গল্প - আইভি চট্টোপাধ্যায়


বাবা
 


আয় পিয়াঅনলাইন ক্লাস শেষ হল? তোর জন্যেই বসে আছি।

দাদার হাতে চায়ের কাপসামনে টেবিলের ওপর একটা বাক্স। দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেল। ঠাম্মি বলল, ‘ঠান্ডা হয়ে গেছে বৌমাএকটু গরম করে দাও না!

সকালে শুনেছিল দাদা আজ ব্যাঙ্কে যাবে তখন থেকেই মাথাটা গরম হয়ে আছে পিয়ার ব্যাঙ্ক থেকে ফেরার পথে প্রত্যেকবারের মতই মোমো কিনে এনেছে দাদা পিয়ার জন্যে মোমোপিকলুর জন্যে চকোলেটপেস্ট্রি আর বাড়ির সবার জন্যে জলভরা সন্দেশ গত মাসে আইসক্রীম এনেছিলখায় নি পিয়া আজ মোমো এনেছে

আমাকে একটা দিবিদিদিয়া?’ হ্যাংলা পিকলু অমনি ছুটে এসেছে

পায়ে পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলো পিয়া, ‘সবগুলোই খেয়ে নে

কেন রে? আবার রাগিয়ে দিলি তো দিদিয়াকে? তুই পেস্ট্রি খেলি না? ওটা দিদিয়ার‘ ঠাম্মি একটু বকল

সবসময় এত রাগ করিস কেনপিয়ামোমোর বাক্সটা আনলি নানিয়ে আয়গরম করে দিই,’ মা বলল

আমি মোমো খাব না দুপুরে কি খাবার করেছ?‘

আজ যে শুক্রবারসব নিরামিষ রান্না তোর জন্যে বেগুনভাজা করছি আলুপোস্ত আছে গরম ভাতে ঘি দেব

আমি নিরামিষ খাব না আমাকে একটু পাস্তা বানিয়ে দিতে পারবে?’

পিয়াসেইজন্যেই তো দাদা চিকেন-মোমো এনেছে তোর জন্যে দুতিনরকম মোমো আছে‘ ঠাম্মি উঠে এসেছে উত্তর দিল না পিয়া একটু দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে সরে গেল ঠাম্মি

কেন এমন করিস পিয়াঠাম্মি তোর গুরুজন না? অমন ব্যবহার করতে হয়? কথার উত্তর পর্যন্ত দিলি না ঠাম্মি-দাদা দু: পাবেমোমো খেয়ে নে ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে উল্টো-রাস্তায় সিটিসেন্টারে গিয়ে দোকান খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তোদের জন্যে খাবার কিনে এনেছে বুড়ো মানুষটা

আমি আনতে বলেছিপ্রতি মাসে এই এক নাটক আমার ভালো লাগে না মা

নাটক বলছিস কেন? খুশি হয়েই তো...

ওঁর খুশি নিয়ে উনি থাকুন নাআমাদের খুশি দেখানোর দরকার কি? মাসে দুহাজার টাকাসেই টাকা দেখানোর জন্যেই তো এই মোমো-পেস্ট্রি-মিষ্টি? সারাদিন ধরে এবার গল্প চলবেবড়ছেলে কত দায়িত্ববানআর আমার বাবা যে সারা মাস ধরে সব খরচ টানছে একা? তুমি যে ওঁদের সব ফাই-ফরমাশ খাটছ? সেসব নিয়ে খুশিটা তো দেখতে পাই না?‘

বলতে না বলতে পিকলু ছুটে এসেছে, ‘মাদাদা বলছে পোস্তর বড়া খাবে

আচ্ছা পোস্তবাটা আছে তো, করে দিচ্ছি দাদাকে বলোএকটু পরেই খেতে দিয়ে দিচ্ছি

না বৌমাঅত আশকারা দিও না তো যা হয়েছেতাই দাও আমার পান...

ওই তোপানের ডিবেয় পান সেজে রেখেছি মা বাবাকে কিছু বলবেন না আপনিএই একটা দিনই তো বাবা ছেলেমানুষের মতো খুশি থাকেন মা হাসল

সাধে কী রাগ হয়ে যায় পিয়ারমা নিজেই তো অবোধ ছেলেমানুষের মতো ব্যবহার করছে জলপাইয়ের চাটনি করেছ বৌমা?’ ঠাম্মি এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছে, ‘রানাকে বলেছিলাম জলপাই আনতে

হ্যাঁ মাআপনার ছেলে জলপাই এনেছে ওই তো চাটনি হয়ে গেছে

ডাইনিং-টেবিলে বাটি করে সাজিয়ে রাখা চাটনিডালপালংশাকের ঘন্টআলু-পোস্তফুলকপির ডালনা। ঢাকা খুলে খুলে দেখল ঠাম্মিতারপর দাদাকে বলল, ‘অনেকক্ষণ বসে আছএকটু ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো। পোস্তর বড়া করে বৌমা খেতে দেবে

এখানেই বসিপিয়া মোমো খাবে একটু দেখি

পিউ সোনামামনি আমারযাও একটা অন্তত মোমো খাও দাদা হাতে করে এনেছেন...

মায়ের পিউসোনা ডাক মানেই ভুলিয়ে ভালিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া একটুও নরম হয় নি পিয়া, ‘আচ্ছা মাতুমি কি কিছুই বোঝো না? নাকি সব বুঝেও এমন বোকার মতো থাকো?’

