বাবা
‘আয় পিয়া, অনলাইন ক্লাস শেষ হল? তোর জন্যেই বসে আছি।‘
দাদার হাতে চায়ের কাপ, সামনে টেবিলের ওপর একটা বাক্স। দেখেই মাথাটা গরম হয়ে গেল। ঠাম্মি বলল, ‘ঠান্ডা হয়ে গেছে। ও বৌমা, একটু গরম করে দাও না!’
সকালে শুনেছিল দাদা আজ ব্যাঙ্কে যাবে। তখন থেকেই মাথাটা গরম হয়ে আছে পিয়ার। ব্যাঙ্ক থেকে ফেরার পথে প্রত্যেকবারের মতই মোমো কিনে এনেছে দাদা। পিয়ার জন্যে মোমো, পিকলুর জন্যে চকোলেট, পেস্ট্রি। আর বাড়ির সবার জন্যে জলভরা সন্দেশ। গত মাসে আইসক্রীম এনেছিল, খায় নি পিয়া। আজ মোমো এনেছে।
‘আমাকে একটা দিবি, দিদিয়া?’ হ্যাংলা পিকলু অমনি ছুটে এসেছে।
পায়ে পায়ে রান্নাঘরের দিকে এগোলো পিয়া, ‘সবগুলোই খেয়ে নে।‘
‘কেন রে? আবার রাগিয়ে দিলি তো দিদিয়াকে? তুই পেস্ট্রি খেলি না? ওটা দিদিয়ার।‘ ঠাম্মি একটু বকল।
‘সবসময় এত রাগ করিস কেন, পিয়া? মোমোর বাক্সটা আনলি না? নিয়ে আয়, গরম করে দিই,’ মা বলল।
‘আমি মোমো খাব না। দুপুরে কি খাবার করেছ?‘
‘আজ যে শুক্রবার, সব নিরামিষ রান্না। তোর জন্যে বেগুনভাজা করছি। আলুপোস্ত আছে। গরম ভাতে ঘি দেব।‘
‘আমি নিরামিষ খাব না। আমাকে একটু পাস্তা বানিয়ে দিতে পারবে?’
‘ও পিয়া, সেইজন্যেই তো দাদা চিকেন-মোমো এনেছে তোর জন্যে। দু’তিনরকম মোমো আছে।‘ ঠাম্মি উঠে এসেছে। উত্তর দিল না পিয়া। একটু দাঁড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে সরে গেল ঠাম্মি।
‘কেন এমন করিস পিয়া? ঠাম্মি তোর গুরুজন না? অমন ব্যবহার করতে হয়? কথার উত্তর পর্যন্ত দিলি না। ঠাম্মি-দাদা দু:খ পাবে, মোমো খেয়ে নে। ব্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে উল্টো-রাস্তায় সিটিসেন্টারে গিয়ে দোকান খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করে তোদের জন্যে খাবার কিনে এনেছে বুড়ো মানুষটা।‘
‘আমি আনতে বলেছি? প্রতি মাসে এই এক নাটক। আমার ভালো লাগে না মা।‘
‘নাটক বলছিস কেন? খুশি হয়েই তো...’
‘ওঁর খুশি নিয়ে উনি থাকুন না, আমাদের খুশি দেখানোর দরকার কি? মাসে দু’হাজার টাকা, সেই টাকা দেখানোর জন্যেই তো এই মোমো-পেস্ট্রি-মিষ্টি? সারাদিন ধরে এবার গল্প চলবে, বড়ছেলে কত দায়িত্ববান! আর আমার বাবা যে সারা মাস ধরে সব খরচ টানছে একা? তুমি যে ওঁদের সব ফাই-ফরমাশ খাটছ? সেসব নিয়ে খুশিটা তো দেখতে পাই না?‘
বলতে না বলতে পিকলু ছুটে এসেছে, ‘মা, দাদা বলছে পোস্তর বড়া খাবে।‘
‘আচ্ছা। পোস্তবাটা আছে তো, করে দিচ্ছি। দাদাকে বলো, একটু পরেই খেতে দিয়ে দিচ্ছি।‘
‘না বৌমা, অত আশকারা দিও না তো। যা হয়েছে, তাই দাও। আমার পান...’
‘ওই তো, পানের ডিবেয় পান সেজে রেখেছি মা। বাবাকে কিছু বলবেন না আপনি, এই একটা দিনই তো বাবা ছেলেমানুষের মতো খুশি থাকেন।‘ মা হাসল।
সাধে কী রাগ হয়ে যায় পিয়ার? মা নিজেই তো অবোধ ছেলেমানুষের মতো ব্যবহার করছে। ‘জলপাইয়ের চাটনি করেছ বৌমা?’ ঠাম্মি এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়েছে, ‘রানাকে বলেছিলাম জলপাই আনতে।‘
‘হ্যাঁ মা, আপনার ছেলে জলপাই এনেছে। ওই তো চাটনি হয়ে গেছে।‘
ডাইনিং-টেবিলে বাটি করে সাজিয়ে রাখা চাটনি, ডাল, পালংশাকের ঘন্ট, আলু-পোস্ত, ফুলকপির ডালনা। ঢাকা খুলে খুলে দেখল ঠাম্মি।তারপর দাদাকে বলল, ‘অনেকক্ষণ বসে আছ, একটু ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো। পোস্তর বড়া করে বৌমা খেতে দেবে।‘
‘এখানেই বসি, পিয়া মোমো খাবে। একটু দেখি।‘
‘পিউ সোনা, মামনি আমার, যাও। একটা অন্তত মোমো খাও। দাদা হাতে করে এনেছেন...‘
মায়ের পিউসোনা ডাক মানেই ভুলিয়ে ভালিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়া। একটুও নরম হয় নি পিয়া, ‘আচ্ছা মা, তুমি কি কিছুই বোঝো না? নাকি সব বুঝেও এমন বোকার মতো থাকো?’
