গল্প - শৌভিক রায়


একটি আত্মহত্যা



খানিক আগে সিঁথির সিঁদুর মুছে দিল আমার মা। আমি ফ্যালফ্যাল করে দেখলাম। 

মায়ের হাত ধরে যে বাধা দেব সেই শক্তিটাও  আর নেই। শাশুড়ি-মায়ের আর্তনাদ, প্রতিবেশী অনেকের ফুঁপিয়ে কান্না...কিছুই আমার কানে যাচ্ছে না। 

বাবা এসে আমার গালে ঠাস ঠাস করে চড় দিল কয়েকটা। ব্যথাও লাগল না। আমাকে ঝাঁকিয়ে চিল-চিৎকারে কি যেন বলল বাবা। আমি শুনতে পেলাম না। 

নার্সিং হোম থেকে ফিরে বাথরুমে গেছিলাম। রেডি হয়ে আবার যাব, মৈনাকের পাশে বসে থাকব... ভেবেছিলাম এরকমটাই। বাথরুম থেকে বেরিয়ে বড় করে সিঁদুর দিয়ে রেডিও হয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে সবাই আটকে দিল। 

আমি তখনও বুঝি নি। অবুঝের মতো বলেছি,
- আমাকে আটকাচ্ছ কেন? আমি এখন কিছু খাব না। 
- তোমাকে এখন যেতে হবে না বৌদি।
- যেতে হবে না মানে! মৈনাক ঘুমোচ্ছে। ঘুম ভাঙলেই আমাকে খুঁজবে। ঘুম ভাঙার সময় হয়েও এলো...
- বৌদি যেও না। যেতে হবে না।
- কী কথা! যেতে হবে না!

মনে মনে বলছিলাম, মৈনাক বড় করে সিঁদুরের টিপ ভালবাসে। ওর জন্যই তো সেজেছি। ওর প্রিয় শাড়িটা পড়েছি। ওর শরীর খারাপ হলে আমাকে পাশে না পেলে ওর হয় না। পরশু বুকে ব্যথা হতেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। আমি রাজী ছিলাম না নার্সিং হোমে ভর্তি করাতে। কিন্তু ডাক্তারবাবু এতো জোরাজুরি করলেন! আর মৈনাকও কেমন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল। তাই আর আপত্তি করি নি। 

কিন্তু ওকে একা ছাড়িনি। নার্সিং  হোমে ভর্তি করে ওর সঙ্গে ঠায় বসেছিলাম। ডাক্তারবাবু, নার্স, আয়া কারও  কথা শুনিনি। সেদিন ওকে আই সি ইউ-তে ওকে রেখেছিল। কাঁচ দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যেন চোখ খুললেই আমাকে দেখতে পায়। কাল দুপুরে আই সি ইউ থেকে বের করে কেবিনে দিল। মৈনাক তখন তাকিয়ে আমার দিকে। ওর চোখের কোনায় হাসি, যেন দুষ্টুমি করছে। 

আমার।...আমার খুব...খুব রাগ হচ্ছিল। ওর বুকে দুমদুম করে কিল মারতে ইচ্ছে হচ্ছিল। নেহাত ব্যথা ওর বুকে। তাই কিছু করি নি। তবে সবাইকে লুকিয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়েছিলাম। কেমন শুকনো হয়ে গেছে ঠোঁটটা। হবে না? ওর এসি সহ্য হয় না। আর আই সি ইউ মানেই এসি। কিরকম ঠান্ডা আর শান্ত। এসি-তে গা শুকিয়ে যায়। মৈনাকেরও তাই হয়েছে। ঠোঁট শুকিয়ে চড়চড়ে হয়ে গেছে। তবু মৈনাকের ঠোঁট তো। আচ্ছা মৈনাকের বলছি কেন? ও তো আমার ঠোঁট, আমার অধিকারের ঠোঁট। 

এই অধিকার নিয়েই ছোটবেলায় একবার টুম্পার সঙ্গে কি ঝগড়াই না করেছিলাম! এখন ভাবলে হাসি পায়। টুম্পা কিন্তু কিচ্ছু করে নি, মৈনাকের পাশে বসেছিল শুধু। কিন্তু আমি রেগে গেছিলাম ভীষণ। টুম্পা কেন বসবে? মৈনাকের পাশে শুধু আমি বসব। টুম্পার সাথে ঝগড়ার সময় টুম্পা আমাকে জেলাস আর পজেসিভ বলেছিল। 

