গল্প - রম্যাণী গোস্বামী


তিয়াস 
 

 

মার্শাল দম্পতির সঙ্গে গল্পে আড্ডায় দিব্যি কেটে গেল বিকেলটা। এই ব্রিটিশ স্বামী স্ত্রী দুজনেই বাফেলো ইউনিভার্সিটিতে ফিলোজফি পড়ান। বড্ড মিশুকে। তাছাড়া প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে তাঁরা তুহিনকে ভীষণ স্নেহও করেন। সেই কারনে মাঝেমধ্যেই চলে আসেন তুহিনের অ্যাপার্টমেন্টে। এখন জানুয়ারিতে নিউ ইয়র্কের প্রতিটি ঘরের বাইরে হাঁটু পর্যন্ত বরফ। তবু ওঁরা এসেছেন। ভোলেন নি দিনটিকে।  


আজ তুহিনের জন্মদিন। ঊনচল্লিশ বছরে পা দিল ও। এই বয়সেই জীবনে যা যা কিছু চাওয়ার তা পেয়ে গিয়েছে সে। অথচ খুব সাধারণ পরিবারে উত্তরবঙ্গের এক মফস্বল শহরে জন্মেছিল তুহিন। ছেলেবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছে। তারপর একাই কলকাতায় এসে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা। তুখোড় ছাত্র ছিল তুহিন। সুতরাং স্কলারশিপের কোনও অভাব হয়নি। দুর্দান্ত রেজাল্ট করে কলেজ থেকে বেরিয়েই বিদেশে চলে এল হায়ার স্টাডিজ এর জন্য। ওর কেরিয়ারের শুরুও এখানেই। তারপর থেকে কেবল সিঁড়ি ভেঙে ওঠা, উপরে, আরও উপরে। চোদ্দ বছর হয়ে গেল সে দেশের বাইরে। এখানে সব কিছুই আছে ওর। উচ্চপদস্ত মোটা মাইনের চাকরি আছে। আছে ঝাঁ চকচকে বিলাসবহুল বাংলো, একাধিক গাড়ি। আর আছে অগাধ ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স। বিলাসের বিস্তর উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সর্বত্র। কী নেই ওর?  


তবুও কেন যেন বুকের ভিতরটা খাঁ খাঁ করে সবসময়। অফিসের জরুরি বোর্ড মিটিঙের মাঝে হঠাৎ আনমনা হয়ে যায় তুহিন। কখনও বা ডিনারে বসে প্রিয়জনের কথার জবাব পর্যন্ত দিতে ভুলে যায়। ওর চারিপাশ থেকে ছিটকে আসা শব্দগুলো কেমন খেই হারিয়ে ফেলে হাওয়ায় ভেসে চলে যায় সুদূরে। ওদিকে তুহিনকে গ্রাস করতে থাকে এক অদ্ভুত শূন্যতা। কেন যে এমন হয়। বিনা কারনেই মুচড়ে ওঠে ওর বুকের ভিতরটা। হৃদয়ের কোন বিন্দুতে লুকিয়ে আছে এই গভীর গোপন বেদনার উৎসস্থল, তুহিন তা জানে না। অনেক ভেবে ভেবেও তাই কোনও কূল কিনারা করতে পারে না সে।


লিজা রাগ করে। ভীষণ রাগ করে। ওর অবাধ্য সোনালি চুলের গোছা কপালের উপর থেকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে গটমট করে উঠে চলে যায় ডাইনিং টেবিল ছেড়ে। মার্থা আর পার্কার অবাক চোখে তাকিয়ে দেখে ওদের ড্যাডি’কে। পার্কার নেহাতই শিশু। কিন্তু মার্থা ইতিমধ্যেই দশ পেরিয়েছে। ওর পিঙ্গল চোখের তারায় আর বাঁকানো ভুরুতে এখনই ঈষৎ ভর্তসনার আভাস পায় তুহিন। প্রবল চেষ্টায় সে তখন নিজেকে স্বাভাবিক করে তুলতে চায়। কিন্তু পারে না। কী ভীষণ অসহায় লাগে।   


বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে সমে ফিরে আসে তুহিন। পুরো বাড়িটা আজ ভরে আছে অপরূপ এক মায়াবী সৌরভে। লিভিং রুম, প্যাসেজ, বেডরুম জুড়ে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে উপহার পাওয়া ফ্লাওয়ার বোকে গুলো। সকাল থেকেই অসংখ্য অভিনন্দন এসে চলেছে কলিগ আর বন্ধুদের তরফ থেকে। লিজা এখন প্রচণ্ড ব্যস্ত রাতের প্রস্তুতি নিয়ে। ডিনারে আজ স্পেশাল সব মেনু। মার্শালদের পাশাপাশি আরও বিশেষ কয়েকজন বন্ধুদের ডিনারে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। লিজারও বন্ধু সংখ্যা নেহাত কম নয়। যদিও তুহিনের বন্ধু অথবা প্রতিবেশীদের মধ্যে বাঙালি একজনও নেই। এই অঞ্চলে এমনিতেও বাঙালির বসবাস বড্ড কম। অনেকদিন হয়ে গেল নিজের মাতৃভাষা বাংলায় একটি কথাও বলেনি তুহিন। অবশ্য তাতে ওর কোনও অসুবিধে হয় না। ও বহুদিন হল এতেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে।  


গোটা বাংলোতে সেন্ট্রাল হিটিং চালু রয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা। সেজন্য ভিতরটায় উষ্ণ আমেজের এক আরামদায়ক বাতাবরণ। এতকিছুর মধ্যেও কেন যেন একটু হাঁসফাঁস লাগে তুহিনের। মার্থা অনর্গল কথা বলে চলেছে আর মিসেস মার্শাল মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে যাচ্ছেন। সেদিকে এক নজর তাকিয়ে আড্ডা ছেড়ে বেরিয়ে আসে ও। তারপর লিভিং রুমের দক্ষিণ কোনের স্লাইডিং কাচের জানলার উপরের ভারি পর্দা সরিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে বাংলো সংলগ্ন বাগানের দিকে।      


এখন যেখানে বরফের পুরু আস্তরণ, বসন্তে সেখানে বসে রঙের মেলা। তুহিনের স্ত্রী লিজা জার্মান হলেও  ইংরেজিটা চমৎকার বলে। মনোরম বসন্তের এক বিকেলে মেপল পাতা ঝরা নির্জন পথে লিজার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তুহিনের। ও একজন আর্টিস্ট। ল্যান্ডস্কেপ আঁকে। বাগানের ভিতরে একটা পাথরে বাঁধানো ঝরনা তৈরি করিয়েছে লিজা। তার দুপাশে মরসুমি ফুলের বাগান। সেখানে কেয়ারি করা নরম ঘাসে পা ডুবিয়ে বসে লিজা ক্যানভাসে রঙ বোলায়। ওর পরনে গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা ফুলহাতা গাউন। তুষারের মত তার রঙ। মাথায় একই রঙের বো বাঁধা। একঢাল সোনালি চুল রেশমি নদীর মত ঢেউ খেলিয়ে ঘাড়ের কাছে লুটোপুটি খায়। অনৈসর্গিক সেই দৃশ্যটির দিকে তাকিয়ে পথিক ভুলে যায় তার পথচলা। বরাবরের মত মুগ্ধ হয় তুহিনও। লিজার শরীরের বক্ররেখা, ওর থুতনির খাঁজে আঙুল রেখে মগ্ন হয়ে বসে থাকা, ওর তন্ময় আপ্লুতি তুহিনের মনে অসম্ভব খুশির জোয়ার আনে। কিন্তু পরমুহূর্তেই ওর বুকের ভিতরটা গোবি মরুভূমির মত খাঁ খাঁ করে ওঠে। কী এক অজানা অপ্রাপ্তি ওকে টেনে এনে দাঁড় করিয়ে দেয় গভীর কোনও সংকটের সামনে। আচমকাই ওর শরীর মন জুড়ে জাঁকিয়ে বসে প্রবল অবসাদ।  


আজও যেমন। এত হাসি, এত উৎসব ওকে ঘিরে, যেন আনন্দের প্লাবন নেমেছে আজ শুধু ওর জন্যই। অথচ ভাল লাগছে না। কিচ্ছু ভাল লাগছে না। কী এই অসুখ? এর কি কোনও নিরাময় নেই? 


হঠাত লিজার ডাকে ঘোর ভাঙে তুহিনের। ওর নামে চিঠি আছে, লেটারবক্সে পড়ে ছিল। লিজা সেটাই দিতে এসেছে।  


চমকে ওঠে তুহিন। চিঠি? কে লিখবে ওকে চিঠি? আজকাল আবার কেউ চিঠি লেখে নাকি? 