‘কি বলছিস পিয়া? মায়ের সঙ্গে কেউ এমন করে কথা বলে?’
‘অনেক দু:খে বলছি মা। সেই কোন সকালে রান্নাঘরে ঢুকেছ, তারপর বাটি বাটি সাজিয়ে রেখেছ রান্না করে... এখন আবার হুকুম হল পোস্তর বড়ার। তুমি যে একটা মানুষ, তা ওঁরা মাথায় রাখেন না। প্রতিমাসে এই একদিন ওঁদের প্রাণে পুলক জাগে, আর খেটে খেটে মরবে তুমি। কেন? আমার বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করে সারা জীবন ধরে সবাইকে দেখছে, ওঁদের সব সামলাচ্ছে, হুকুম মতো বাজার করছে, তারপরও একদিনের জন্যে ওঁদের মুখে বাবার বা তোমার জন্যে কোনো প্রশংসা শুনি না। আর এই একদিন দু’হাজার টাকা নিয়ে এত দেখানো!’ বলতে বলতে হাঁফ ধরে গেল।
‘আস্তে আস্তে। ঠাম্মি শুনতে পাবেন।‘ মা এসে মাথায় গালে হাত বুলিয়ে দিল, ‘এত রাগ ভালো নয় মা। গুরুজনদের সম্বন্ধে এমন করে বলতে নেই, ভাবতেও নেই।‘
এক ঝটকায় মায়ের হাত সরিয়ে দিল পিয়া, ‘তোমাকে বলে লাভ নেই মা। নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। তুমি বুঝবে না। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও তুমি....’ চোখে জল এসে গেল, কথা শেষ না করেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল পিয়া।
******
যাবেই বা কোথায়? নিজের বলতে একটা ঘর নেই পিয়ার। দু’কামরার ফ্ল্যাট, বাবা লোন নিয়ে কিনেছে, মাসে মাসে ইএমআই কাটে। দাদু-ঠাম্মির ঘরটাই পিয়ার পড়ার ঘর। দাদা ঘরে গিয়ে শুয়েছে, ঠাম্মিও কাছে বসেছে। আজ খুব আনন্দ যে। কত গল্প হবে এখন। পিয়া যে অঙ্ক করতে করতে উঠে গেছে, খাতাটা এখনো খোলা আছে, দেখেও ঘরে ঢুকে আছে দু’জনে। ভাল্লাগে না। একটা নিজের জায়গা নেই বাড়িতে। সে অবশ্য পিকলুরও নেই। বাবা-মায়ের ঘরে পিকলুর পড়া।রাতে বসার ঘরে ডিভানে ঘুমোয় পিয়া, পিকলু বাবা-মায়ের সঙ্গে।
আর ওদের? দোতলা বাড়ি। ডুপ্লেক্স। ওরা বলে, ডুপ্লে। নীলদাদার পৈতের সময় যাওয়া হয়েছিল সবাই মিলে, আবার লালিদিদির বিয়ের সময় যেতে বলবে বোধহয়। এমনি তো যেতে বলে না। কত্ত বড় বাড়ি, ওপরে চারটে ঘর নিচে তিনটে।নিচে বড় লম্বা হলঘর, সেখানে পার্টি হয়েছিল। ওপরে রান্নাঘর, লাগোয়া ডাইনিং-হল। সেটাও অনেক বড়, পিয়াদের দুটো ঘর ধরে যাবে এমন। নীলদাদা-লালিদিদির আলাদা ঘর,আবার স্টাডি,মিউজিক-রুম।
নিচে দুটো গেস্টরুম, পিয়ারা সবাই তার একটায় ছিল। অন্যটায় শান্তিপুরের পিসি-ঠাম্মার ছেলে-বউ, পৈতেয় এসেছিল ওরাও। দাদা-ঠাম্মি ওপরের একটা ঘরে ছিল, যদিও ওটা নিজেদের ঘর নয়। অত বড় ডুপ্লে বাড়িতে দাদা-ঠাম্মির কোনো ঘর নেই। জ্যেঠিমার মা-বাবার একটা ঘর আছে কিন্তু। এই কথাটা বলতে গিয়ে মায়ের কাছে ওই পৈতেবাড়িতে বকুনি খেয়েছিল পিয়া।
ওই একবারই বড়ছেলের বাড়িতে গেছিল দাদা-ঠাম্মি। সেই নিয়ে এখনো গল্প করে সবার কাছে। ছেলের বাড়ি কত বড়, ঘরে ঘরে এয়ার কন্ডিশনার, কতরকম জিনিস, মডিউলার কিচেন, সুন্দর সুন্দর কাচের বাসন, সবুজ লনে বেতের চেয়ার, লনের দোলনা… গল্প আর শেষ হয় না।
এখন তো গল্প করার বিষয় আরো বেড়েছে। নীলদাদা বিদেশে পড়তে গেছে, লালিদিদি হায়দ্রাবাদে চাকরি করতে গেছে। যদিও ওরা কলকাতা এলেও এ বাড়িতে থাকে না। জ্যেঠু-জ্যেঠিমা এসে জ্যেঠিমার বাপের বাড়িতে ওঠে, এবাড়িতে দেখা করে যায়। নীলদাদা একবার একা এসেছিল, তাজ বেঙ্গলে ছিল। এবাড়িতে দেখা করতেও আসে নি। তবু আলো আলো মুখে ওদের গল্প করে দাদা। ওদের জন্মদিনে ফোন করে, ঠাম্মি রোজ ওদের সবার নাম করে পুজো করে।
মা বলে, ‘এই নিয়ে তোর খারাপ লাগে কেন পিয়া? কতখানি ভালোবাসার মন থাকলে এমন করে সব নাতি-নাতনিকে জড়িয়ে থাকা যায়, বল? কোনো চাহিদা নেই ছেলেদের কাছে, তাদের সুখ দেখেই সুখী বাবা-মা। এগুলো দেখতে পাস না পিউ?’
