অ্যালবাম
বুড়া' দা চিনছো আমারে! আমি আভা। কী চিনন যায়? কেমন মজাখান অইলো কও দেহি... একই শহরে আছি .. কারুরে কেউ দ্যাখলাম না একদিন...! আই অহন মিতুল খুঁইজ্যা লইয়া আইলো আমারে... !' কেমন আছো কও ?'
প্রশান্ত ব্যানার্জীর চোখের পলক পড়ে না। তাকিয়ে থাকেন ...আর চোখের কোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। মিতুল এসে মাথার বালিশটা একটু উঠিয়ে সোজা করে বসিয়ে দেয়, বলে, 'বাবা, আভা পিসিকে নিয়ে আসলাম। কথা বলো বাবা, কথা বলো.... তোমাদের সেই কলোনি। দেশ ভাগ হওয়ার পর সেই যে তোমাদের কলোনি-- কলোনির বিকেল আর দুপুর গুলোর কথা বলবে না বাবা?!'
শীর্ণ একটা হাত তুলে প্রশান্ত ব্যানার্জী আঙুলগুলো যেন এগিয়ে দেন ..." কিছু বলবে বাবা",? আঁ আঁ করেন ব্যানার্জী .. কিছু বলতে চান যেন। বলা হলো না।
"বসো তুমি পিসি। আজ দু'মাস ধরে এই চলছে। স্ট্রোকটা হঠাৎ করে হলো । কখনো একটু একটু ভাঙা ভাঙা কথা বলেন, কখনো চেষ্টা করেও পারেন না। রিটায়ারমেন্টের চাপটা আর নিতে পারলেন না বোধহয়। তোমার কথা , দেশ বাড়ির কথা , কলোনির গল্প খুব বলতেন এসব হওয়ার আগে। ভাবলাম , তোমার সঙ্গে যোগাযোগ হলে যদি একটু স্বাভাবিক হয়! একটু চেষ্টা আর কী!! আমারও তো আর কিছু করার নেই পিসি... "!
আভা ঝট করে আবেগ সামলে হেডমিস্ট্রেস উৎপলা নিয়োগী হয়ে গেলেন । টুলটা এগিয়ে নিয়ে যেতে গিয়েও গেলেন না। তবে,একটু গলা নামিয়েই বললেন.., 'কবে বাড়ি নিয়ে আসলি ওনাকে'?!'
'"আর বোলোনা দিন সাতেক আগে নিয়ে এসেও আবার যেতে হয়েছিল। দুদিন হলো এনেছি আবার। " 'আমার খোঁজ তুই পেলি কেমন করে বল্ দেখি? " আসলে, পিসি আমার স্কুল থেকে একটা ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলাম, ওখানে তোমার নাম শুনলাম। শুনলাম, তোমার রিটায়ারমেন্টের আগে কেমন সাজিয়ে গুছিয়ে তুলেছো তোমার স্কুল! আর কী চমৎকার পারফরম্যান্স হচ্ছে স্টুডেণ্টদের কয়েক বছর ধরে.!. চমকে দিয়ে উঠে আসছে শহরতলির একটা স্কুল!... এইসব আর শুনেছিলাম কী! আর, তোমাদের কথা তো সেই কবে থেকে শুনছি ।তোমার কথা , তোমাদের বাড়ি, কলোনির সেই স্কুল.. সব শুনেছি কতোবার করে বাবার কাছে...। দেশেও সেই একখানেই বাড়ি ছিল তো তোমাদের! বাবা তোমাকে নিজে হাতে তৈরি করেছেন। ফিজিক্সে তুমি কতটা এগিয়ে ছিলে --এ গল্প আমরা অনেক শুনেছি পিসি!.....খোঁজ করে করে এবার তোমাদের এলাকায় পৌঁছে গেলাম। বাড়ি খুঁজে পাই না..আসলে আগে এখানে তোমরা থাকতে না তো.. তাই তো...! তাই ঝট করে কেউ চিনতে পারছিল না---" একসঙ্গে অনেক কথা বলে হঠাৎ থেমে যায় মিতুল । দম নেয়।