কি বলছিস পিয়া? মায়ের সঙ্গে কেউ এমন করে কথা বলে?’

অনেক দু:খে বলছি মা সেই কোন সকালে রান্নাঘরে ঢুকেছতারপর বাটি বাটি সাজিয়ে রেখেছ রান্না করে... এখন আবার হুকুম হল পোস্তর বড়ার তুমি যে একটা মানুষতা ওঁরা মাথায় রাখেন না প্রতিমাসে এই একদিন ওঁদের প্রাণে পুলক জাগে, আর খেটে খেটে মরবে তুমি কেন? আমার বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে সারা জীবন ধরে সবাইকে দেখছেওঁদের সব সামলাচ্ছেহুকুম মতো বাজার করছেতারপরও একদিনের জন্যে ওঁদের মুখে বাবার বা তোমার জন্যে কোনো প্রশংসা শুনি না আর এই একদিন দুহাজার টাকা নিয়ে এত দেখানো! বলতে বলতে হাঁফ ধরে গেল

আস্তে আস্তে ঠাম্মি শুনতে পাবেন মা এসে মাথায় গালে হাত বুলিয়ে দিল, ‘এত রাগ ভালো নয় মা গুরুজনদের সম্বন্ধে এমন করে বলতে নেইভাবতেও নেই

এক ঝটকায় মায়ের হাত সরিয়ে দিল পিয়া, ‘তোমাকে বলে লাভ নেই মা নিজের ভালো পাগলেও বোঝে তুমি বুঝবে না চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও তুমি.... চোখে জল এসে গেলকথা শেষ না করেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল পিয়া


******


যাবেই বা কোথায়? নিজের বলতে একটা ঘর নেই পিয়ার দুকামরার ফ্ল্যাটবাবা লোন নিয়ে কিনেছেমাসে মাসে ইএমআই কাটে দাদু-ঠাম্মির ঘরটাই পিয়ার পড়ার ঘর দাদা ঘরে গিয়ে শুয়েছেঠাম্মিও কাছে বসেছে আজ খুব আনন্দ যে কত গল্প হবে এখন পিয়া যে অঙ্ক করতে করতে উঠে গেছেখাতাটা এখনো খোলা আছেদেখেও ঘরে ঢুকে আছে দুজনে ভাল্লাগে না একটা নিজের জায়গা নেই বাড়িতে সে অবশ্য পিকলুরও নেই বাবা-মায়ের ঘরে পিকলুর পড়ারাতে বসার ঘরে ডিভানে ঘুমোয় পিয়াপিকলু বাবা-মায়ের সঙ্গে

আর ওদের? দোতলা বাড়ি ডুপ্লেক্স ওরা বলেডুপ্লে নীলদাদার পৈতের সময় যাওয়া হয়েছিল সবাই মিলে, আবার লালিদিদির বিয়ের সময় যেতে বলবে বোধহয় এমনি তো যেতে বলে না কত্ত বড় বাড়িওপরে চারটে ঘর নিচে তিনটেনিচে বড় লম্বা হলঘরসেখানে পার্টি হয়েছিল ওপরে রান্নাঘরলাগোয়া ডাইনিং-হল সেটাও অনেক বড়পিয়াদের দুটো ঘর ধরে যাবে এমন নীলদাদা-লালিদিদির আলাদা ঘর,আবার স্টাডি,মিউজিক-রুম

নিচে দুটো গেস্টরুমপিয়ারা সবাই তার একটায় ছিল অন্যটায় শান্তিপুরের পিসি-ঠাম্মার ছেলে-বউপৈতেয় এসেছিল ওরাও দাদা-ঠাম্মি ওপরের একটা ঘরে ছিলযদিও ওটা নিজেদের ঘর নয় অত বড় ডুপ্লে বাড়িতে দাদা-ঠাম্মির কোনো ঘর নেই। জ্যেঠিমার মা-বাবার একটা ঘর আছে কিন্তু এই কথাটা বলতে গিয়ে মায়ের কাছে ওই পৈতেবাড়িতে বকুনি খেয়েছিল পিয়া

ওই একবারই বড়ছেলের বাড়িতে গেছিল দাদা-ঠাম্মি সেই নিয়ে এখনো গল্প করে সবার কাছে ছেলের বাড়ি কত বড়ঘরে ঘরে এয়ার কন্ডিশনারকতরকম জিনিসমডিউলার কিচেনসুন্দর সুন্দর কাচের বাসনসবুজ লনে বেতের চেয়ারলনের দোলনা… গল্প আর শেষ হয় না

এখন তো গল্প করার বিষয় আরো বেড়েছে নীলদাদা বিদেশে পড়তে গেছেলালিদিদি হায়দ্রাবাদে চাকরি করতে গেছে যদিও ওরা কলকাতা এলেও বাড়িতে থাকে না জ্যেঠু-জ্যেঠিমা এসে জ্যেঠিমার বাপের বাড়িতে ওঠেএবাড়িতে দেখা করে যায় নীলদাদা একবার একা এসেছিলতাজ বেঙ্গলে ছিল এবাড়িতে দেখা করতেও আসে নি তবু আলো আলো মুখে ওদের গল্প করে দাদা ওদের জন্মদিনে ফোন করেঠাম্মি রোজ ওদের সবার নাম করে পুজো করে

মা বলে, ‘এই নিয়ে তোর খারাপ লাগে কেন পিয়া? কতখানি ভালোবাসার মন থাকলে এমন করে সব নাতি-নাতনিকে জড়িয়ে থাকা যায়, বলকোনো চাহিদা নেই ছেলেদের কাছে, তাদের সুখ দেখেই সুখী বাবা-মা এগুলো দেখতে পাস না পিউ?’

