গল্প - অ্যাঞ্জেলিকা ভট্টাচার্য


গুডলাক


তাতাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে। ছোট একটা কালো রঙের পোকা ।পৌ এর চুল বেয়ে উপরে উঠছে। ওমা আরেকটা পোকা ! ততক্ষনে ক্লাসের ম্যামের নজর পরেছে , তাতাই পড়াতে মন দিচ্ছে না। 

- ‘পৌষালীর মাথার দিকে তাকিয়ে কি করছ তাতাই?’ বেশ জোরেই বলল ম্যাম।

তাতাই ঘাবড়ে গেলেও মুখ খুলল না। সে বুঝতে পেরেছে খুব একটা ভালো জিনিস নিশ্চই নয়, যা সে দেখছিল।

পৌষালীকে তো কত করে বলল – ‘পৌ তোর মাথায় পোকা।’

পৌ মুখে আঙুল দিয়ে বলল – ‘এই চুপ আমার মাথায় উকুন আছে।কাউকে বলবি না।’

পৌ কেমন কটমট করে দেখছে এবার তাতাই কে। তাতাই ঢোক গিলে বলল – ‘পৌ এর মাথাটা কেমন পৃথিবীর মতো গোল। আমার গ্লোব মনে হচ্ছিল।’

সবাই হোহো করে হেসে উঠল। ম্যামেরও হাসি পেয়েছে মনে হল । কিন্তু পৌ রেগে ব্যোম। কিছু কথা বলল না।

ম্যাম বোর্ডের উপর চক দিয়ে পৃথিবী এঁকে দিলো। দেখো পৃথিবী কিন্তু পুরো গোল নয়। একটু চ্যাপ্টা। অনেকটা কমলালেবুর মতো।

তাতাই বোর্ডের দিকে তাকাতে তাকাতে মাঝে মাঝে পৌকে দেখছিল। জানে টিফিন বেলায় তার কপালে দুঃখ আছে। আজ টিফিনে তাতাই লুচি আর ঘুগনি এনেছে। পৌএর প্রিয়। ছাতিম গাছের নীচে বসতেই গজগজ করতে করতে পৌ এলো । 

- ‘তাতাই তুই আমার মাথাকে গ্লোব বললি ?’

তাতাই বেচারা থতমত খেয়ে বলল – ‘সত্যি কথাটা বললে কি ভালো হত?’

পৌ এবার চোখ পাকিয়ে বলল – ‘তাহলে আড়ি করে দিতাম।’

তাতাইয়ের মুখে হাসি ফুটেছে। ‘আমরা ক্লাস কেজি থেকে বন্ধু। আড়ি করতি কি ভাবে ?আমি তো ভাবলাম সামনে বছর থ্রি হলে আমাদের বন্ধুত্বর পাঁচ বছর সেলিব্রেট করবো?’

পৌ হাত গুনল – ‘কেজি ওয়ান, কেজি টু, ওয়ান, টু। ওটা ফোর হবে। তাতাই তুই অঙ্কে খুব কাঁচা।’

তাতাই কথা না বাড়িয়ে পৌ এর মুখে লুচি ঘুগ্নি পুরে দিয়েছে – ‘পৌ আমি কিন্তু একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না।’

‘কী?’

‘তোর মাথায় উকুন এলো কী করে? মা একদিন বাবাকে বলছিল আমাদের কাজের মাসির মেয়ের ফুলির মাথায় উকুন আছে। মা ওষুধ দিয়েছিল। আর বলেছিল – ফুলির মাথায় যখন উকুন। বিমলা তোমার মাথাতেও উকুন ।

খবর্দার এই বাড়িতে কাজ করতে হলে একদম পরিষ্কার থাকতে হবে। পৌ তুই স্নান করিস না? নোংরা থাকিস?’

পৌ রেগেই আগুন। - ‘একদম বাজে কথা বলবি না। রোজ সাবান দিয়ে স্নান করি। মাথায় শ্যাম্পু দি। আমার বাড়িতে যে মিমি দিদি থাকে, আমাকে যে দেখাশোনা করে।’ এবার এদিক ওদিক তাকিয়ে পৌ তাতাই এর কানের কাছে মুখটা নিয়ে এলো। - ‘মিমিদিদির মাথায় উকুন।  তুই কিন্তু মাকে একদম বলবি না। মিমিদিদি খুব ভালো।

আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলে, লুডো খেলে, খাওয়ার সময় গল্প বলে।’

তাতাই মাথা দোলায় – ‘এবার বুঝেছি তোর মাথায় কেন উকুন। কিন্তু উকুনরা আমাদের মাথার থেকে রক্ত খেয়ে নেয়। মনে হয় বুদ্ধিও খেয়ে নেয়। ওরা আমাদের বন্ধু নয়। তুই আজকেই ওষুধ দিবি মাথায়। মিমি দিদিকেও দিবি।’

পৌ ভেবেছিল বুঝি ব্যাপারটা খুব মজার এবার মাথা চুলকে বলল – ‘ঠিক আছে বলব মিমিদিদিকে ওষুধ দিয়ে দিতে মাথায়। কাল তো স্কুল ছুটি। কিন্তু মা বাবার ছুটি নয় ।ভালোই হবে জানতে পারবে না। ’পৌ মুখ ব্যাজার করে বলল – ‘কিন্তু তাতাই উকুন আমার খুব লাকি । মাথায় উকুন আসার পর থেকে থাম্মা বিছানায় একটু উঠে বসেছে। আমি অঙ্কে পঞ্চাশে পঞ্চাশ পেয়েছি । এই সপ্তাহে একদিনও বকা খাইনি।’

তাতাই গালে হাত দিয়ে কিছু ভাবল তারপর বলল – ‘তোকে যদি আমি একটা গুডলাক দি তাহলে?’