আভা হাসেন "অহনও কলোনিতেই থাকি বেশি, তবে সে ও বদলাইছে অনেক... ইস্কুল লইয়াই দিন কাইট্যা গেলো। সামনের শীতে রিটায়ারমেন্ট ... অখণ্ড অবসর। চন্দন অনেকদিন ধইর্যা কইতেছে... তাই আইলাম। থাকি কিছুদিন। ভালো লাগলে থাকপো . না হইলে ঐ আবার ব্যাক টু প্যাভেলিয়ান. ...যাবো গিয়া।ওই জায়গার সঙ্গে বড্ড জড়ায়্যা গেছি রে মা... বেশিদিন দূরে থাকতে পারিনা। ওই অহন নেট প্র্যাকটিস ভাবতে পারোস... এহন কদিন ইহান থিকাই ইস্কুল করি... তারপর দেহি.. যামু গিয়্যা। '
"ভাগ্যিস এসেছিলে পিসি। তাই তোমাকে দেখতে পেলাম। কতোদিন ধরে যাওয়া হবে হবে করেও যাওয়া হয় নি বাবার সেই পুরোনো জায়গায়!-- কিন্তু কী করে পারছো পিসি? দূর তো কম না.. রাস্তা অতো খারাপ!!স্কুল যাচ্ছো কী গাড়িতেই না বাসে?"
উৎপলা আবার আভা নিয়োগী হয়ে যান.. ।'পাগল পাইছস? গাড়ি নিমু!! ব্যাকটি পযসা যাবো তো ইয়াই..। হক্কলে কী তুর ঢক ইস্কুটার লইয়্যা ফুস্ ফাস ্ যাবার পারে?" মিতুল হাসে ',তুমি টাকা নিয়ে ভাবছো পিসি? " কস কী পয়সা লইয়্যা ভাবুম না!! কী কষ্ট যে করসি কলোনিতে আইস্যা.. জানোস না.. থাউক গিয়্যা হে না জানোন ই ভালো!"
মিতুল থেমে থেমে বলে ' জানি , তোমাদের অনেক কথাই জানি আমি..."।. 'কস কী মাইয়্যা ..' আভা যেন চমকে ওঠেন হঠাৎ... মিতুল আবার হাসে । আভাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে বলে.. "জানি গো জানি । তোমার পয়সা কিসে যায় জানি আমি। তোমার স্কুলে প্রতিবছর সরস্বতী পুজোতে তোমার সারাবছরের জমানো সব সঞ্চয় তুমি গরীব মেধাবীদের হাতে তুলে দাও তো ,-- সে গল্প আমি কেন, অনেকেই জানে.।.. আর তোমার পি. এফের টাকা তুলে স্কুলের ডেভলোপমেণ্টও করেছো অনেক , সেও তো গল্পই পিসি.. তুমি তো তোমার পেনসেনের কতো পারসেণ্ট যেন যেন স্কুলকেই দিয়ে যাবে , তাই তো?!!"
আভা যেন বাচ্চা মেয়েটি; এমন করে হেসে লুটিয়ে পড়েন... বলেন, "আমার আর আছে কী ক 'দেহি... কী অইবো টাকাগুলান দিয়্যা। আমার দাদার দুই পোলা অমল আর চন্দন খুব যত্নেই রাখছে আমারে.. বাকি টাকা গুলান ওগোরে দিবার পারলেই ব্যস্... আমার মুক্তি!"