দেখতে পায় না মা নিজেই ছেলেদের বলল না মা? ওটা শুধুই একজন ছেলের জন্যে ছোট ছেলেকে নিয়ে দাদা-ঠাম্মির এই আবেগ দেখা যায় না বাবার চাকরি নিয়ে বড় মুখ করে গল্প করার ইচ্ছে হয় না মা যে দাদা-ঠাম্মির সেবা করে এত, সে নিয়ে কোনো কথা শোনা যায় না পিয়া-পিকলুর কোনো অ্যাচিভমেন্ট দেখতেই পায় না হ্যাঁপিয়ার যে অঙ্কে খুব মাথা সেকথা একবার বলেছিল জ্যেঠুর সামনেই সেই যেবার ভেলোরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হল নীলদাদা

প্রাইভেট কলেজ তোঅনেক খরচ নিয়ম করে মাসে মাসে হয়ত টাকা পাঠাতে পারব না তুই এদিকটা সামলে নিস,’ বাবাকে বলেছিল জ্যেঠু

তখন বলেছিল দাদা, ‘হ্যাঁ সে তো নিশ্চয়ই অসুবিধে হবে এমন কাজ না করাই ভালো তবে রানা, দেখিস তোর এমন অসুবিধে হবে নাপ্রাইভেট কলেজেও ভর্তি করতে হবে না আমাদের পিয়ার অঙ্কে মাথা খুব এমনিই কলেজে ভর্তি হয়ে যাবে

 তারপরই তো ঠাম্মির শরীর খারাপ হল সেরিব্রাল স্ট্রোক জ্যেঠু এল তিনদিন পরঠাম্মি তখন বিপদ কাটিয়ে ফেলেছে জ্যেঠু খুব রাগারাগি করল বাবার ওপর কেন ভালো নার্সিংহোমে ভর্তি না করে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করেছে ঠাম্মিকে

টাকা দরকারআমাকে বলিস নি কেন?’

বাবার মুখটা দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল পিয়ার বাবা যে কোনোদিনই কাউকে টাকার কথা বলবে না, দাদা সেকথা একবারও বলল না আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিল সেবারই বাবাকে অত কথা বললকিন্তু তারপর ঠাম্মির হাসপাতালের সব কাগজ নিয়ে চলে গেল পিয়া ভেবেছিল ঠাম্মিকে বোধহয় নিয়ে যাবে নিজের কাছে, বড় ডাক্তার দেখাতে কিন্তু মা বলেছিলতা নয় অফিসে ক্লেম করবে বলে ওসব কাগজ লাগবেবাবা-মায়ের মেডিকেল বিল ক্লেম খুব অবাক লেগেছিল পিয়ার, বাবাও তো নিজের অফিস থেকে এই টাকা ক্লেম করতে পারত হাসপাতালের সব খরচ তো বাবাই দিয়েছে কেন দাদা একবারও কিছু বলল না জ্যেঠুকে? মা-কে বলেছিল পিয়ামা চুপ করিয়ে দিয়েছিল, ‘বাবা শুনলে রাগ করবে পিয়াওসব বড়দের ব্যাপার

বড়দের ব্যাপার বড়দের নানা ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছে হয় পিয়ার বিশেষত বড়ছেলে নিয়ে দাদা-ঠাম্মির কথাগুলো নিয়ে

ঠাম্মির শরীর খারাপের পর আবার টাকা পাঠানো শুরু করেছিল জ্যেঠু দাদার সামনেই বাবাকে বলেছিল, ‘আমি টাকা পাঠাববাবা-মা দুজনের ওষুধ পথ্য সব যেন ঠিক ঠিক হয়

দাদা-ঠাম্মি কেউ একবারও বলে নিএতদিন ধরে এই ওষুধপথ্য সব বাবা করে এসেছে ঠিক ঠিক সময়মতো চেক-আপচোখের ছানি অপারেশনপাড়ার ওষুধের দোকানে মাসকাবারি ব্যবস্থাকম্পাউণ্ডার জয়ন্তকাকা এসে নিয়মিত ব্লাড-প্রেশার চেক করে যায়মা রোজ নিজে হাতে আলাদা করে দুজনের শরীর অনুযায়ী খাবার তৈরি করে দেয় দুধ খেলে দাদার অ্যাসিড হয়তাই রোজ ছানা ঠাম্মির সুগারের সমস্যা বলে আলাদা করে তেতো রান্না রোজ

দুজনের কেউ কিচ্ছু বলে নিবরং আলো আলো মুখে দাদা গল্প করেছে সবার কাছে, ‘রাজা এসে সব ব্যবস্থা করে গেছে

ঠাম্মি বলেছে, ‘মাসে মাসে মা-বাবার পথ্য আর ওষুধের জন্যে টাকা পাঠায় ছেলে দূরে থাকেকিন্তু মনটা এখানেই পড়ে থাকে