খামটা ওর হাতে দিয়েই লিজা কিচেনের দিকে চলে গেল ব্যস্তভাবে। হাতে একদম সময় নেই। অতিথিরা এসে পড়বেন যে কোনও মুহূর্তে। তুহিন ঝুঁকে পড়ল খামের উপর। ইন্ডিয়া থেকে এসেছে এই চিঠি। ঠিকানাটা দেখে পাড় ভাঙে বুকের ভিতর। ছলাত ছলাত শব্দ হয়। ব্যগ্রভাবে চিঠিখানা পড়তে পড়তে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে তুহিনের। চিঠিটা লিখেছে বুলুমাসির ছেলে। বুলুমাসি মৃত্যু শয্যায়। তুহিনকে একবার সপরিবারে শেষ দেখা দেখতে চেয়েছেন তিনি।


বুলুমাসি ওদের কেউ নয়। মায়ের বন্ধু ছিলেন। একই পাড়ায় থাকতেন। তুহিনকে তিনি খুবই ভালবাসতেন। ছেলেবেলায় মাসির নিজে হাতে তৈরি ইয়াব্বড় নারকেল নাড়ু, বয়াম ভর্তি করে সারা দুপুর রোদ খাওয়ানো টক টক কুলের আচার, তিস্তার বোরলি মাছের ঝালের কষকষে স্বাদ আজও যেন ঝাপটা দিয়ে ভেসে আসে মনে। না রক্তের সম্পর্ক, না গভীর কোনও আত্মীয়তা, তবুও ভাল লাগে এই চোরাটান। ভাল লাগে শিকড় উপড়ানো বৃক্ষের আবার মাটিকে খুঁজে ফেরা। তুহিন ভাবে। নিবিড়ভাবে একাকী বসে ও চিঠির অক্ষরগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে বারবার। আর ভাবে। 


তারপর থেকে সমস্ত দিনটা দেশ থেকে আসা সেই চিঠিটাকে বুকের সঙ্গে লেপটে রাখে তুহিন। জন্মদিনের পার্টি, লোকজন, উৎসব, আনন্দ, কাছের মানুষেরা, কেউ ওকে ছুঁতে পারে না আর। ওর মনে পড়ে যায় বহুদিন আগের তুচ্ছ তুচ্ছ এক একটা ঘটনা। বেলা অবধি তিস্তা নদীতে সাঁতার কেটে চোখ লাল করে চুপিচুপি বাড়ি ঢুকছে তুহিন, বুলুমাসি দাঁড়িয়ে আছে গামছা হাতে। আদা আর গুড় দিয়ে গরম গরম চা বানিয়ে এনে ধরছে মুখের সামনে। পড়তে বসে সময়ের হিসেব নেই, মা খাওয়ার জন্য ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, বুলুমাসি থালায় করে ভাত মেখে এনে নিজের হাতে এক একটা গরাস তুলে ধরছে তুহিনের মুখে। 


মা চলে যাওয়ার পরপরই একদিন দুপুর থেকে জ্বরে কাতরাচ্ছে তুহিন। পায়ের কাছটায় টেবিলে ওষুধের শিশি সাজানো আছে। ঘরটা ভারি বিষণ্ণ। জমাট অন্ধকার। বুলুমাসি খবর পেয়ে ছুটে এলেন উদ্বিগ্ন মুখে। সমস্ত ঘরখানা সঙ্গে সঙ্গে যেন আলো হয়ে গেল। তারপর গোটা রাত একঠায় শিয়রের কাছে বসে রইলেন বুলুমাসি। পাশে বাটিতে জল। হাতে জলপটি। কপালে ছোঁয়ানো মাত্র ছ্যাঁত করে উঠছে যেন। জানলার একটা পাল্লা খোলা। বাতাসে ধাক্কা খেয়ে খটখট আওয়াজ হচ্ছে। ঘোর ভেঙে চমকে চমকে উঠছে তুহিন। মা মা - বলে ডেকে উঠল একবার। বুলুমাসি সঙ্গে সঙ্গে তুহিনের মাথায় নিজের হাতটা ছোঁয়ালেন। সুডৌল গোলগোল হাতখানা কী নরম। উজ্জ্বল ত্বক। দুই চোখে কত মায়া। অপার ভালবাসার স্পর্শে তুহিন একসময় ঘুমিয়ে পড়ল আরামে। 


