গল্প - মৃন্ময় সাহা


সহযাত্রী


'কৃষ্ণ কলি আমি তারে বলি 

দেখেছি যে কালো হরিণ চোখ'-

কালো সাদার যুগল বন্দিতে সাদা যে আর সাদা থাকে না, সে হয়ে যায় দিগন্ত বিস্তৃত গোধূলি কালের রক্তিম আভা। বছর তেইশের নিম্ন মধ্যবিত্ত অর্ধ শহরের মেয়েটিকে দেখে মনোবিদ অনাবিল মুখার্জীর  মনে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এমনটাই হলো। এই বয়সে এমন বিষন্নতা ব্যাতিক্রমী না হলেও খুব স্বাভাবিক নয়। ডাক্তার বাবুর সামনে নিস্পলক উদাসীন দৃষ্টিতে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে অথচ খুঁজে পাচ্ছে না। পারিপার্শ্বিক কোনো দিকে নজর নেই। স্বাভাবিক ভাবেই ডাক্তার বাবু একটু বেশি আগ্রহী হলেন। অনেক প্রশ্ন করার পরেও কোনো উত্তর পেলেন না। অগত্যা কৌশল অবলম্বন করতে শুরু করলেন। চাকরি সংক্রান্ত  বিভিন্ন কথা, মেয়ে বলে বাড়িতে অবজ্ঞা ইত্যাদি প্রসঙ্গেও সে ভাবলেশহীন। বুঝলেন সাধারণ কোনো সমস্যা তার মধ্যে নেই। এবার তাহলে কিছু অন্য রকম ভাবা যাক - এই ভাবনায় ডাক্তার বাবু কিছু সময় নিলেন। হঠাৎ গাইতে শুরু করলেন,,,

প্রাণ সখি রে,,

ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে।

- - - - -

আমার মাথার বেণী খুইলা দিমু

তারে আনিয়া দে।

আচ্ছা তোমাদের কৃষ্ণ তো কালো ছিল তাহলে সে কী করে এত প্রেমিকার আইকন হলো। রাধাই বা কেনো এতো বিহ্বল হলো তার প্রেমে? সহসা এমন প্রশ্নে ডাক্তার বাবু ভোরের আলো দেখতে পেলেন। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আবার গাইলেন,,,

গাছে আইলো নয়া ফুল 

কইন্যার মুখে তিন কবুল। 

- - - - - - - - - -

সখি তোরা কই গেলি

শেষ হইয়া যায় জলকেলী।

এবারে মেয়ের কালো মুখ আরো কালো হয়ে গেলো। ডাক্তার বাবু এবার বুঝলেন কালো রং এবং বিয়ে নিয়েই অবসাদের কারণ।'

'কত দিনের সম্পর্ক তোমাদের ' ডাক্তার বাবু জিজ্ঞেস করলেন। এক দিনের। উত্তর পেলেন।' 'একদিন মানে' ডাক্তার বাবু জিজ্ঞেস করলেন। কনে দেখতে এসে পাত্রের ভালোলাগা এবং আবার দেখা হবে - এই প্রতিশ্রুতি পাবার কথা  জানালো। কিন্তু বাস্তবে সেটা হয় নি। পাত্র পক্ষ তাকে নাকচ করে দিয়েছে। সেখান থেকেই তার এই বিষণ্ণতা। এটা বঝে ডাক্তার বাবু সেদিনের কাউন্সিলিং শেষ করলেন।

দ্বিতীয় দিনের কাউন্সিলিং এর শুরুতেই ডাক্তার বাবু নিজের লেখা কবিতা শোনালেন।,,

সব শূন্যই শূন্য হয় না

তুমি সেটা জানো বোধ হয়।

চাওয়া - পাওয়া হীন সম্পর্কেও

কিছু চাওয়া আর কিছু পাওয়া রয়।

তাই নাকি কোথায়? তাই বুঝি

আমি জানি নে তো।

দীর্ঘ প্রহর অপেক্ষা করে

দিনের শেষে টুকরো হাসি টুকরো মজা।

বিনিময়ে এক পৃথিবী প্রশান্তি।

হ্যা। এটাই আমার পাওয়া।

আর চাওয়া সে না হয় থাক।

হেয়ালি করছেন। হুম

গভীরতা থাকে নিশ্চিত স্রোতের বিপরীতে

তাই তো তুমি স্রোতস্বিনী

তাই তো পবিত্র ঝর্নার মত।

আজ তাকে আর বিশেষ বেগ পেতে হয় নি। মেয়ে নিজেই তার সমস্ত দুঃখ একে একে ডাক্তার বাবুকে জানালো। তার গায়ের কালো রং, মধ্যম মানসিকতার মুসলিম পরিবারের মেয়ে হিসেবে পাত্রের মুখে  'আবার দেখা হবে' আশ্বাস যে কত টা বিপর্যয় আনতে পারে সেটা ডাক্তার বাবু ভাবতেও পারে নি।