*****


বড়বৌমার কথাও হয় কেমন ব্যাগ ভর্তি শাড়ি-জামা পাঠায় সবার জন্যে এটা কেউ বলে নানীলদাদা-লালিদিদির পুরোনো জামা সেগুলো নিজের অপছন্দের শাড়িগুলো ছোটবেলায় এসব না বুঝেই খুশি হয়ে লালিদিদির জামা পরেছে পিয়াও

দাদা-ঠাম্মি না- বলুকমা কেন কিছু বলে না কে জানে অপমানবোধ বলে কিছু নেই? বরং পিয়াকেই বোঝাতে বসে, ‘আহাদাদা-দিদির জামা কাপড় ভাই-বোন পরে না? আমরা বোনেরা  তো এইভাবেই বড় হয়েছি তাছাড়া আজকাল জামাকাপড়ের কত দাম বল তোটেকসইরঙ এতটুকু নষ্ট হয় নি... পরলেই বাআমাকেও তো জ্যেঠি কত শাড়ি দেয়আমি নিই না?’

হলুদ ঢাকাইকমলা শিফনঅফ হোয়াইট সিল্ক

লালিদিদি বলেছিল, ‘ঠাকুমা দিয়েছিল সিল্কের শাড়িটাবুঝলি পিয়া? মা ওটা পরবেই নামা তো ঠাকুমাকে পছন্দ করে না আর ওই কমলা শিফনটা? মায়ের ভালো লাগে নিআমার মাসির ছেলের বিয়েতে দিয়েছিল হলুদ ঢাকাইটার আঁচলে ছেঁড়াকাকিমণিকে রিফু করে নিতে বলিস

লালিদিদি নিজে কোনো জামা বেশিদিন পরে না জিন্সসালোয়ারকুর্তিশর্ট টপশার্টস্কার্টলাহাঙ্গা-চোলি। হালফ্যাশনের সব জামা মা বুঝবেই নাতবু বলেছিল পিয়া, ‘আমাদের পাড়ায় এসব জামা কেউ পরে না আমরা তো ক্লাবে পার্টিতেও যাই না এত দামী দামী জামা পরব কোথায়? আমাকে এসব দিও না

মা বলেছিল, ‘তুই কমপ্লেক্সে ভুগতে শুরু করিস না পিয়া বোনের জামা বোন পরে না?’

ক্লাস এইটে পড়া, স্কুলের ডিবেট-চ্যাম্পিয়ন পিয়া তর্ক তুলেছিল, ’সেটা সমানে সমানে হয় মা বাবা যে শান্তিনিকেতন থেকে লংস্কার্টটা এনে দিয়েছিল আমায়লালিদিদির অত পছন্দ হল… তুমি বললে ওকে দিয়ে দিতেআমিও দিলাম নিল ? উল্টে জ্যেঠিমনি তোমাকে স্কার্টটার দ্বিগুন দাম দিয়ে দিলবলল পরের বার শান্তিনিকেতন গেলে ওইরকম একটা কিনে আনতে মনে আছে?’

পিকলু এসব বোঝে না জ্যেঠুর বাড়ি গিয়ে ভালো খাওয়াজ্যেঠুর গাড়িতে ঘোরানীলদাদার সুন্দর জামা প্যান্ট পরে বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দেওয়া নিয়ে আনন্দে থাকে একলা ঘরে পিয়ার চোখের জলও মুছিয়ে দেয়, ‘কাঁদিস না দিভাই মায়ের কথাটাও তো ঠিক আর লালিদির জামাগুলো কাকে দেবে বল? ওর তো ছোট বোন নেই কত কষ্টনা?’

যুক্তিতে ফাঁক নেই কিন্তু আত্মসম্মানটা যে আরো দামী বাবার শুকনো মুখ দেখে বুকের মধ্যে যে কষ্টতার সঙ্গে লালিদিদির বোন না থাকার কষ্ট কি মেলানো যায়?

 

*****


আজ বাবার বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে একটা ছোট গাড়ি কিনেছে বাবাকিন্তু গাড়ি নিয়ে অফিস যায় না বাসে আসতে দেরি হয় দাদা বাইরের ঘরে বসে আছে আজ আনন্দের দিন বাবা এলেই কড়কড়ে দুহাজার টাকা হাতে দেবে, ‘রাজা পাঠিয়েছে রে

ঠাম্মি বলবে, ‘আমাদের ওষুধের টাকাটা এসে গেল,বল?’

দুহাজার টাকায় যে দাদা-ঠাম্মি দুজনের ওষুধের খরচ মেটে নাবাবা সেকথা একবারও বলবে না আর সঙ্গে সঙ্গে পিয়ার মাথা গরম হয়ে উঠবে

এইসব দেখবে না বলেই ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়তে বসেছে পিয়া বাবার গলা শোনা যাচ্ছে, দাদার দরাজ গলায় হাসি পিকলু ছুটে এল, ‘বাবা তোকে ডাকছে দিদিয়া

চাইলেই কি একা থাকতে পারবে পিয়া?