দেখতে পায় না মা নিজেই। ‘ছেলেদের’ বলল না মা? ওটা শুধুই একজন ছেলের জন্যে। ছোট ছেলেকে নিয়ে দাদা-ঠাম্মির এই আবেগ দেখা যায় না। বাবার চাকরি নিয়ে বড় মুখ করে গল্প করার ইচ্ছে হয় না। মা যে দাদা-ঠাম্মির সেবা করে এত, সে নিয়ে কোনো কথা শোনা যায় না। পিয়া-পিকলুর কোনো অ্যাচিভমেন্ট দেখতেই পায় না। হ্যাঁ, পিয়ার যে অঙ্কে খুব মাথা সেকথা একবার বলেছিল জ্যেঠুর সামনেই। সেই যেবার ভেলোরের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হল নীলদাদা।
‘প্রাইভেট কলেজ তো, অনেক খরচ। নিয়ম করে মাসে মাসে হয়ত টাকা পাঠাতে পারব না। তুই এদিকটা সামলে নিস,’ বাবাকে বলেছিল জ্যেঠু।
তখন বলেছিল দাদা, ‘হ্যাঁ সে তো নিশ্চয়ই। অসুবিধে হবে এমন কাজ না করাই ভালো। তবে রানা, দেখিস তোর এমন অসুবিধে হবে না, প্রাইভেট কলেজেও ভর্তি করতে হবে না। আমাদের পিয়ার অঙ্কে মাথা খুব, ও এমনিই কলেজে ভর্তি হয়ে যাবে।‘
তারপরই তো ঠাম্মির শরীর খারাপ হল। সেরিব্রাল স্ট্রোক। জ্যেঠু এল তিনদিন পর, ঠাম্মি তখন বিপদ কাটিয়ে ফেলেছে। জ্যেঠু খুব রাগারাগি করল বাবার ওপর। কেন ভালো নার্সিংহোমে ভর্তি না করে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করেছে ঠাম্মিকে।
‘টাকা দরকার, আমাকে বলিস নি কেন?’
বাবার মুখটা দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল পিয়ার। বাবা যে কোনোদিনই কাউকে টাকার কথা বলবে না, দাদা সেকথা একবারও বলল না। আরো একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিল সেবারই। বাবাকে অত কথা বলল, কিন্তু তারপর ঠাম্মির হাসপাতালের সব কাগজ নিয়ে চলে গেল। পিয়া ভেবেছিল ঠাম্মিকে বোধহয় নিয়ে যাবে নিজের কাছে, বড় ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু মা বলেছিল, তা নয়। অফিসে ক্লেম করবে বলে ওসব কাগজ লাগবে, বাবা-মায়ের মেডিকেল বিল ক্লেম। খুব অবাক লেগেছিল পিয়ার, বাবাও তো নিজের অফিস থেকে এই টাকা ক্লেম করতে পারত। হাসপাতালের সব খরচ তো বাবাই দিয়েছে। কেন দাদা একবারও কিছু বলল না জ্যেঠুকে? মা-কে বলেছিল পিয়া, মা চুপ করিয়ে দিয়েছিল, ‘বাবা শুনলে রাগ করবে পিয়া, ওসব বড়দের ব্যাপার।‘
বড়দের ব্যাপার। বড়দের নানা ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছে হয় পিয়ার। বিশেষত বড়ছেলে নিয়ে দাদা-ঠাম্মির কথাগুলো নিয়ে।
ঠাম্মির শরীর খারাপের পর আবার টাকা পাঠানো শুরু করেছিল জ্যেঠু। দাদার সামনেই বাবাকে বলেছিল, ‘আমি টাকা পাঠাব, বাবা-মা দুজনের ওষুধ পথ্য সব যেন ঠিক ঠিক হয়।‘
দাদা-ঠাম্মি কেউ একবারও বলে নি, এতদিন ধরে এই ওষুধপথ্য সব বাবা করে এসেছে ঠিক ঠিক। সময়মতো চেক-আপ, চোখের ছানি অপারেশন, পাড়ার ওষুধের দোকানে মাসকাবারি ব্যবস্থা, কম্পাউণ্ডার জয়ন্তকাকা এসে নিয়মিত ব্লাড-প্রেশার চেক করে যায়, মা রোজ নিজে হাতে আলাদা করে দু’জনের শরীর অনুযায়ী খাবার তৈরি করে দেয়। দুধ খেলে দাদার অ্যাসিড হয়, তাই রোজ ছানা। ঠাম্মির সুগারের সমস্যা বলে আলাদা করে তেতো রান্না রোজ।
দু’জনের কেউ কিচ্ছু বলে নি, বরং আলো আলো মুখে দাদা গল্প করেছে সবার কাছে, ‘রাজা এসে সব ব্যবস্থা করে গেছে।‘
ঠাম্মি বলেছে, ‘মাসে মাসে মা-বাবার পথ্য আর ওষুধের জন্যে টাকা পাঠায় ছেলে। দূরে থাকে, কিন্তু মনটা এখানেই পড়ে থাকে।‘
*****
বড়বৌমার কথাও হয়। কেমন ব্যাগ ভর্তি শাড়ি-জামা পাঠায় সবার জন্যে। এটা কেউ বলে না, নীলদাদা-লালিদিদির পুরোনো জামা সেগুলো। নিজের অপছন্দের শাড়িগুলো। ছোটবেলায় এসব না বুঝেই খুশি হয়ে লালিদিদির জামা পরেছে পিয়াও।
দাদা-ঠাম্মি না-ই বলুক, মা কেন কিছু বলে না কে জানে। অপমানবোধ বলে কিছু নেই? বরং পিয়াকেই বোঝাতে বসে, ‘আহা, দাদা-দিদির জামা কাপড় ভাই-বোন পরে না? আমরা বোনেরা তো এইভাবেই বড় হয়েছি। তাছাড়া আজকাল জামাকাপড়ের কত দাম বল তো? টেকসই, রঙ এতটুকু নষ্ট হয় নি... পরলেই বা! আমাকেও তো জ্যেঠি কত শাড়ি দেয়, আমি নিই না?’
