গল্প - মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী



টান


মস্ত বাড়িটায় অসংখ্য লোকের বাস। বাড়ির বড়ো মেয়ে লিপিকে বেশি কোলেকাঁখে করে অনঙ্গ। লিপির বাবা গিরিন বাঁড়ুজ্যের কেমন বোন হয় যেন সে, গরিব বিধবা, এ বাড়ির আশ্রিতা। লিপির প্রিয় পিসি! তা অনঙ্গ গুণী মানুষ বটে!


তারপর কেটে গেছে তিরিশ বছর! এখন  লিপি গিন্নিবান্নি মানুষ,  বিয়ে হয়ে এসেছে লাহিড়ী বাড়িতে। তারা বেজায় বড়লোক, অতিথি-অভ্যাগত লেগেই আছে। ঠিক এই মুহূর্তে লিপি কিন্তু মাথায় হাত দিয়ে বসে। ওর বর বীরেশ এইমাত্র ফোন করেছে----যাদের আটটায় ডিনারে আসবার কথা ছিল, বিদেশ থেকে আগত দুজন, তমোমি আর ওফিলাই----তারা শুধু বাড়িতে বানানো পিঠে-পায়েসই খাবে। সুতরাং মানদাকে দিয়ে যে  পাঁচমিশেলি সব্জি বানানো হল  আর ও যে ভুনি খিচুড়ি রাঁধতো, বেগুনি করতো,   এ সবই খেতে হবে কাল। আজ করতে হবে পিঠে, লুচি-পায়েস।


এরকম বিশিষ্ট কোনও মানুষ এলে বীরেশ চায় লিপিই রাঁধুক! লিপি রাঁধতে ভালোবাসে, পারেও! কিন্তু হঠাৎই পিঠেপুলি বানানো বেশ ঝামেলার কাজই বটে! আজ অনঙ্গ পিসির কথা বারবার মনে পড়ছে, কি যে ভালো পিঠে বানায় পিসি! হঠাৎ করে গতবারের মতো যদি আজ চলে আসে  বেশ হয়। গতবার সরস্বতী পুজোর দিন পিসি সন্ধেবেলা বিনা খবরে হাজির হয়েছিল নারকেলের তক্তি নিয়ে।


ভাবতে ভাবতে কাজে লেগে পড়ে লিপি,  নারকেলটা পাক দিতে থাকে। শঙ্করী এইমাত্র দুটো নারকেল কুড়িয়ে দিয়ে গেল। শাশুড়ি মা নিচ থেকে পাঠিয়েছেন, ওপরে উঠতে পারেন না উনি। হালকা আঁচে আর একটা উনুনে একটু মুগডাল ভাজে লিপি, সেদ্ধ করে পুলি বানাবে। নারকেলটা পাক হয়ে এলে দুধ জ্বাল দিতে বসায়, দুধপুলি করবে। একটু অন্যমনস্ক ছিল, হঠাৎ পেছনে শব্দ পেয়ে তাকিয়ে অবাক লিপি!


ওমা পিসি! কখন এলে? দোতলায় উঠতে পারলে হাঁটুব্যথা নিয়ে?


সে অনেক কথা! পরে বলবো। এখন তাড়াতাড়ি সুজি বের করে দে, চালের গুঁড়োটা কোথায়? শুনে এলাম নিচে, পিঠে করতে হবে নাকি?


পিসির সাথে জোরদার হাত লাগায় লিপি। দেড়ঘণ্টার মধ্যে তৈরি দুধপুলি, মুগপুলি, পায়েস!


যা যা, শাড়ি পালটে নে। আমিও পরিষ্কার হই। মানদাকে ময়দা মাখতে বল।


সত্যিই, শাড়ি পালটে নিতে না নিতেই অতিথি হাজির সব। সবাই সাপটে খেল পিঠে-পায়েস-লুচি। হাজার স্তুতিবাক্যে বীরেশের মুখে আলোর রোশনাই। ওরাও রাতে তাই খেল সকলে। পিসি কাঁথা মুড়ি দিয়ে দরজা ভেজিয়ে শুয়ে পাশের ঘরে, বললো জ্বর-জ্বর ভাব তার, খাবে না কিছু।


অনেক রাতে ফোনটা দেখার সময় পায় লিপি, মা ফোন করেছিল দু’বার। এতো রাতে ফোন করবে মাকে? থাক, সকালে।


সকালে ফোন করে মাকে----


কাল তো ফোন ধরলি না, অনঙ্গ চলে গেল দু’দিনের জ্বরে, কাল বিকেলে। তোকে খুব আদর করতো। হঠাৎই এমন হল বুঝলি? জানি তোর কষ্ট হবে----, কিন্তু কিছু করার-----


আড়ষ্ট পায়ে পাশের ঘরের দরজার ভেজানো পাল্লা ঠেলে লিপি, সন্তর্পণে। বিছানাটা টানটান পাতা, গতকাল সকালে যেমন ছিল---

Comments