যেদিন পড়াশোনার জন্য কলকাতায় হস্টেলে চলে যাচ্ছে তুহিন, একফোঁটা কাঁদেনি বুলুমাসি। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরেছিল শক্ত করে। অথচ বুলুমাসির অন্তরে এক তীব্র জলোচ্ছ্বাস জন্ম নিচ্ছিল। সেই ঝাপটা থেকে তৈরি হওয়া বাষ্প এসে জমা হচ্ছিল তুহিনের দু’চোখের কোণে। আচ্ছা, বুলুমাসি কি এখনও একই রকম আছে? সেরকম হাসি মুখ? চোখের তারায় গাঢ় প্রশ্রয়? অনন্ত ভালবাসা বুকে নিয়ে আজও তুহিনকে মনে রেখেছে বুলুমাসি? 


গভীর রাতে বার্থডে পার্টি ভাঙার পর তুহিন সিদ্ধান্ত জানায় নিজের স্ত্রী’কে।   


নাহ, মার্থার চ্যাঁচামেচি বা লিজার ভ্রূকুটিতে কাজ হয় না কোনও। তুহিন নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল। তবে ওরা পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে কিছুতেই ওরা ইন্ডিয়ায় যাবে না। উফ্‌, লোকজনের ভিড়, নোংরা, গরম, ধুলো, ডিসগাস্টিং।  


তুহিন তা জানতই। সে শান্ত হয়ে মেনে নেয়। তারপর ওর একার টিকিট কাটে। 


চোদ্দ বছর পর তুহিন পা রাখল ওর নিজের মাটিতে। বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে ভাড়া করা ক্যাব ওকে নিয়ে ছুটে যায় তিস্তাপাড়ের দেশে। শহরের হইচই ছাড়িয়ে নদী, চা বাগান, জঙ্গল ঘেরা ছবির মত সুন্দর জায়গায় এসে তুহিন খোলা বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেয়।  


বুলুমাসিদের বাড়ি যাওয়ার পথে বাঁকের মুখে পড়ল বাঁধ। গাড়ি থেকে নেমে বাঁধ রাস্তার ধারে কিছুক্ষণ দাঁড়ায় তুহিন। মুহূর্তের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে। ইস, কত সরে গেছে নদী! দূর দূরান্তে যেদিকে চোখ যায় সাদা ধু ধু চর। উঁচু চরে রাঙা আলোয় ঝলমল করছে সবুজ ফসল। অথচ ছোটবেলায় এখানেই নৌকো চড়ে দক্ষ হাতে খেপলা জাল নদীতে ফেলে মাছ ধরত বেণুকাকা, কাকার ছেলে সুদর্শনদাদা। জালে উঠত কত নদীয়ালি মাছ। রোদ পড়ে চকচক করত হীরের মত। চেলা, কাউলি, বোরলি, ডেগবা, বিচিত্র সব নাম তুহিনের স্মৃতির কপাটে এসে ঘা দেয় এতদিন পর। ফি বছরে বৈশাখ মাসের শেষ দিনে তারা করত তিস্তাবুড়ির পুজো। সুসজ্জিত ভেলায় দুধ, দৈ, কলা, ফলমূল, বাতাসা ও প্রদীপ নৈবেদ্য দিয়ে জলে ভাসানো হত। পাড়ার বাচ্চাদের সঙ্গে তুহিনও এসে ভিড় জমাত সেখানে। হত স্নান ও জলখেলা। কোথায় গেল সেই বেণুকাকারা? কীভাবে এখন সংসার চলছে মানুষগুলোর? ড্রাইভার স্থানীয় লোক। আক্ষেপের ভঙ্গিতে বলল সে, নদীতে এখন মাছ কমে গেছে দাদা। এ পাড়ার ছেলেরা এখন কেউ আর মাছ ধরার কায়দা শেখে না। ওরা এখন চা বাগানের লেবার হয়েছে। বাগানে পাতা তোলে। বাগান বন্ধ থাকলে ঘরামির কাজ করে। মুটেগিরি করে। সব বদলে গেছে কয়েকটা বছরে।       


