গল্প - শ্যামলী সেনগুপ্ত


ফড়িং        


হাতের পাতা মেলে দিয়েছিল টুকাই লালচে ডানার ফড়িংটাকে উড়তে দেখে। এদিক ওদিক উড়ে বেড়াচ্ছে ফড়িং। হঠাৎ হঠাৎ টুকাইয়ের দৃষ্টির বাইরে চলে যাচ্ছে। খুব ধৈর্য নিয়ে ও দাঁড়িয়ে আছে হাতের পাতা মেলে। এই অবস্থায় ওকে দেখলে বন্ধুরা আড় চোখে তাকিয়ে হাসবে, ও জানে। কেউ কেউ হয়ত পাশে দাঁড়িয়ে খানিক্ষণ ওকে নকল করবে,ভেংচি কাটবে। আমোদ ফুরিয়ে গেলে ওরাও ফিরে যাবে। ওদের অনেক কাজ। টুকাইয়ের কোনও কাজ নেই।


ঝাঁ চকচকে ফ্ল্যাটবাড়ির সারির এক ধারে ওদের বাড়িটা বড্ড বেমানান। বাড়িটার নামডাক ছিল একসময়ে। পোদ্দাররা এই অঞ্চলের অলিখিত জমিদার ছিল। কোনও কালে খয়েরি-হলুদ রং করা দোতলা বাড়িটি যেন পড়ে যাওয়া জমিদারীর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।জরাজীর্ণ তবু কোথাও একটা আভিজাত্যের হালকা ছাপ থেকে গেছে। সেটা  ঘরের লাল রঙের মেঝের জন্য না কি প্রাচীনত্বের বোঝা কাঁধে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ি বারান্দার জন্য, বোঝে না টুকাই।ওসব বোঝার বা জানার আগ্রহ নেই তার।


আরেকটু পরে রোদ আছড়ে পড়বে তার গায়ে। ফড়িংটা গেল কোথায়!দেখার চেষ্টা করে টুকাই। মা ফিরতে ফিরতে দুটো বেজে যাবে।সকালে স্কুল মায়ের। এই বছর রিটায়ার করবে।তারপর ওর ভারি মজা। সারাদিন মায়ের সাথেই কেটে যাবে।শুধু পেছনের বাগানের আসামলতার ঝোপটা একেবারে সাফ করে দিতে বলবে। অন্য গাছগুলোকে বাড়তেই দেয় না। আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে।সেগুলো কেমন মরা মরা হয়ে যায়,শুকিয়ে যায়। যদিও ওর সাদা সাদা ফুলগুলো খুব ভালো লাগে দেখতে তবু অন্য গাছেদের যে কষ্ট হয় সেটা বেশ টের পায় টুকাই। যেবার তাকে ওরকম আষ্টেপৃষ্টে দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলেছিল ওরা। বেঁধে ফেলেছিল দড়ি দিয়ে না কি মালতী পিসি জড়িয়ে ধরেছিল অ্যানাকন্ডার মতো। পিসির নরম ডবকা বুকের ভিতরে ভেঙে যাচ্ছিল তার নরম হাড়গোড়। টুকাই ভাবছিল পিসির গায়ে খুব জ্বর তাই পাগলের মতো করছে। চিৎকার করে মাকে ডাকতে গিয়ে দেখেছিল বাবাকে তাদের দিকে আসতে। এক ঝটকায় মালতী পিসিকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছিল রতন পোদ্দার। সাজানো বাগানের পাঁচিলের গায়ে সিমেন্টের বেঞ্চ। তারই একটাতে দুজনের জাপটাজাপটি আছাড়িপিছাড়ি আর হিসহিস শব্দে চমকে চমকে উঠছিল টুকাই। মা রোজকার মতো স্কুলে চলে গেছে সকালে।টুকাই দৌড়ে যাচ্ছিল গলির মোড়ের ঠাকমাদের বাড়ির দিকে। যতীন কাকা, রথীন কাকারা তো তখন আড়তে।ঠাকমাকে এক্ষুনি জানানো দরকার মালতী পিসির জ্বরের কথা। বাবাও তো কেমন জড়িয়ে ধরে রেখেছে পিসিকে, ওর জ্বর হলে যেমন মা জড়িয়ে রাখে বুকের ভেতর। 


