটি কাটার চেয়ে বেশী পরিশ্রম করি তোমায় ভালোবাসতে গিয়ে। দাম দাও তার।
কুলকুল করে হেসে ভিজে যাওয়া নির্মলা বলতেন, ডাকাতিই করে যে, তাকে আর গেরস্থ দাম দেবে কি শুনি ?
পিঠের ওপর মাথা রেখে ঘুমোতে ঘুমোতে রাত কাবার। উঠতে দেরি হয়ে যেত। বকুনি ও কম খাননি তার জন্য।
তবু, সেই আদরের রূপটান রূপকথা হয়ে জড়িয়ে আছে জীবনকে।
নিচের তলায় দরজা বন্ধ করে বেরোনোর আওয়াজ ভেসে আসে।
আহা, ভালো থাক দুটিতে।
মঙ্গল কামনা করে কপালে হাত ঠেকান নির্মলা।
কত দিন থাকবে, টিকবে, সে ত অনেক দূরের হিসেবী কথা। এখন ত আদর আছে, আর সে ত সোনার গয়নার চেয়ে ও দামি। থাক। যতদিন থাকে ততই ভালো।
পিছনে গ্রামোফোন বলে, শেষের গানটি..
Comments
Post a Comment