কথাটা কিছুই নয়, তবু মিতুল একটু শিউরে ওঠে, আভা নিয়োগীর চোখের কোণ যেন চিকচিক করে বলে মনে হয়। মিতুল ভাবে, যদি তোমার মতোই হতে পারতাম পিসি... !! সব হারিয়ে তবু কোথাও শান্তি থাকতো... দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিতুল। বলে, ' বসো চা করে আনি।' ' --"খাড়া , খাড়া দেহি , তুর কথা শুনি.. ইস্কুলে পড়াস কইলি.. তোর বিয়ার চিঠিও পাইছিলাম... তা সেই খবর টবর ক"! নিভে যাওয়া গলায় মিতুল বলে.. 'সেসব নেই আর পিসি... বিয়েটা ভেঙে গেছে"।
সুতপা এসে দাঁড়ান। স্মিত হাস্যে এগিয়ে আসেন ... কথাবার্তায় ছেদ পড়ে। মিতুল বলে, "মা এসো। সন্ধ্যের পুজোটুজো শেষ করে এসেছো তো..?. পিসিকে এনেছি দেখো খোঁজ করে করে..'। সুতপা এগিয়ে এসে হাত ধরেন আভার... 'এতোদিন কী একবারও মনে পড়লো না আমাদের! সেই যে বিয়ের দিন, বাসর ঘরে অত হৈ হৈ, গান , গল্প তার পরদিন থেকে কোথায় গেলে তুমি..... দেখাই পাই নি তোমার। আমি নতুন বৌ তোমাকে খুঁজবো কোথায় ? কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি?!' আভা যেন হঠাৎ বিচলিত হন.. ' তোমরাও তো খোঁজ নাও নাই। বিয়্যা কইর্যা মইজ্যা গেলা এক্কেরে... তারপর কলোনি ছাড়া হইল্যা বছরের মাথায়।দ্যাহ, এহন .. দুনিয়া কেমনি গোল... মিতুল তাই খুঁইজ্যা আনলো"। সুতপার চোখ ছলছল করে। -- "ও কী মুখখান অমন শুকাইছে ক্যান? বুড়াদারে লইয়্যা চিন্তা অতো কইরো না.. অনেক ঝড় ঝাপটা হে সামলাইছে .. ঠিক হইবো অহন..'" ।
ঝড় কিন্তু সত্যিই আসে। বিকেলের অন্ধকার জমাট বেঁধে ঝড় বৃষ্টি হয়ে নামে রাত আটটায়। মিতুল বলে ' থেকে যাও পিসি-- অনেক দিন পর জমাটি আড্ডা হবে। বাবারও ভালো লাগবে' । -- "কাউরে খুশি করবার পারুম না মিতুল মা -- পারলে আগেই পারতাম । বাদ দে.. চন্দনরে ফোন কর্.. গাড়ি লইয়্যা আসুক.. কাল ইস্কুলে যাইতেই হইবো..কর্, অহনই কর্। আমি ফোন লয়্যা আসি নাই-- "।
রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে ফিরে যান আভা নিয়োগী। ফিরে যাওয়ার আগে সুতপাকে বলেন "সোন্দর সংসার গুছাইছো.. মন ভারি কইরো না। বুড়াদা সময়ে ঠিক হইবো.. ধৈর্য রাইখো।" প্রশান্ত ব্যানার্জীর অপলক দৃষ্টির সামনে মাথা নামিয়ে নিচু স্বরে বলেন,' বুড়াদা ভালো থাইকো.. খুব ভালো হইছে তোমার বউ। খুব সোন্দর হইছে। আগে বলা হয় নাই. অহন কইলাম। আসি... সাইর্যা উইঠো। আবার আসবো অহন।"
মিতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিদায় দেয় তাদের। তার মনে পড়ে বাবার ড্রয়ারের পুরোনো চিঠির মধ্যে সে পেয়েছিল সবুজ কালিতে লেখা মায়াময় এক কিশোরীর চিঠি। তেমন কিছু না, চিঠিতে শুধু অনুযোগ ছিল বুড়াদা কেন অনেক দিন তাদের বাড়িতে যায় না, পড়াশোনা দেখিয়ে আর দেয় না কেন... এমন সব আবেগ আর অনুযোগ।সে চিঠি যে আভা নিয়োগীর তা বাবার গল্পের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বূঝতে পেরেছিল মিতুল ।তাই একটা চান্স নিয়েছিল সে.. যদি বাবা একটু সেরে ওঠে ..।একটু স্বাভাবিক হয়! তাই, লোভীর মতো প্রত্যাশা নিয়ে সে খুঁজে খুঁজে বের করেছিল আভা পিসিকে-- এনে দাঁড় করিয়েছিল বাবার সামনে বড্ড স্বার্থপরের মতো, সব হারানো কাঙালের মতো! সে যে নিজেও যে বড় বেশি তাড়াহুড়ো করে হারিয়ে ফেলেছে ভালোবাসা! তবু , মিতুল ভালোবাসা বুঝতে পারে....