বাঁধাকপির পকোড়াবেগুনীগোল গোল আলু কেটে ব্যসন দিয়ে ভাজা চায়ের আসর বসেছে বাবা হাত বাড়িয়ে দিল, ‘কত পড়বি পিয়া? আয়এখানে বস

আমি খাব না পিয়া বসে নি

খেতে বলি নিআমার কাছে আয় সারাদিন মুখ গুঁজে পড়াবিকেলেও বাইরে বেরোস নি শুনলাম চলএকটু হেঁটে আসি মাথাটা ধরে আছে আমারও

অমনি পিকলু আমিও যাব করে লাফাতে লাগল

নাতুই এখন আমার কাছে পড়তে বসবি এই তো বন্ধুদের সঙ্গে খেলে এলি মা বকে উঠল

বাবার সঙ্গে হাঁটতে যাওয়াটা খুব আনন্দের রোজ সকালে হাঁটতে যায় বাবা মাঝেমাঝেই বাবার সঙ্গে হাঁটতে যায় পিয়াও আবাসনের পেছনের দিকটায় খানিকটা খালি জমি পড়ে আছে এখনো তার ঠিক মাঝখানে একটা টিলা পাহাড় টিলা পেরিয়ে হেঁটে গেলেই লম্বা লম্বা গাছ আগে নাকি ওখানে একটা জঙ্গল ছিল শাল-মহুয়া-বট-অশ্বত্থ-অর্জুন-পলাশ অনেক গাছ এখন জঙ্গলটা নেইকিন্তু একটা দুটো অর্জুন গাছ আছে আর আছে পলাশ, জারুল বাবা পাতা শুঁকে গাছ চেনা শিখিয়েছে বাবার সঙ্গে হাঁটতে গেলে যে এমন কত মজা

টিলার পাশ দিয়ে রাস্তা, কিন্তু বাবা আর পিয়া টিলায় চড়ে জায়গাটা পার হবে বাবা বলবে, ‘কবে আবার সব জমি সমান করে দিয়ে বাড়ি উঠে যাবেগাছগুলো কেটে ফেলে আর্বানাইজেশন হয়ে যাবে... চল পিয়াততদিন পাহাড়ে চড়ে নে

আর্বানাইজেশন শহর গড়ে ওঠা দাদাও গল্প করেআগে কেমন একটা ছোট জঙ্গল ছিল পুকুর ছিল এখানে শহর বাড়াতে মানুষ সব গ্রাস করে নিচ্ছে ঠিক মানুষের সম্পর্কের মতই স্নেহ-মায়া-মমতা-সহানুভূতি-সহমর্মিতার মতো আবেগকে গ্রাস করে ফেলছে শহরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধন-সম্পদ আর পণ্য-সংস্কৃতির অভ্যাস

গাছগুলোর ওপর মায়া পড়ে গেছে পিয়ার আহাআর যেন ওদের কেটে না ফেলে টিলার ওপর বড় গাছ নেইকিন্তু অনেক ছোট ছোট গাছ বাবা বলে, ‘আগাছা

কিন্তু তার মধ্যেই ফুটে থাকে সাদা-হলুদ ফুল ঝিরিঝিরি সবুজ পাতা কতগুলো কাঁটা কাঁটা গাছ আছেতাতে মাঝেমাঝে ফুটে ওঠে হলুদ প্রজাপতির মতো উজ্জ্বল ফুল সেই ফুলের পাপড়িগুলো খুব মজার, ঠোঁটে লাগিয়ে জোরে ফুঁ দিলে বাঁশির মতো আওয়াজ হয় নাম-না জানা আগাছার নাম দিয়েছে পিয়া বাঁশিফুলের গাছ

বাবার সঙ্গে হাঁটতে গেলে এমন কত মজা

 

*****


বাবা অবশ্য আজ টিলার দিকে গেল না পায়ে পায়ে পাড়ার ছোট পার্কে এসে বসেছে দুজনে বেশ বুঝতে পারছে পিয়াহাঁটার কথা বললেও বাবা মোটেই পিয়াকে নিয়ে হাঁটতে আসে নি

একটু ভয় ভয় করছে বাবা কোনোদিন বকে নারাগ করে না, কিন্তু এইরকম একা নিয়ে গিয়ে কথা বলে ফিজিক্স পরীক্ষার খাতা বাড়িতে না দেখিয়ে জমা দেবার পরে স্কুল থেকে যেদিন ডেকে পাঠিয়েছিল সেদিনটিউটোরিয়ালে না গিয়ে শিমুলের সঙ্গে সিনেমা যাবার পরেশিবেনকাকুর বাড়ি পুজোর দিন অঞ্জলি দেওয়া নিয়ে তর্ক করার পরমায়ের সঙ্গে মুখে মুখে কথা বলার পর বাবা এইরকম একা একা কথা বলেছে 

ঠাম্মি নিশ্চয় আজ মোমো না খাবার কথাটা নিয়ে নালিশ করেছে মনে মনে শক্ত হল পিয়া যতই নালিশ করুকআজ পিয়া মোটেই ভয় পাবে না

তুই নাকি আজ রাগ করে সারাদিন না খেয়ে আছিস পিয়া?’ বাবার গলাটা নরম

তার মানে নালিশ করেছে মা ঠাম্মি নয় পিয়া যে না খেয়ে আছে,সেটা শুধু মা জানে

কি রে? চুপ করে আছিস যে? খুব রাগ হয়েছে আজ?’

মা বলেছে তোমায়? আমার রাগ হয়েছেসেই কথাটা?’

যদি বলেই থাকেতুই কি আরো রাগ করবি?’ বাবা হাসছে, ‘কেন এত রাগ হয় আজকালবলবি না?’