হলুদ ঢাকাই, কমলা শিফন, অফ হোয়াইট সিল্ক।
লালিদিদি বলেছিল, ‘ঠাকুমা দিয়েছিল সিল্কের শাড়িটা, বুঝলি পিয়া? মা ওটা পরবেই না, মা তো ঠাকুমাকে পছন্দ করে না। আর ওই কমলা শিফনটা? মায়ের ভালো লাগে নি, আমার মাসির ছেলের বিয়েতে দিয়েছিল। হলুদ ঢাকাইটার আঁচলে ছেঁড়া, কাকিমণিকে রিফু করে নিতে বলিস।‘
লালিদিদি নিজে কোনো জামা বেশিদিন পরে না। জিন্স, সালোয়ার, কুর্তি, শর্ট টপ, শার্ট, স্কার্ট, লাহাঙ্গা-চোলি। হালফ্যাশনের সব জামা। মা বুঝবেই না, তবু বলেছিল পিয়া, ‘আমাদের পাড়ায় এসব জামা কেউ পরে না। আমরা তো ক্লাবে পার্টিতেও যাই না। এত দামী দামী জামা পরব কোথায়? আমাকে এসব দিও না।‘
মা বলেছিল, ‘তুই কমপ্লেক্সে ভুগতে শুরু করিস না পিয়া। বোনের জামা বোন পরে না?’
ক্লাস এইটে পড়া, স্কুলের ডিবেট-চ্যাম্পিয়ন পিয়া তর্ক তুলেছিল, ’সেটা সমানে সমানে হয় মা। বাবা যে শান্তিনিকেতন থেকে লংস্কার্টটা এনে দিয়েছিল আমায়, লালিদিদির অত পছন্দ হল… তুমি বললে ওকে দিয়ে দিতে, আমিও দিলাম। নিল ও? উল্টে জ্যেঠিমনি তোমাকে স্কার্টটার দ্বিগুন দাম দিয়ে দিল, বলল পরের বার শান্তিনিকেতন গেলে ওইরকম একটা কিনে আনতে। মনে আছে?’
পিকলু এসব বোঝে না। জ্যেঠুর বাড়ি গিয়ে ভালো খাওয়া, জ্যেঠুর গাড়িতে ঘোরা, নীলদাদার সুন্দর জামা প্যান্ট পরে বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দেওয়া নিয়ে আনন্দে থাকে। একলা ঘরে পিয়ার চোখের জলও মুছিয়ে দেয়, ‘কাঁদিস না দিভাই। মায়ের কথাটাও তো ঠিক। আর লালিদির জামাগুলো কাকে দেবে বল? ওর তো ছোট বোন নেই। কত কষ্ট, না?’
যুক্তিতে ফাঁক নেই। কিন্তু আত্মসম্মানটা যে আরো দামী। বাবার শুকনো মুখ দেখে বুকের মধ্যে যে কষ্ট, তার সঙ্গে লালিদিদির বোন না থাকার কষ্ট কি মেলানো যায়?
*****
আজ বাবার বাড়ি ফিরতে দেরি হচ্ছে। একটা ছোট গাড়ি কিনেছে বাবা, কিন্তু গাড়ি নিয়ে অফিস যায় না। বাসে আসতে দেরি হয়। দাদা বাইরের ঘরে বসে আছে। আজ আনন্দের দিন। বাবা এলেই কড়কড়ে দু’হাজার টাকা হাতে দেবে, ‘রাজা পাঠিয়েছে রে।‘
ঠাম্মি বলবে, ‘আমাদের ওষুধের টাকাটা এসে গেল,বল?’
দু’হাজার টাকায় যে দাদা-ঠাম্মি দু’জনের ওষুধের খরচ মেটে না, বাবা সেকথা একবারও বলবে না। আর সঙ্গে সঙ্গে পিয়ার মাথা গরম হয়ে উঠবে।
এইসব দেখবে না বলেই ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়তে বসেছে পিয়া। বাবার গলা শোনা যাচ্ছে, দাদার দরাজ গলায় হাসি। পিকলু ছুটে এল, ‘বাবা তোকে ডাকছে দিদিয়া।‘
চাইলেই কি একা থাকতে পারবে পিয়া?