খবরটা এক্ষুনি দেওয়া দরকার। দৌড়ে যাওয়ার আগেই কেমনকরে পিছলে যায় টুকাই পাশের পুকুরে। পুকুরটাও পোদ্দারদের। গভীর। তাই জলের রং কালো।ঐ কালো জলের ওপর কেমন ভেসে আছে এখন লাল রঙের ফড়িং। জল না ছুঁয়ে হাওয়ায় ভাসিয়ে রেখেছে নিজেকে। তিরতির করে কাঁপছে চারটে ডানা। জলে হালকা স্রোত। কেউ কি ঢিল ছুঁড়লো? না কি পা ফসকে সেই পড়ে গেল!


কালো পাথরের মূর্তি যে হাতটা উঁচু করে থাকে দিনরাত, সেই দিকের বগল জুড়ে মাকড়শার জাল। নেতাজী মোড়ের দিল্লি চলো মূর্তিটা বানিয়ে ছিল ও পাড়ার পালজ্যেঠু, সেইই বানিয়ে দিয়েছিল এই মূর্তি। পুকুরের জলে ডুবে যাওয়া ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে রতন পোদ্দার তাকেই বানাতে দিয়েছিল ।


হ্যাঁ,ঢিলই ছুঁড়ছে। ওরা টুকাইয়ের বন্ধু।ঢিল লেগে ছেঁড়া জালটা ঝুলছে। ফড়িংটাও ওখানেই, ঝুলে থাকা জালের পাশে পাখা কাঁপিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই কখন থেকে হাতের পাতা মেলে দাঁড়িয়ে আছে টুকাই আর শেষ পর্যন্ত লালরঙা ফড়িংটা বসল কি না ওর কানের ওপর! টুকাই হাসে। মা ঢুকছে। মরচে পড়া গেটে শব্দ হতেই দোতলার বারান্দার ভাঙা থামের কানাচ থেকে পায়রা ক'টা উড়ে গেল। মা ভেতরে ঢুকে গেলেই আবার এসে বকম বকম জুড়ে দেবে। গেট বন্ধ করে পাঁচিলের পাশ দিয়ে বাগানের দিকে এল মা। টুকাই তাকিয়ে থাকে। মা মূর্তির গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কাকে যেন ফোন করছে। ও! পাল জ্যেঠুর ছেলে খোকনদাকে। বিকেলের দিকে এসে যেন পরিষ্কার করে দেয় মূর্তিটা। কাল পুজো আছে।যোগাড়যন্তর করতে হবে।পাশের পাড়ার বাচ্চাদের বলতে হবে।কাল যে টুকাইয়ের জন্মদিন!


মা ঠিক মনে রেখেছে। ফড়িংটা এতক্ষণে মেলে রাখা হাতের পাতায় এসে বসে। না। ওকে মোটেও বন্দি করবে না টুকাই। ফড়িং ধরলে মা মারা যায়,জানে ও। 


কালো পাথরের মূর্তির চারদিকে আপন ছন্দে নেচে বেড়ায় ফড়িং। আবার কানের উপরে বসে। কিছু বলছে ওকে? কী বলছে? টুকাই কান খাড়া করে। ফড়িং ডানা কাঁপিয়ে লেবু ঝোপের দিকে উড়ে যায়।

Comments

  1. Betway Casino in Ridgefield, Tennessee - Mapyro
    Betway Casino 청주 출장샵 Resort, 용인 출장샵 in Ridgefield, Tennessee is located on 태백 출장마사지 217 acres along the Tennessee River. The property is owned 정읍 출장안마 by the Boyd 김제 출장마사지 Gaming Corporation.

    ReplyDelete

Post a Comment