মুখ নিচু করে বসে রইল পিয়া বললেও কি বাবা বুঝবেবড়রা কি বোঝে কিছুবড়রা শুধু মানিয়ে নিতে বলেযেমন নিজেরা থাকে অন্যায় দেখলেও মানিয়ে নিয়ে থাকা অবশ্য বড়রা ভাবেতাদের কোনো অন্যায় হয়ই না বড় মানেই গুরুজনতাদের সবটাই ঠিক

 আইসক্রীম খাবি পিয়া?’ বাবা বলল

মাথা নাড়াল পিয়া নাআজ আইসক্রীম খাবার ইচ্ছে নেই

তাহলে ফুচকা?’

না

আমাকে বলবি না পিয়া? কেন রাগ হয়েছে আজ? দাদার ওপর রাগ হয়েছে?’

হবে না?’ পলকে মাথাটা গরম হয়েছে, ‘কেন দাদা ওরকম করেজ্যেঠু কি করে দাদা-ঠাম্মির জন্যেওইটুকু টাকা পাঠানো ছাড়া? তুমি আর মা কি অনেক বেশি করো না?’ বলতে বলতে হাঁফ ধরে গেছে পিয়ার, ‘বললেই তোমরা বলবেপিয়া বড়দের নিয়ে কথা বলছে পিয়া অবাধ্যপিয়া অসভ্য

পিয়া তো বড় হয়ে গেছেবড়দের নিয়ে কথা বলতেই পারে বাবা হাসল, ‘আর আমার পিয়া মোটেই অবাধ্যঅসভ্য নয় তবে...

তবে?’

দাদা-ঠাম্মির অবস্থাটা একটু ভাবতে হবে যে তোর জ্যেঠু ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল বাবার খুব আশা ছিল বড়ছেলেকে নিয়ে দাদা সে আশা পূরণও করেছে ধাপে ধাপে এগিয়েছে জীবনের পথে বাবা নিজের সবটুকু দিয়ে ছেলের পাশে দাঁড়িয়েছে সামান্য চাকরি করতআমিও বড় হচ্ছি তখন আমি তো লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম নাবাবার কোনো স্বপ্নই....

কেন এমন বলছ বাবা? তুমি তো সব করো দাদা-ঠাম্মির জন্যে আমি বুঝি কিছুই দেখি না? কিছুই বুঝি নালেখাপড়ায় সবাই ভালো হয়?’

আমার পিয়া বাবাকে খুব ভালোবাসে বাবার গলাটা একটু ছলছল করে উঠল, ‘নিম্নবিত্ত বাড়ির ছেলে আমি বাবার একার আয়ে সংসার চলত মাআমরা দুভাইআমার ঠাকুর্দা-ঠাকুমাদুই কাকাদুই পিসি দশজন মানুষ, আয় শুধু একজনের এমনও হয়েছে যে মা শুধু ভাত ফুটিয়ে দিতে পেরেছে ফ্যানা-ফ্যানা গরম ভাত নুন দিয়ে খেয়েছে সবাই মা সেই ফ্যানটুকু খেয়ে পেটের জ্বালা মিটিয়েছে কাকারা পড়াশোনা করছেদাদা স্কুলে পড়ছে আর আমি তখন লেখাপড়া ছেড়ে নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্নে ছুটে বেড়াচ্ছি পরিবারের সেই অবস্থায় নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন কি বিলাসিতা ছিল না? বলআমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের কোনো আশা পূরণ হয় নি যেটুকু গর্ব সঞ্চয়, সব তোর জ্যেঠুর জন্যে

 

*****


সত্তরের দশকের রক্ত গরম করা দিনগুলো স্বপ্ন দেখার দিন

জানিস পিয়া, আমার সমবয়সীরা স্কুল পাশ করে টপাটপ ভালো ভালো কলেজে পড়াশোনা করছে আর আমি তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি এখান থেকে সেখানে গ্রামেগঞ্জে হাটেবাজারে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছি রাজনৈতিক চেতনায় এলাকা ছেড়ে অ্যাবস্কন্ডেড হয়ে লুকিয়ে আছিরাজনৈতিক কারণে আমার বাবা-মা দিনের পর দিন আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভয়ে কাটিয়েছে

বাবার গলাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, ‘আর তখন তোর জ্যেঠু আস্তে আস্তে সংসারের লাইটহাউস হয়ে উঠেছে। মনের মতো ছেলে স্কুলে টপারহায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয়প্রফেশনাল কলেজে অসাধারণ রেজাল্ট বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে বাবা সর্বশক্তি নিয়ে দাদার উন্নতির সহায় হয়েছে দুই কাকা লেখাপড়া ছেড়ে একজন মুদীর দোকান দিয়েছেআরেকজন রোজগার না করেই বিয়ে করে সংসারী বড় ছেলে ছাড়া কেউ ছিল না যাকে নিয়ে গর্ব করে বাবা