বাঁধাকপির পকোড়া, বেগুনী, গোল গোল আলু কেটে ব্যসন দিয়ে ভাজা। চায়ের আসর বসেছে। বাবা হাত বাড়িয়ে দিল, ‘কত পড়বি পিয়া? আয়, এখানে বস।‘
‘আমি খাব না।‘ পিয়া বসে নি।
‘খেতে বলি নি, আমার কাছে আয়। সারাদিন মুখ গুঁজে পড়া, বিকেলেও বাইরে বেরোস নি শুনলাম। চল, একটু হেঁটে আসি। মাথাটা ধরে আছে আমারও।‘
অমনি পিকলু ‘আমিও যাব’ করে লাফাতে লাগল।
‘না, তুই এখন আমার কাছে পড়তে বসবি। এই তো বন্ধুদের সঙ্গে খেলে এলি।‘ মা বকে উঠল।
বাবার সঙ্গে হাঁটতে যাওয়াটা খুব আনন্দের। রোজ সকালে হাঁটতে যায় বাবা। মাঝেমাঝেই বাবার সঙ্গে হাঁটতে যায় পিয়াও। আবাসনের পেছনের দিকটায় খানিকটা খালি জমি পড়ে আছে এখনো। তার ঠিক মাঝখানে একটা টিলা পাহাড়। টিলা পেরিয়ে হেঁটে গেলেই লম্বা লম্বা গাছ। আগে নাকি ওখানে একটা জঙ্গল ছিল। শাল-মহুয়া-বট-অশ্বত্থ-অর্জুন-পলাশ অনেক গাছ। এখন জঙ্গলটা নেই, কিন্তু একটা দুটো অর্জুন গাছ আছে। আর আছে পলাশ, জারুল। বাবা পাতা শুঁকে গাছ চেনা শিখিয়েছে। বাবার সঙ্গে হাঁটতে গেলে যে এমন কত মজা।
টিলার পাশ দিয়ে রাস্তা, কিন্তু বাবা আর পিয়া টিলায় চড়ে জায়গাটা পার হবে। বাবা বলবে, ‘কবে আবার সব জমি সমান করে দিয়ে বাড়ি উঠে যাবে, গাছগুলো কেটে ফেলে আর্বানাইজেশন হয়ে যাবে... চল পিয়া, ততদিন পাহাড়ে চড়ে নে।‘
আর্বানাইজেশন। শহর গড়ে ওঠা। দাদাও গল্প করে, আগে কেমন একটা ছোট জঙ্গল ছিল। পুকুর ছিল এখানে। শহর বাড়াতে মানুষ সব গ্রাস করে নিচ্ছে। ঠিক মানুষের সম্পর্কের মতই। স্নেহ-মায়া-মমতা-সহানুভূতি-সহমর্মিতার মতো আবেগকে গ্রাস করে ফেলছে শহরকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক বৈষম্য, ধন-সম্পদ আর পণ্য-সংস্কৃতির অভ্যাস।
গাছগুলোর ওপর মায়া পড়ে গেছে পিয়ার। আহা, আর যেন ওদের কেটে না ফেলে। টিলার ওপর বড় গাছ নেই, কিন্তু অনেক ছোট ছোট গাছ। বাবা বলে, ‘আগাছা।‘
কিন্তু তার মধ্যেই ফুটে থাকে সাদা-হলুদ ফুল। ঝিরিঝিরি সবুজ পাতা। কতগুলো কাঁটা কাঁটা গাছ আছে, তাতে মাঝেমাঝে ফুটে ওঠে হলুদ প্রজাপতির মতো উজ্জ্বল ফুল। সেই ফুলের পাপড়িগুলো খুব মজার, ঠোঁটে লাগিয়ে জোরে ফুঁ দিলে বাঁশির মতো আওয়াজ হয়। নাম-না জানা আগাছার নাম দিয়েছে পিয়া। ‘বাঁশিফুলের গাছ।‘
বাবার সঙ্গে হাঁটতে গেলে এমন কত মজা।
*****
বাবা অবশ্য আজ টিলার দিকে গেল না। পায়ে পায়ে পাড়ার ছোট পার্কে এসে বসেছে দু’জনে। বেশ বুঝতে পারছে পিয়া, হাঁটার কথা বললেও বাবা মোটেই পিয়াকে নিয়ে হাঁটতে আসে নি।
একটু ভয় ভয় করছে। বাবা কোনোদিন বকে না, রাগ করে না, কিন্তু এইরকম একা নিয়ে গিয়ে কথা বলে। ফিজিক্স পরীক্ষার খাতা বাড়িতে না দেখিয়ে জমা দেবার পরে স্কুল থেকে যেদিন ডেকে পাঠিয়েছিল সেদিন, টিউটোরিয়ালে না গিয়ে শিমুলের সঙ্গে সিনেমা যাবার পরে, শিবেনকাকুর বাড়ি পুজোর দিন অঞ্জলি দেওয়া নিয়ে তর্ক করার পর, মায়ের সঙ্গে মুখে মুখে কথা বলার পর বাবা এইরকম একা একা কথা বলেছে ।
ঠাম্মি নিশ্চয় আজ মোমো না খাবার কথাটা নিয়ে নালিশ করেছে। মনে মনে শক্ত হল পিয়া। যতই নালিশ করুক, আজ পিয়া মোটেই ভয় পাবে না।
‘তুই নাকি আজ রাগ করে সারাদিন না খেয়ে আছিস পিয়া?’ বাবার গলাটা নরম।
তার মানে নালিশ করেছে মা। ঠাম্মি নয়। পিয়া যে না খেয়ে আছে,সেটা শুধু মা জানে।
‘কি রে? চুপ করে আছিস যে? খুব রাগ হয়েছে আজ?’
‘মা বলেছে তোমায়? আমার রাগ হয়েছে, সেই কথাটা?’
‘যদি বলেই থাকে, তুই কি আরো রাগ করবি?’ বাবা হাসছে, ‘কেন এত রাগ হয় আজকাল, বলবি না?’