সাতদিন পর প্রশান্ত ব্যানার্জী আবার নার্সিংহোমে ভর্তি হন। আবার আই, সি,ইউ।। ক্লান্ত মিতুল আউটডোরে বসে অপেক্ষা করছিল .. তখনই ফোনটা আসে। ট্রু কলারে নাম দেখায় চন্দন নিয়োগী। ফোনটা ধরে কিছু বলার আগেই ওপাশের গলা বলে , ' মিতুল আমি চন্দনদা .. পিসিমণি কাল রাতে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন .. কিছুই করতে পারলাম না.. সব এমন হঠাৎ করে হয়ে গেলো.. মিতুল, তোমরা ঠিক আছো তো..
মিতুল..!'? 'মিতুল কোনো উত্তর দিতে পারে না। তার আগেই ফোনটা কেটে যায়।
মিতুল বুঝতে পারে খুব দ্রুতই তার পৃথিবীটা আরো ছোটো হতে যাচ্ছে।আরো একা হয়ে যাচ্ছে সে। মা ছাড়া তার পৃথিবীতে আর কিছুই থাকবে না আগামীতে। নার্সিংহোমে ভর্তির আগের রাতে খাবার খাওয়ানোর সময় বাবার গোঙানিটা তার চোখে ভাসে.. কী বলতে চেয়েছিল বাবা.. মিতুলের কেমন যেন মনে হয়-- 'ক্ষমা!!!.. ক্ষমাই 'ছিল সেই শব্দ।'
চোখ বন্ধ করে মিতুল। ভেজা চোখে যেন সে দেখে, প্রবল বৃষ্টিদিনে অপেক্ষারত এক কিশোরীকে -- তাকে ঘিরে থাকা বৃষ্টিধোয়া কদম ফুলের তীব্র গন্ধ পায় মিতুল। আর, অনুভব করে সেই গন্ধ বুকে নিয়ে কে যেন কী যেন নিঃশব্দে এগোয় সে কিশোরীর দিকে, --.
অপেক্ষা করে মিতুল। বন্ধ দরজার অন্য পাশে বসে বসে-- নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে অপেক্ষা করে-- ওপার থেকে কী সংবাদ ভেসে আসে.. সে জন্য অপেক্ষা করে মিতুল ; শুধু সেই জন্যই। মনে মনে যেন সে চায়, প্রার্থনা করে অপার্থিব কোন মিলন!
কদম গন্ধ যেন বড় ব্যাকুল আর প্রত্যাশী হয়ে আছে।. মিতুলের ভেতরে থেকে অন্ধকারটা যেন একটু একটু করে কেটে যায় .. কুয়াশার ও প্রান্তে ক্ষীণ আলোরেখা জাগে!
বড় একটি শ্বাস ফেলে মিতুল।লম্বা শ্বাস ফেলে কোথাও একটু নির্ভার লাগে,। বড় যেন নিশ্চিন্ত হয়, শান্তি পায় মিতুল---। ভালোবাসা আর বিশ্বাস হাতে হাত রেখে চলে যেখানে, সেখানে সবটাই হারিয়ে যায় না এখনও। জীয়নকাঠি ছুঁয়ে এমন করে পৃথিবী বেঁচে থাকে---
অপূর্ব ।এক নিঃশ্বাসে পড়ে সারলাম। খুব ভালো লাগলো ।
ReplyDelete