আমি এই গল্পগুলো অনেক শুনেছি বাবা আজ তুমি নিজেকে একজন ফেলিওর বলছ কিন্তু আমি জানিএকটা স্বপ্ন বা ইউটোপিয়াকে বিশ্বাস করে নিজের পড়াশোনা কেরিয়ার বিসর্জন দিয়েছিলে তুমি কিন্তু তাতে তোমার দোষ কোথায়? সাতাত্তরের বিপুল জয়ের পর যখন পার্টির হোল-টাইমার হয়ে ক্ষমতার সিংহাসন উপভোগের সময়তখন তুমি মানবতাবাদী আদর্শবোধ নিয়ে সব ছেড়ে এসেছিলে কারণ তোমার সততা তুমি কিছু পাওয়ার লোভেগুছিয়ে নেবার ইচ্ছেয় রাজনীতি করো নি আমি ঠাম্মির কাছে শুনেছিদিনের পর দিন তুমি মতাদর্শের বদ্ধতায় কষ্ট পেয়েছছটফট করেছ স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় তারপর আপোষ না-করা সেই ছেলেটা জীবনের গন্তব্য বদলেছে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছচাকরিসংসারে স্থিতিদাদা-ঠাম্মির মাথা গোঁজার এই বাড়িতোমার কাকাদের ছেলেদের লেখাপড়াচাকরি সব তুমিএকা আমি সব জানি বাবা তাহলে কেন দাদা-ঠাম্মি তোমাকে নিয়ে গর্ব করবে না? কেন?’

হ্যাঁএক কথায় পার্টি ছেড়েছিল সহজ হয় নি কাজটা মানবিকতা-যুক্তিবোধ-মুক্তাচিন্তার সেই সময়ে রানা পার্টির একজন অ্যাসেট পার্টি ছাড়তে চায় নি রানাকে এলাকার মানুষের অত্যন্ত প্রিয়আদ্যন্ত সত্তীক্ষ্ণধীকর্মক্ষমপ্রতিবাদী যুবকটি পার্টির একজন অ্যাসেট বৈকি সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো সব প্রলোভন জয় করেছিল সেদিন তারপর কঠিন জীবন-সংগ্রাম আজ সংসারে স্থিতি এসেছেবাবা-মায়ের সহায় হতে পেরেছে ঠিকই কিন্তু সত্যিই নিজেকে যোগ্য করে তোলা যায়?

আহা পিয়া বাবার জন্যে কষ্ট হয় তোর?

দাদা-ঠাম্মিকে ভুল বুঝিস না পিয়া আসলে যোগ্য ছেলের জন্যে বাবা-মায়ের অহঙ্কার থাকেই তাছাড়া নিজের সবটুকু দিয়ে দাদাকে কৃতী হাতে সাহায্য করেছেন বাবা সমস্ত পুঁজি এমনকি আমার ঠাকুর্দার জমি বিক্রি করে দাদার বিয়ে দিয়েছিলেন বৌদি খুব বড়লোকের মেয়ে যে

বড়লোক নয়, ধনী লোক পিয়া বলে উঠল

আলতো হেসে পিয়ার মাথায় হাত রাখল বাবাএই বয়সটাই এমন প্রতিবাদের বয়স

হ্যাঁধনী লোক বাবা দাদার জীবনটা সাজিয়ে দিতে কোনো কার্পণ্য করেন নি এই জমি বিক্রি নিয়েই কাকাদের সঙ্গে মনোমালিন্যঅশান্তি কাকার ছেলেদের পাশে তো আমায় দাঁড়াতেই হত আমি বেশি কিছু করি নি পিয়া

তোমার বাবার সব দায়সব কর্তব্য তোমারই কেনবাবাজ্যেঠু যদি এত বাধ্য সন্তানএত গর্বের সন্তানতাহলে জ্যেঠু কেন সব কাজে পাশে নেই? মাসে মাসে দুহাজার টাকা? ব্যস? আর সেই নিয়ে এত কথা?’

আসলে...’ বাবা চুপ করে রইল অনেকক্ষণ পিয়াও বাবা বুঝি বুঝতে পেরেছেকোথায় লাগে পিয়ার?

আসলে তোর জ্যেঠু আমাদের পরিবারের জন্যে সম্মানের জায়গা তৈরি করেছে সমাজে বাবা মাথা উঁচু করে বড় ছেলের প্রতিপত্তির কথা বলতে পারেন সেটাই প্রাপ্তি আমি তো বাবাকে দুশ্চিন্তা ছাড়া কিছু দিতে পারি নি

তবে... একটু ইতস্তত করে বলল বাবা, ‘তোকে একটা কথা বলি পিয়া কাউকে বলিস না সাত মাস হয়ে গেল, দাদা এই দুহাজার টাকাও পাঠায় না নীল বিদেশে যাবার পর থেকেই

তাহলে?  প্রতি মাসে টাকা আসছে যে? আজও তো.... ভেতর থেকে চমক, ‘তার মানে এই টাকাটাও তুমিই দিচ্ছ?’

হ্যাঁবাবা-মা কত খুশি থাকে দেখিস না? অমন কৃতী ছেলে হয়েও বাবা-মায়ের কথা মাথায় রাখে যে কতখানি তৃপ্তি!’ হেসে উঠল বাবা, ‘সন্তানের ভালোবাসা পাওয়া তো ভাগ্যের কথা, না? এই আমি যেমন পেলাম

 

****


অনেক রাতে, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছেপিয়া উঠে এল বারান্দায় আজ মনটা বড্ড মায়া মায়া হয়ে আছে বাবার জন্যে মায়া বাবার জন্যে অহঙ্কার এমন আকাশের মন বাবার!