মুখ নিচু করে বসে রইল পিয়া। বললেও কি বাবা বুঝবে? বড়রা কি বোঝে কিছু? বড়রা শুধু মানিয়ে নিতে বলে, যেমন নিজেরা থাকে। অন্যায় দেখলেও মানিয়ে নিয়ে থাকা। অবশ্য বড়রা ভাবে, তাদের কোনো অন্যায় হয়ই না। বড় মানেই গুরুজন, তাদের সবটাই ঠিক।
‘আইসক্রীম খাবি পিয়া?’ বাবা বলল।
মাথা নাড়াল পিয়া। না, আজ আইসক্রীম খাবার ইচ্ছে নেই।
‘তাহলে ফুচকা?’
‘না।‘
‘আমাকে বলবি না পিয়া? কেন রাগ হয়েছে আজ? দাদার ওপর রাগ হয়েছে?’
‘হবে না?’ পলকে মাথাটা গরম হয়েছে, ‘কেন দাদা ওরকম করে? জ্যেঠু কি করে দাদা-ঠাম্মির জন্যে? ওইটুকু টাকা পাঠানো ছাড়া? তুমি আর মা কি অনেক বেশি করো না?’ বলতে বলতে হাঁফ ধরে গেছে পিয়ার, ‘বললেই তোমরা বলবে, পিয়া বড়দের নিয়ে কথা বলছে। পিয়া অবাধ্য, পিয়া অসভ্য ।‘
‘পিয়া তো বড় হয়ে গেছে, বড়দের নিয়ে কথা বলতেই পারে।‘ বাবা হাসল, ‘আর আমার পিয়া মোটেই অবাধ্য, অসভ্য নয়। তবে...’
‘তবে?’
‘দাদা-ঠাম্মির অবস্থাটা একটু ভাবতে হবে যে। তোর জ্যেঠু ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ায় খুব ভালো ছিল। বাবার খুব আশা ছিল বড়ছেলেকে নিয়ে। দাদা সে আশা পূরণও করেছে। ধাপে ধাপে এগিয়েছে জীবনের পথে। বাবা নিজের সবটুকু দিয়ে ছেলের পাশে দাঁড়িয়েছে। সামান্য চাকরি করত, আমিও বড় হচ্ছি তখন। আমি তো লেখাপড়ায় ভালো ছিলাম না, বাবার কোনো স্বপ্নই....’
‘কেন এমন বলছ বাবা? তুমি তো সব করো দাদা-ঠাম্মির জন্যে। আমি বুঝি কিছুই দেখি না? কিছুই বুঝি না? লেখাপড়ায় সবাই ভালো হয়?’
‘আমার পিয়া বাবাকে খুব ভালোবাসে।‘ বাবার গলাটা একটু ছলছল করে উঠল, ‘নিম্নবিত্ত বাড়ির ছেলে আমি। বাবার একার আয়ে সংসার চলত। মা, আমরা দু’ভাই, আমার ঠাকুর্দা-ঠাকুমা, দুই কাকা, দুই পিসি। দশজন মানুষ, আয় শুধু একজনের। এমনও হয়েছে যে মা শুধু ভাত ফুটিয়ে দিতে পেরেছে। ফ্যানা-ফ্যানা গরম ভাত নুন দিয়ে খেয়েছে সবাই। মা সেই ফ্যানটুকু খেয়ে পেটের জ্বালা মিটিয়েছে। কাকারা পড়াশোনা করছে, দাদা স্কুলে পড়ছে। আর আমি তখন লেখাপড়া ছেড়ে নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্নে ছুটে বেড়াচ্ছি। পরিবারের সেই অবস্থায় নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন কি বিলাসিতা ছিল না? বল? আমাকে নিয়ে বাবা-মায়ের কোনো আশা পূরণ হয় নি। যেটুকু গর্ব সঞ্চয়, সব তোর জ্যেঠুর জন্যে।’
*****
সত্তরের দশকের রক্ত গরম করা দিনগুলো। স্বপ্ন দেখার দিন।
‘জানিস পিয়া, আমার সমবয়সীরা স্কুল পাশ করে টপাটপ ভালো ভালো কলেজে পড়াশোনা করছে। আর আমি তখন পালিয়ে বেড়াচ্ছি এখান থেকে সেখানে। গ্রামেগঞ্জে হাটেবাজারে। সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছি রাজনৈতিক চেতনায়। এলাকা ছেড়ে অ্যাবস্কন্ডেড হয়ে লুকিয়ে আছি, রাজনৈতিক কারণে। আমার বাবা-মা দিনের পর দিন আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভয়ে কাটিয়েছে।‘
বাবার গলাটা কেঁপে কেঁপে উঠছে, ‘আর তখন তোর জ্যেঠু আস্তে আস্তে সংসারের লাইটহাউস হয়ে উঠেছে। মনের মতো ছেলে। স্কুলে টপার, হায়ার সেকেণ্ডারি পরীক্ষায় রাজ্যের মধ্যে দ্বিতীয়, প্রফেশনাল কলেজে অসাধারণ রেজাল্ট। বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। বাবা সর্বশক্তি নিয়ে দাদার উন্নতির সহায় হয়েছে। দুই কাকা লেখাপড়া ছেড়ে একজন মুদীর দোকান দিয়েছে, আরেকজন রোজগার না করেই বিয়ে করে সংসারী। বড় ছেলে ছাড়া কেউ ছিল না যাকে নিয়ে গর্ব করে বাবা।‘
‘আমি এই গল্পগুলো অনেক শুনেছি বাবা। আজ তুমি নিজেকে একজন ফেলিওর বলছ। কিন্তু আমি জানি, একটা স্বপ্ন বা ইউটোপিয়াকে বিশ্বাস করে নিজের পড়াশোনা কেরিয়ার বিসর্জন দিয়েছিলে তুমি। কিন্তু তাতে তোমার দোষ কোথায়? সাতাত্তরের বিপুল জয়ের পর যখন পার্টির হোল-টাইমার হয়ে ক্ষমতার সিংহাসন উপভোগের সময়, তখন তুমি মানবতাবাদী আদর্শবোধ নিয়ে সব ছেড়ে এসেছিলে। কারণ তোমার সততা। তুমি কিছু পাওয়ার লোভে, গুছিয়ে নেবার ইচ্ছেয় রাজনীতি করো নি। আমি ঠাম্মির কাছে শুনেছি, দিনের পর দিন তুমি মতাদর্শের বদ্ধতায় কষ্ট পেয়েছ, ছটফট করেছ স্বপ্নভঙ্গের বেদনায়। তারপর আপোষ না-করা সেই ছেলেটা জীবনের গন্তব্য বদলেছে। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছ।চাকরি, সংসারে স্থিতি, দাদা-ঠাম্মির মাথা গোঁজার এই বাড়ি, তোমার কাকাদের ছেলেদের লেখাপড়া, চাকরি। সব তুমি, একা। আমি সব জানি বাবা। তাহলে কেন দাদা-ঠাম্মি তোমাকে নিয়ে গর্ব করবে না? কেন?’