আচ্ছা সত্যিই কি আমি তাই? পুরোটা না হলেও, অবশ্য অনেকটাই। মৈনাকের সঙ্গে কোন মেয়ে বা মহিলা বেশি কথা বললে বা ইন্টিমেসি দেখালে আমার খুব রাগ হয়ে যায়। আমি জানি মৈনাক আমাকে ছাড়া কারো কথা ভাবতে পারে না, কিন্তু এত্ত শয়তান ও যে আমাকে খেপানোর জন্য দেখিয়ে দেখিয়ে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলবে। ও জানে আমি রাগবো। রেগে গিয়ে কথা বলবো না। দুমদুম করে হাঁটবো। এসব দেখে আমাকে আরও রাগাবার জন্য ও গান গাইতে শুরু করবে। আমি চূড়ান্ত খেপে গিয়ে ওকে মারতে যাবো আর আমাকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে এমন পাগল করে দেবে যে, আমি ওকে ছাড়তে চাইবো না! 

আবার মা এসে হাজির। চোখ লাল আর ফোলা। দেখেই মনে হচ্ছে একগাদা কান্নাকাটি করে এসেছে। এদের নিয়ে এই হয়েছে এক জ্বালা। আচ্ছা শরীর কি খারাপ হতে পারে না! বুকে কি ব্যথা হতে পারে না! এতে এতো কান্নাকাটির কি আছে? আদিখ্যেতা! কিন্তু আমাকে এখন যেতেই হবে। আসার পর আর ঘড়ি দেখি নি। ভাল করে স্নান করে, শ্যাম্পু দিয়ে-টিয়ে সেজেছিলাম খানিক। মৈনাক আমাকে সেজেগুজে দেখতে খুব ভালবাসে। আর আমাদের ছেলেপুলে হয় নি বলে আমার শরীরে ধ্বসও নামে নি। এখনও টানটান। মৈনাকও দুর্দান্ত। আমরা সবার মাঝেও নজরে পড়ি, একবার হলেও দেখতেই হয় আমাদের। অনেকে অবশ্য চোরাচোখে আমাকে চেটেপুটে খায়, টের পাই আমি। পাত্তা দিই না কাউকেই।

কিন্তু মৈনাক আমাকে না দেখলে রাগ হয়ে যায় আমার। 
আর সেজেগুজে থাকলে বদমাশটা এমন হ্যাংলার মতো করে যে, কে বলবে আমাকে সেই ছোট্ট থেকে চেনে! 

শুধু মা নয়, ছোটবেলার বন্ধু পায়েলও মায়ের সঙ্গে হাজির।  কাল থেকে কতজন যে ফোনে খোঁজ নিল তার ইয়ত্তা নেই। এখন আবার বাড়ি আসা শুরু হয়েছে। এখন কি বাড়িতে আসবার সময়? বিরক্ত হয়েই বললাম,
- তুই বাবা মায়ের সঙ্গে কথা বল। আমি মৈনাকের কাছে যাচ্ছি। 
পায়েল কোনো কথা না বলে আমাকে আটকালো। মা হাত টেনে বসালো বিছানায়। তাকিয়ে দেখি কাকু, পিসতুতো দাদা আরও কে কে সব এই ঘরে এসে হাজির। মৈনাকের বাড়ির লোকেরা তো আছেই। পায়েল পাশে বসে সোজা জড়িয়ে ধরলো আমায়। এই গরমে এসব  ভাল লাগে নাকি?

- ছাড় না। ভালো লাগছে না। 
- দিতি...একটু শান্ত হয়ে বোস...বুঝতে চেষ্টা কর!
- কী বুঝবো বল তো?
- প্লিজ দিতি.... 
- না না কী বুঝবো? আর এখন কি বোঝার সময়? মৈনাক নার্সিং হোমে...আমাকে যেতে হবে। 
- তোকে আর যেতে হবে না। 
- যেতে হবে না মানে? রিলিজ দিয়ে দিয়েছে? কিন্তু আমি না গেলে ওকে ধরে ধরে আনবে কে?

- দিতি...
মায়ের গলা। গলায় কান্না ঝরছে,
- দিতি ওকে আর নিয়ে আসবার  যেতে হবে না। মৈনাক আর কোনোদিন আসবে না!
প্রথমটায় কথাটা বুঝি নি। জানতে চাইলাম তাই,
- আসবে না মানে?
- আসবে না রে মা....মৈনাক আসবে না.....ও আর নেই। মৈনাক মারা গেছে!

কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো মায়ের কথা শুনে। আচমকা বুকে কে যেন খুব জোরে ঘুষি মারলো একটা। গলা চেপে ধরল কেউ। জিভ ছিঁড়ে নিলো। চারদিক থেকে অন্ধকার এসে ঢেকে দিল সব। 

************************************************************
 
মৈনাক মারা গেছে। 

মা আমার সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়েছে। বাবা ঠাস ঠাস করে গালে চড় দিয়েছে। শাশুড়ি মায়ের বিলাপ, প্রতিবেশীদের কান্না...কিন্তু আমি কিচ্ছু বুঝছি না। 

মৈনাক মারা গেছে? আমি মৈনাকের বিধবা? কেউ আমাকে ঝাঁকাচ্ছে, কেউ কাঁদতে বলছে। আমার কানে কিছু ঢুকছে না। আমি চোখে কিছু দেখছি না। আমার মাথার ভেতর একটা কেমন একটা শান্ত ভাব। চারদিক কেমন শূন্য। আমার শরীরটাও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। রক্ত চলে আসছে আঙুলের ডগায়। চোখ দিয়ে যেন আগুনের হল্কা বেরোচ্ছে। ভেতরটা গুলিয়ে আসছে। 

আমি কি পাগল....পাগল হয়ে যাচ্ছি!! 

কিন্তু ওই তো....ওই যে মৈনাক...   

ব্যালকনির পুরোটা গ্রিল দিয়ে ঘিরতে দিই নি আমিই। সুবিধে হল তাই। সবাই বলছে মৈনাক মারা গেছে। কিন্তু শয়তানটাকে তো কেউ জানে না! একমাত্র আমি জানি। আমাকে জ্বালাবে বলে আসলে পিঠে পাখা লাগিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ওই তো....ওই যে। মিটিমিটি হাসছে। পাজি একটা।

এদিকে শাশুড়ি মা ফুঁপিয়ে কাঁদছেন, আমার মা বিলাপ করছে, বাবা মাথায় হাত দিয়ে নির্বাক ব`সে। আর বদমাশ মৈনাক দিব্যি উড়ে বেড়াচ্ছে, আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। 

দাঁড়াও, তোমার হবে এবার। আসছি আমি।

************************************************************

ব্যালকনি থেকে মৈনাককে ধরতে ঝাঁপ দিলাম আমি। 

দশতলা থেকে হাওয়া কেটে হু হু করে নামছি নিচে। ওই তো, ওই তো মৈনাক। দেখো পাজিটা এখন আম্বুলেন্সের পাশে মাটিতে শুয়ে পড়েছে, এই মাত্র উড়ছিল। এখন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে। শোবেই তো! বুকে ব্যথা কমেছে নাকি? কিন্তু বুকের ওপর ফুল রেখেছে কেন! 

ওহহ....ও তো নেই আর। ওর শরীরে তো প্রাণ নেই আর। 
ওটা কি ওর মৃতদেহ! 
প্রাণ না থাকলেই দেহ মৃত হয়ে যায়? 
মুখে আবার সেই হাসি হাসি ভাব। 
মানে আমাকে জ্বালানো! 

দেখাচ্ছি আমিও। ঠিক ওর পাশেই শুয়ে পড়ব আমি। আসছি তাই। দ্রুত নেমে আসছি। 

আওয়াজটা পেলে মৈনাক? শুনলে শব্দটা? দেখতে পাচ্ছ কি আমার শরীর থেকে রক্ত বেরিয়ে আসছে! মাথার পেছন থেকে চাপ চাপ রক্ত ভিজিয়ে দিচ্ছে শান-বাঁধানো উঠোনটাকে! 

দেখো মৈনাক। তাকিয়ে দেখো একবার। সব্বাই ছুটে আসছে চারদিক থেকে। চিৎকার করছে ওরা। কিন্তু তুমি একটা কথাও বলছ না। শুধু শুয়ে আছো চুপ করে। আর মুখে সেই হাসি। উফফ। অসহ্য। কিন্তু ওই হাসি দেখলে তো মৈনাক আমি পাগল হয়ে যাই, জানো তুমি। 

বুঝতে পারছি আমাকে নিয়ে এখন ওরা দৌঁড়োবে নার্সিং হোম বা হাসপাতালের দিকে। কিন্তু বয়ে গেছে আমার তোমাকে ছেড়ে যেতে। 
তুমি বাড়ি এসেছ। আর আমি চলে যাব? এটা হয় না।  

তাই আম্বুলেন্সের পাশে মাটিতে শুয়ে পড়ছি মৈনাক....ঠিক তোমার  পাশে!  

Comments