অনাবিল মুখার্জী সম্ভ্রাত পরিবারের সদস্য।শুধু অর্থেই নয় মানসিকতায়, আদর্শে, আধুনিকতায় সর্বজন স্বীকৃত। একমাত্র পুত্র তারই ভাব শিষ্য। পত্নী বিয়োগ এর পর রোগী সেবাকেই একমাত্র অবলম্বন করে নিয়েছেন। পূত্র লেখাপড়া শেষ করে  শহরেই নামকরা কলেজে অধ্যাপনা করছেন। পিতা পুত্রের বন্ধন ভীষণ মজবুত।উপার্জনের একটা অংশ দিয়ে অনাবিল বাবু পুত্র কে না জানিয়ে মধ্য কলকাতায় একটা মাঝারি আয়তনের বাড়ি বানিয়েছেন। সেখানে কোনো দিন থাকা হয় নি তার। যথা সময়ে ছেলের বিয়ে দিয়ে কিছুদিন পর এতদিনের মায়া ত্যাগ করে হঠাৎ কলকাতার বাড়িতে বসবাসের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করলেন। যাওয়ার সময় ছেলে কে ডেকে বললেন তার কলকাতার আবাসের কথা। সেখানে তিনি পাকাপাকি ভাবে থাকতে চান আর সেটা কে বৃদ্ধাশ্রম বানাতে চান সেটাও বললেন।ছেলের  প্রবল আপত্তিতেও তিনি অনড়। এই সময়ে তাদের কিছু প্রাইভেসি দরকার সেটা ছেলেকে বোঝালেন। দুরত্ব বজায় থাকলেই তাদের সম্পর্কে কোনো মলিনতা আসবে না সেটাই বললেন।


মধ্য কলকাতার এই বৃদ্ধাবাস টি এখন সেরা। অনাবিল বাবু সকল নিয়ে এখন বেশ আছেন। সবাই সেখানে এক তারার একটি তারেই বাধা। সারা বছর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সকলেই আন্তরিক ভাবে অংশগ্রহন করে থাকে। এই ভাবেই পরিবারের সকল সদস্য  ভুলেই গেছে তাদের নিজ নিজ পরিবারের সকল গ্লানি। সামাজিক চেতনা বাড়ানো আর সামাজিক উন্নয়ন এখন এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম উদ্দেশ্য। বিভিন্ন বৃদ্বাবাসের  মধ্যে সমন্বয় সাধন করা তাদের মধ্যে অন্যতম।


তখন শরৎ কাল। সূর্যমামার বাৎসরিক জীবনে ভাটার টান। আকাশে নীল ক্যানভাসে সাদা তুলোর টান। বাতাসে শিউলির মাদকতা আর ঘাসে শিশির বিন্দু। দূরে কোথাও কাশ বন ফুলে ফুলে সাদা। এমন কালে আমরা বাঙালির মনে আগমনীর বার্তা নিশ্চিত ভেবে অনুরণন সৃষ্টি করে। আপন জনকে কাছে পাওয়ার এ এক বার্ষিক মহা সম্মেলন। আনন্দ মানে না ধর্মের বিভাজন। তাই তো তিনি আনন্দময়ী। কিন্তু এই বৃদ্ধাবাসের আবাসিক দের আনন্দ কোথাও জেনে থমকে থাকে। বাইরের খুশির তরঙ্গ কেনো জানি না ভিতরে প্রবেশ করে না। মহাবিশ্বের যেমন কোনো বাতাবরণ থাকে না ঠিক তেমনি এ যেনো এক একটি ক্ষুদ্র বিশ্ব। অনাবিল বাবু উত্তর দক্ষিণ মধ্য কলকাতার বিভিন্ন আবাসিক নিয়ে আয়োজন করলেন পুজো পরিক্রমা আর সুন্দর বন ভ্রমণ। একটা ছোট স্টিমার দু দিনের জন্য ভাড়ায় নিলেন। সেখানেই খাওয়া দাওয়া সাংস্কৃতিক আয়োজন। দশমীর বিকেলে তখন বাতাসে বিদায়ের সুর। সকলে স্টিমারে বসে পর্যায়ক্রমে গান কবিতা নাচ প্রদর্শনে ব্যাস্ত। শুধু পেছনের  দুটো আসনে উপবিষ্ট দুজন  বাদে। বিদায়ের সুর তাদের যেনো আরো বিষাদময় করে তুলেছে। ক্যাপ্টেন অনাবিলের  দৃষ্টিগোচর হয় নি সেটা। কাছে সুযোগ মনোবিদ কৌশলে কিছু কথা বলার পর নারী পুরুষ দুজনেরই সম্বিত কিছুটা ফিরলো। 'নূরজাহান যে জীবন তুমি পিছনে ফেলে এসেছো তাকে কেনো বার বার কাছে ডেকে কষ্ট পাচ্ছ, আমরা এখন নতুন পথের পথিক, এ পথে কোনো পিছু টান নেই শুধুই এগিয়ে যাওয়া ঠিক এই জাহাজ টির মত শান্ত ধীর অথচ ছান্দিক।'  পাশে বসে থাকা সেলিম এর কাছে নূরজাহান নাম খুব খুব পরিচিত মনে হচ্ছিল। বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া দুটো কাজল  নয়না  দুটো চোখের আর্তি আজও তাকে   কেমন উদাসিন করে তুলে। সেদিন যদি পারিবারিক চাপ উপেক্ষা করতে পারতো তাহলে আজ হয় তো দুটো নদীর  দুটি  স্রোত মিলিয়ে নতুন এক প্রবাহ তৈরি করতে পারতো। বার বার মনে পড়ছিল তার কাছে গিয়ে নত জানু হয়ে বলি চলো নূরজাহান আবার একটা সাম্রাজ্য গড়ে তুলি  যে সাম্রাজ্যে থাকবে না কামনা বাসনা শুধুই থাকবে এক সমুদ্র প্রশান্তি  আর  গোলাপ বাগিচা। আর নূরজাহানের মনে আন্দোলিত হচ্ছিল ৩৫ বছরের সেই বিকেলের আশ্বাস 'আবার দেখা হবে'। যৌবনের গণসঙ্গীত গাওয়া গুটি কয়েক কণ্ঠে তখন ধ্বনিত হচ্ছে -

আমরা যাত্রী একই তরণীর

সহযাত্রী একই  তরনীর

We are in the same boat, brother

আমরা করবো জয় নিশ্চয়।

Comments