হ্যাঁ, এক কথায় পার্টি ছেড়েছিল। সহজ হয় নি কাজটা। মানবিকতা-যুক্তিবোধ-মুক্তাচিন্তার সেই সময়ে রানা পার্টির একজন অ্যাসেট। পার্টি ছাড়তে চায় নি রানাকে। এলাকার মানুষের অত্যন্ত প্রিয়, আদ্যন্ত সত্, তীক্ষ্ণধী, কর্মক্ষম, প্রতিবাদী যুবকটি পার্টির একজন অ্যাসেট বৈকি। সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীর মতো সব প্রলোভন জয় করেছিল সেদিন। তারপর কঠিন জীবন-সংগ্রাম। আজ সংসারে স্থিতি এসেছে, বাবা-মায়ের সহায় হতে পেরেছে ঠিকই। কিন্তু সত্যিই নিজেকে যোগ্য করে তোলা যায়?
আহা পিয়া। বাবার জন্যে কষ্ট হয় তোর?
‘দাদা-ঠাম্মিকে ভুল বুঝিস না পিয়া। আসলে যোগ্য ছেলের জন্যে বাবা-মায়ের অহঙ্কার থাকেই। তাছাড়া নিজের সবটুকু দিয়ে দাদাকে কৃতী হাতে সাহায্য করেছেন বাবা। সমস্ত পুঁজি। এমনকি আমার ঠাকুর্দার জমি বিক্রি করে দাদার বিয়ে দিয়েছিলেন। বৌদি খুব বড়লোকের মেয়ে যে।‘
‘বড়লোক নয়, ধনী লোক।‘ পিয়া বলে উঠল।
আলতো হেসে পিয়ার মাথায় হাত রাখল বাবা, এই বয়সটাই এমন প্রতিবাদের বয়স।
‘হ্যাঁ, ধনী লোক। বাবা দাদার জীবনটা সাজিয়ে দিতে কোনো কার্পণ্য করেন নি। এই জমি বিক্রি নিয়েই কাকাদের সঙ্গে মনোমালিন্য।অশান্তি। কাকার ছেলেদের পাশে তো আমায় দাঁড়াতেই হত। আমি বেশি কিছু করি নি পিয়া।‘
‘তোমার বাবার সব দায়, সব কর্তব্য তোমারই কেন, বাবা? জ্যেঠু যদি এত বাধ্য সন্তান, এত গর্বের সন্তান, তাহলে জ্যেঠু কেন সব কাজে পাশে নেই? মাসে মাসে দু’হাজার টাকা? ব্যস? আর সেই নিয়ে এত কথা?’
‘আসলে...’ বাবা চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। পিয়াও। বাবা বুঝি বুঝতে পেরেছে, কোথায় লাগে পিয়ার?
‘আসলে তোর জ্যেঠু আমাদের পরিবারের জন্যে সম্মানের জায়গা তৈরি করেছে সমাজে। বাবা মাথা উঁচু করে বড় ছেলের প্রতিপত্তির কথা বলতে পারেন। সেটাই প্রাপ্তি। আমি তো বাবাকে দুশ্চিন্তা ছাড়া কিছু দিতে পারি নি।‘
‘তবে...’ একটু ইতস্তত করে বলল বাবা, ‘তোকে একটা কথা বলি পিয়া। কাউকে বলিস না। সাত মাস হয়ে গেল, দাদা এই দু’হাজার টাকাও পাঠায় না। নীল বিদেশে যাবার পর থেকেই।‘
‘তাহলে? প্রতি মাসে টাকা আসছে যে? আজও তো....’ ভেতর থেকে চমক, ‘তার মানে এই টাকাটাও তুমিই দিচ্ছ?’
‘হ্যাঁ, বাবা-মা কত খুশি থাকে দেখিস না? অমন কৃতী ছেলে হয়েও বাবা-মায়ের কথা মাথায় রাখে, এ যে কতখানি তৃপ্তি!’ হেসে উঠল বাবা, ‘সন্তানের ভালোবাসা পাওয়া তো ভাগ্যের কথা, না? এই আমি যেমন পেলাম।‘
****
অনেক রাতে, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, পিয়া উঠে এল বারান্দায়। আজ মনটা বড্ড মায়া মায়া হয়ে আছে। বাবার জন্যে মায়া। বাবার জন্যে অহঙ্কার। এমন আকাশের মন বাবার!
ড্রয়িংরুম লাগোয়া এই বারান্দায় এসে রাতের আকাশে তারা দেখা পিয়ার প্রিয় অভ্যাস। বাবা চিনিয়ে দিয়েছে সপ্তর্ষিকে।মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত, পুলহ, ক্রতু বশিষ্ঠ। ছায়াপথ। রোহিণী অরুন্ধতী।
‘আকাশভরা সূর্যতারা বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান.. বিস্ময়ে তাই জাগে আমার প্রাণ..’