বুলুমাসি ওকে দেখে কষ্ট করে উঠে বসে বিছানায়। সেই গোলগাল শরীরটা ভেঙে গিয়েছে কত। শিরা ওঠা হাত। চুল উঠে মাথা ফাঁকা। কিন্তু চোখদুটোয় আগের মতই মায়া। দু’হাতে তুহিনকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় জিগ্যেস করে বুলুমাসি, ভাল আছিস তো বাবুসোনা? কত বড় হয়ে গেছিস তুই। হ্যাঁ রে? আমার কথা কি তোর কখনও মনে পড়ে না? বলতে বলতে মাসির গাল বেয়ে নেমে আসে নোনতা জল। 


এদিকে বাড়ির লোকজন তুহিনকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। একতলা অনাড়ম্বর বাড়িটির উঠোনে ভিড় জমিয়েছে পাড়া প্রতিবেশীরা। এতদিন পর তাদের খুব পরিচিত ছোট্ট তুহিন ফিরে এসেছে এখানে। কিন্তু এই ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরা আপাদমস্তক সাহেবি লোকটিকে কীভাবে তারা আপ্যায়ন করবে ভেবেই পাচ্ছে না যেন। একজন বৌদি সম্পর্কের কেউ হাতে মিষ্টির প্লেট নিয়ে এগিয়ে ধরে ওর সামনে। একটি বাচ্চা ছেলে  তুহিনেরই এনে দেওয়া সুস্বাদু বিদেশি চকোলেটের প্যাকেট খুলে তা থেকে এক টুকরো এগিয়ে দেয় তুহিনের মুখের কাছে। কিন্তু তুহিন ওসব ছুঁয়েও দেখে না। সেই মুহূর্তে তুহিনের মনে হয় যেন একজন স্নেহময়ী মায়ের মুখে উচ্চারিত ওই শব্দগুলোর চাইতে এই জগতের আর কিছুই স্বাদু হতে পারে না। এমন সুমিষ্ট ভাষা আর এমন মধুর ডাক পৃথিবীতে আর কোথাও নেই।  


তুহিন আবিষ্ট হয়ে ওঠে। হঠাত সে আবিস্কার করে তার বুকের গোবি মরুভূমিটা এখন আর মরুভূমি নেই। বরং সে যেন শস্য শ্যামলা এক মনোরম প্রান্তর। সে চোখ বন্ধ করে অনুভব করে তুমুল ধারায় ওই সবুজ প্রান্তরে বৃষ্টি পড়ছে। মাটির সোঁদা গন্ধে ভরে উঠেছে চারিদিক। অদ্ভুত এক আবেশে সে নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না। ছুটে বেরিয়ে যায়। বৃষ্টিস্নাত ওই শ্যামল প্রান্তরের দিকে ও ছুটতে থাকে। সেখানে পৌঁছে উবু হয়ে বসে। তার পায়ের তলায় ভেজা মাটি। চোখও ক্রমশ ভিজে আসে তার। পাশে পড়ে থাকা একটা সরু গাছের ডাল দিয়ে সে সেই ভেজা মাটির বুকে বাংলায় একটি শব্দই লেখে। তা হল - “মা”।   

Comments

  1. খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  2. খুব অন্যরকম মন কেমন করা গল্প...👌

    ReplyDelete
  3. রম্যাণী গোস্বামী মানেই ঝরঝরে ন্যারেটিভ। এই চমৎকার গল্পটিও পড়ে নিলাম তরতরিয়ে। ভাল লাগল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রিয় লেখকের কাছ থেকে সার্টিফিকেট পেয়ে দিলখুশ হয়ে গেল 😊🙏🏼

      Delete
  4. চমৎকার!
    নাড়ির টান যাবে কোথায়? বহু প্রবাসীর মনের কথা,বলার ভঙ্গিমাও অসাধারণ।রম্যাণীর গদ্যের কলমখানি সুললিত

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ব্রততী'দি । খুব ভালো লাগলো তোমার ফিডব্যাক পেয়ে 😊🙏🏼

      Delete
  5. এক সফল প্রবাসী মানুষের দেশের প্ৰতি টান নিয়ে গল্প বেশ ভালো লাগলো l তার পরিবার এবং বর্তমান ঠিকানার ছবিও সুন্দর ফুটে উঠেছে l ভালো লেখা, ভালো লাগলো l

    ReplyDelete
  6. ভীষণ ভালো লাগল রম্যাণী। কী সুন্দর, ঝকঝকে গদ্য। গল্পে মায়াবী টান।

    ReplyDelete

Post a Comment