ড্রয়িংরুম লাগোয়া এই বারান্দায় এসে রাতের আকাশে তারা দেখা পিয়ার প্রিয় অভ্যাস বাবা চিনিয়ে দিয়েছে সপ্তর্ষিকেমরীচি, অত্রি, অঙ্গিরাপুলস্তপুলহক্রতু বশিষ্ঠ ছায়াপথ রোহিণী অরুন্ধতী

আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান.. বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ..

বিস্ময়ে সত্যি বিস্ময়ই জীবন প্রতিমুহূর্তে নতুন বিস্ময় নতুন আবিষ্কারনতুন করে জানাচেনা প্রতিদিনের যাপনের মধ্যে কত চেনা ছক বদলে যাওয়া কত মানবিক সম্পর্কের বিন্যাস অধিকারের লড়াইঅপমানের সত্যি গল্প গোপন কান্নাজমাখরচের হিসেবের বাইরে অলক্ষিত কিছু সংকেত

বাবা ভাবনার দিশাটাই বদলে দিয়েছে আজ বাবার ভাবনার উত্তরাধিকার ছোট ছোট কথাছোট ছোট ভাবনা থেকে মুক্তি মনটা ভরে আছে এমন বাবা কি সবার হয়?

মাথার ওপর হাত রাখল কেউ বাবানাহদাদা দাদা উঠে এসেছে এত রাতে?

তুমি? এত রাতে জেগে আছ দাদা?’

তোর সঙ্গে কথা বলব বলে জেগে আছি সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আসবতাই

আমার সঙ্গে? এত রাতে কেন দাদা? কাল সকালে বললেই তো হত

আয় পিয়া,ঘরে বসি তোকে একটা কথা বলব সকাল থেকে খুব কষ্টে আছিস তুই

না দাদাআর কষ্ট নেই আমি ঠিক আছি এখন

তবু একটু বলি আমার ভারটা নামাই তোর জ্যেঠু টাকা পাঠায়সেই টাকায় আনা খাবার খেতে ইচ্ছে করে না আমারও সত্যি রে যে ছেলে বাবা-মাযের প্রয়োজনে দায়িত্ব অস্বীকার করেতার কাছে নিজেদের কষ্টের কথা বলতে নেই চোখের জলও দেখাতে নেই বড় লজ্জার কাজ সেটা কিন্তু কি করি বল? দুবার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে গেছে তোর ঠাম্মিরতাকে কি করে সত্যিটা বলে আঘাত দিই?

আঘাত কেনদাদাজ্যেঠু তো টাকা পাঠাচ্ছে ঠাম্মির ওষুধের খরচ সে- তো অনেক

তাহলে তোকে সত্যি কথাটা বলেই দিই পিয়া তুই কিন্তু কাউকে বলবি না তোর বাবাকেও না আমি যে সব জানিএটা জানলে রানা কষ্ট পাবে সত্যিটা হলরাজা আর টাকা পাঠায় না সাত মাস হয়ে গেছে

আজই বাবার কাছে খবরটা শুনেছে পিয়াকিন্তু দাদা কি করে জানল?

আমি যাতে বুঝতে না পারিতাই নিজের অ্যাকাউণ্ট থেকে ট্রান্সফার না করে ব্যাঙ্কে ক্যাশ জমা করে রানা প্রথমটা ধরতে পারি নি কিন্তু আমিও তো রানার বাবা মিটিমিটি হাসছে দাদা, ‘নিয়ম করে মাসের পাঁচ তারিখে টাকা চলে আসছেএত গোছানো ছেলে তো নয় রাজাবাবা-মায়ের প্রতি এমন কর্তব্য-বোধ রাজার? অসম্ভব সন্দেহ হল ব্যাঙ্কে জিজ্ঞেস করে জানলামএই শহরেই অন্য অন্য অন্য ব্রাঞ্চে ক্যাশ জমা হয় সব বুঝলাম বুড়ো বাবা-মাকে সুখ দিতে চায় রানা আমার রানা সবচেয়ে কম মনোযোগ পেয়েছে আমার সেই ছেলে

দাদা কাঁপা কাঁপা অশক্ত হাতে পিয়ার ছোট্ট মুঠিটা জড়িয়ে ধরেন, ‘দায় একটা বন্ধন দায়বদ্ধতা সবার থাকে না রে বাবা হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা একরকমসন্তান হিসেবে তোর জ্যেঠুরও যে সেই দায় থাকবে, এমন তো কথা নেই আবার তোর বাবাআমার রানা একাধারে ছেলে আর বাবা হয়ে আগলে রেখেছে আমার সব দায়

মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে, আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে ..ভ্রমি বিস্ময়ে ..

মেঘ আর রোদ্দুরের লুকোচুরিবাস্তব আর অবাস্তবের টানাপোড়েনআলোছায়ার বহমানতায়প্রকৃতি আর প্রত্যয়ের প্রলযে এক প্রতীতির জন্ম রাতের আকাশ থেকে নেমে এসেছে একটা সাদা আলোআকাশের নরম আলো এসে মুছে নিচ্ছে নিচের সবটুকু অন্ধকার

পিয়ার মনটা আলো আলো হয়ে গেল এমন মায়াএমন কষ্ট লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা শুধু বাবাদের থাকে পিয়ার বাবাপিয়ার বাবার বাবা সব বাবাই বুঝি একরকম!

Comments

Post a Comment