বিস্ময়ে। সত্যি। বিস্ময়ই জীবন। প্রতিমুহূর্তে নতুন বিস্ময়। নতুন আবিষ্কার, নতুন করে জানা, চেনা। প্রতিদিনের যাপনের মধ্যে কত চেনা ছক বদলে যাওয়া। কত মানবিক সম্পর্কের বিন্যাস। অধিকারের লড়াই, অপমানের সত্যি গল্প। গোপন কান্না, জমাখরচের হিসেবের বাইরে অলক্ষিত কিছু সংকেত।
বাবা ভাবনার দিশাটাই বদলে দিয়েছে আজ। বাবার ভাবনার উত্তরাধিকার। ছোট ছোট কথা, ছোট ছোট ভাবনা থেকে মুক্তি। মনটা ভরে আছে। এমন বাবা কি সবার হয়?
মাথার ওপর হাত রাখল কেউ। বাবা? নাহ, দাদা। দাদা উঠে এসেছে এত রাতে?
‘তুমি? এত রাতে জেগে আছ দাদা?’
‘তোর সঙ্গে কথা বলব বলে জেগে আছি। সবাই ঘুমিয়ে পড়লে আসব, তাই।‘
‘আমার সঙ্গে? এত রাতে কেন দাদা? কাল সকালে বললেই তো হত।‘
‘আয় পিয়া,ঘরে বসি। তোকে একটা কথা বলব । সকাল থেকে খুব কষ্টে আছিস তুই।‘
‘না দাদা, আর কষ্ট নেই। আমি ঠিক আছি এখন।‘
‘তবু একটু বলি। আমার ভারটা নামাই। তোর জ্যেঠু টাকা পাঠায়, সেই টাকায় আনা খাবার খেতে ইচ্ছে করে না আমারও। সত্যি রে। যে ছেলে বাবা-মাযের প্রয়োজনে দায়িত্ব অস্বীকার করে, তার কাছে নিজেদের কষ্টের কথা বলতে নেই। চোখের জলও দেখাতে নেই। বড় লজ্জার কাজ সেটা। কিন্তু কি করি বল? দু’বার সেরিব্রাল অ্যাটাক হয়ে গেছে তোর ঠাম্মির, তাকে কি করে সত্যিটা বলে আঘাত দিই?‘
‘আঘাত কেন, দাদা? জ্যেঠু তো টাকা পাঠাচ্ছে। ঠাম্মির ওষুধের খরচ। সে-ই তো অনেক।‘
‘তাহলে তোকে সত্যি কথাটা বলেই দিই পিয়া। তুই কিন্তু কাউকে বলবি না। তোর বাবাকেও না। আমি যে সব জানি, এটা জানলে রানা কষ্ট পাবে। সত্যিটা হল, রাজা আর টাকা পাঠায় না। ছ’সাত মাস হয়ে গেছে।‘
আজই বাবার কাছে খবরটা শুনেছে পিয়া, কিন্তু দাদা কি করে জানল?
‘আমি যাতে বুঝতে না পারি, তাই নিজের অ্যাকাউণ্ট থেকে ট্রান্সফার না করে ব্যাঙ্কে ক্যাশ জমা করে রানা। প্রথমটা ধরতে পারি নি। কিন্তু আমিও তো রানার বাবা।‘ মিটিমিটি হাসছে দাদা, ‘নিয়ম করে মাসের পাঁচ তারিখে টাকা চলে আসছে, এত গোছানো ছেলে তো নয় রাজা।বাবা-মায়ের প্রতি এমন কর্তব্য-বোধ রাজার? অসম্ভব। সন্দেহ হল। ব্যাঙ্কে জিজ্ঞেস করে জানলাম, এই শহরেই অন্য অন্য অন্য ব্রাঞ্চে ক্যাশ জমা হয়। সব বুঝলাম। বুড়ো বাবা-মাকে সুখ দিতে চায় রানা। আমার রানা। সবচেয়ে কম মনোযোগ পেয়েছে আমার। সেই ছেলে।‘
দাদা কাঁপা কাঁপা অশক্ত হাতে পিয়ার ছোট্ট মুঠিটা জড়িয়ে ধরেন, ‘দায় একটা বন্ধন। দায়বদ্ধতা সবার থাকে না রে। বাবা হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা একরকম, সন্তান হিসেবে তোর জ্যেঠুরও যে সেই দায় থাকবে, এমন তো কথা নেই। আবার তোর বাবা, আমার রানা একাধারে ছেলে আর বাবা হয়ে আগলে রেখেছে আমার সব দায়।‘
‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল মাঝে, আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে ..ভ্রমি বিস্ময়ে’ ..
মেঘ আর রোদ্দুরের লুকোচুরি, বাস্তব আর অবাস্তবের টানাপোড়েন।আলোছায়ার বহমানতায়, প্রকৃতি আর প্রত্যয়ের প্রলযে এক প্রতীতির জন্ম। রাতের আকাশ থেকে নেমে এসেছে একটা সাদা আলো।আকাশের নরম আলো এসে মুছে নিচ্ছে নিচের সবটুকু অন্ধকার।
পিয়ার মনটা আলো আলো হয়ে গেল। এমন মায়া, এমন কষ্ট লুকিয়ে রাখার ক্ষমতা শুধু বাবাদের থাকে। পিয়ার বাবা, পিয়ার বাবার বাবা। সব বাবাই বুঝি একরকম!
অভিভূত হলাম
ReplyDelete