গল্প - ভূপালী রায়




শোক



মা, আমাকে তাড়াতাড়ি খেতে দাও। আজ প্রায় দুবছর পর আমাদের স্কুল খুলেছে, সারে দশটার মধ্যে উপস্থিত থাকতে হবে। আমার ইউনিফর্ম ইস্ত্রি করা হয়েছে তো? স্নান সেরে মাথা মুছতে মুছতে খাবার টেবিলে এসে বসে তাতান। তাতানের মা রাধা থালায় ভাত, মাছের ঝোল নিয়ে ছেলের সামনে রাখে। খাওয়া সেরে স্কুল পোষাক পরে তৈরী হয়ে সাইকেল বের করে।  রাধা তাতানের স্কুলব্যাগে ব‌ইপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসে। তাতান ব্যাগ কাঁধে স্কুলের পথে রওনা দেয়। "সাবধানে যাবি, দুর্গা দুর্গা" বলতে বলতে রাধা রান্না ঘরে ঢুকে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরে। ঠিকে ঝি ময়না এসে বলে, "বৌদি, ছেলে স্কুলে চলে গেছে? আমার মেয়েও স্কুলে গেল। ও পাড়ার বন্ধুরা মিলে, মাস্ক পরে হেটে হেটে গেল। সাইকেলটা এই দুবছরে পরে থেকে থেকে জঙ  ধরে গেছে, ঠিক করে আনতে হবে।"


দশ মিনিটের পথ অতিক্রম করে তাতান স্কুলে পৌছে যায়। অনেক দিন পর বন্ধুদের দেখে ওর খুব আনন্দ হয়। স্কুলের গেটে দারোয়ানকাকু স্যানিটাইজার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সবার হাতে স্যানিটাইজার স্প্রে করে দিচ্ছে। সবাই মাস্ক পরেছে কিনা সেটা দেখছে। যারা মাস্ক পরেনি তাদের মাস্ক দিচ্ছে। একসাথে হুটোপুটি করে নয়, লাইন দিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে ভিতরে ঢুকতে হচ্ছে। তাতানের মনটা খারাপ হয়ে গেল, বন্ধুদের জরিয়ে ধরে, কাঁধে গলায় হাত দিয়ে হাসাহাসি করতে করতে ক্লাসে ঢোকার মজাটাই আলাদা। কিন্তু আজ সবাই একা একা দূরত্ব বজায় রেখে ক্লাসে ঢুকে যাচ্ছে, কেউ কারও সাথে বেশী কথা বলছে না। সবার মুখ ভার। আসলে কেউ কার‌ও মুখ ভালো করে দেখতে পারছেনা। সবার মুখ মাস্কে ঢাকা যে।


ক্লাস শুরুর ঘন্টা বাজলো, ক্লাস টিচার ক্লাসরুমে প্রবেশ করে। সবাই দূরে দূরে দূরত্ব বজায় রেখে বসেছে। রোল নম্বর এক থেকে পঁচিশ পর্যন্ত ছাত্ররা এসেছে। বাকি পঁচিশ জন পরের দিন আসবে। এভাবে একদিন পর পর স্কুলে আসতে হবে। রোল কল করতে করতে পনের নম্বরে এসে টিচার থেমে যায়। দু তিনবার নাম ধরে ডাকার পর অন্য ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে রোল নং পনের ক্লাসে আসেনি কেন? কেউ কোন উত্তর দিতে পারে না। ঐ ছাত্রটি অর্থাৎ সুদীপ তাতানের প্রিয় বন্ধু। ওকে দেখতে না পেয়ে তাতানের মন খুব খারাপ হয়ে যায়। কত আশা নিয়ে ও এসেছিল আজ প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে। ওর বাড়িটা অনেকটা দূরে, একটা নদী পেরিয়ে যেতে হয়, তাই ওর সাথে করোনা আবহে স্কুল বন্ধ চলাকালীন সময়ে তাতান যোগাযোগ করতে পারেনি। আজ ক্লাশের অন্য বন্ধুদের দেখে এবং সুদীপকে না দেখে ওর মন কেমন করতে লাগল। আগামী কাল সরস্বতী পূজো তাই তৃতীয় পিরিয়ডের পর স্কুল ছুটি হয়ে গেল। শিক্ষকদের নির্দেশ মত ছাত্ররা সরস্বতী পূজোর বিভিন্ন কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরল। তাতানের  খুব মন খারাপ লাগছিল। পূজোর আয়োজনে কোন আনন্দ খুঁজে পাচ্ছিল না। শুধু সুদীপের কথা মনে হচ্ছিল।


মনে মনে ভাবল সুদীপের বাড়িতে গিয়ে ওর সাথে দেখা করে আসি, মা জানতে পারবে না, ভাববে তাতান স্কুলেই আছে। বন্ধু রতনকে কথাটা বলতে ও সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে গেল। দুজনে মিলে নৌকায় নদী পার হয়ে গ্রামের মানুষ জনদের জিজ্ঞেস করতে করতে সুদীপের বাড়িতে পৌঁছে গেল। তাতান সুদীপের নাম ধরে ডাকতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পরে সুদীপের মা ওদের সামনে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলল "তোদের বন্ধু আর বেঁচে নেই রে। করোনা দানব ওকে মেরে ফেলেছে।" তাতানের কৈশোর বুকে বন্ধুর মৃত্যুশোক তীরের মত বেঁধে। ও নিজেকে সামলাতে পারে না, অজ্ঞান হয়ে যায়। রতন গ্রামের লোকজনদের সাহায্যে তাতানকে বাড়িতে নিয়ে আসে। তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকা হয়। ডাক্তার তাতানকে পরীক্ষা করেন, বলেন -প্রচন্ড আঘাত পেয়ে ও জ্ঞান হারিয়েছে। তবে চিন্তার কারণ নেই, আমি ঘুমের ওষুধ দিয়ে গেলাম। ওর  বন্ধু হারানোর শোক ভুলতে ঘুম‌ই একমাত্র ওষুধ।

Comments