‘কী সেটা ?’

‘আমি যখন যেখানে চড়ুই পাখি দেখি গুনে রাখি। তারপর সেগুলকে বিপদে পড়লে ব্যবহার করি।’

পৌ হেসেই কুটিপাটি – ‘কিছুই বুঝলাম না । কীভাবে ব্যবহার করিস ? আমাদের ওখানে একটাও চড়ুই পাখি নেই।’

‘ধুর বোকা আমাদের ওখানেও কি আছে নাকি? আমাদের বাড়ির পিছনে একফালি জমি আছে। কিন্তু গাছ নেই।মা বাবার সময় নেই গাছ লাগাবার। তাই কোথাও চড়ুই পাখি দেখলে , আমি জমিয়ে রাখি।বাগনানে মামাবাড়িতে মস্ত বাগান। সেখানে অনেকগুলো চড়ুই আসে। পিসির বাড়ি জলপাইগুড়িতেও চড়ুই দেখেছিলাম। ওদের বারান্দার ঘুলঘুলিতে বাসা বেঁধেছে ।ছানাও হয়েছে । সব মিলিয়ে আমার কাছে বত্রিশটা চড়ুই আছে। বিপদে পরলে একেকটা নম্বরের চড়ুই ব্যবহার করি । তোকে আমি পনের নম্বর আর সাত নম্বর চড়ুইটা দিলাম।’

একটা কাগজকে দুভাগ করে প্রথমে দুটো ছোট ছোট পাখি এঁকে দিলো । তার নিচে লিখেদিল পনের নম্বর আর সাত নম্বর চড়ুই। ‘আবার দেখা হবে সোমবার। বলিস কেমন কাজ করেছে আমার চড়ুইগুলো।’

শনি রবি ছুটি থাকলেও শনিবার সময় পায়না পৌ। সকালে টিউশন, দুপুরে নাচের ক্লাস, বিকেলে কম্পিউটার। রবিবার সকালটা গানের ক্লাস। তারপর পৌ একটু খেলা করে। সামনে বছর থ্রি হয়ে গেলে বিকেলটা ব্যাডমিন্টন ক্লাসের জন্য বরাদ্দ হবে। মা বাবার সময় থাকলে রবিবার শপিং মলে যায়। পিতজা বার্গার খায়। ব্যাটারি গাড়িতে চড়ে।

আজ রবিবার হলেও মা বাবা এক বন্ধুকে হসপিটালে দেখতে গিয়েছে। মিমিদিদি গিয়েছে তার দিদাকে দেখতে রাতেই চলে আসবে। পৌ বিকেলে ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষন ব্যল্কনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তা, গাড়ি মানুষ দেখল। তারপর গুটিগুটি পায়ে থাম্মির খাটের কাছে এগিয়ে এলো। থাম্মির কাছে এবেলা সবিতা মাসি থাকে। সন্ধ্যে হলেই চলে যাবে। তখন বিমলা মাসি থাকবে সকাল পর্যন্ত।

সবিতামাসি দুলে দুলে রামায়ন পড়ছে। থাম্মি বসে শুনছে। আগে থাম্মি পড়ত। এখন চোখে ভালো দেখতে পায়না। পৌ কে দেখেই থাম্মি হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। থাম্মি পৌএর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল –‘আজকাল তো এঘরে  আসো না সোনা। আজ চলো গল্প করি আমরা। সবিতাকে বললন – ‘যাও তুমি ওঘরে গিয়ে টিভি দেখো। আমরা দুজনে এখন সিক্রেট গল্প করবো।’

পৌ চমকে উঠল থাম্মি কি তাহলে পৌএর মাথার সিক্রেট জেনে ফেলেছে? কিন্তু এখন তো পৌএর মাথায় একটাও উকুন নেই। মিমিদিদি আর সে দুজনেই ওষুধ লাগিয়ে মাথা শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলেছে।থাম্মির কাঁপা হাতটা পৌএর পিঠে রাখল – ‘কী দিদিভাই কি ভাবছ ? এবার বলে ফেল তোমার সিক্রেট।’

পৌ একটু আমতা আমতা করছিল কারন। প্রতিবার না বললেও থাম্মি ধরে ফেলত তার সব গোপন কথা। এই ছমাস আগেও থাম্মি তাকে স্কুলের জন্য তৈরী করে দিত। ফেরার পর ব্যাগ চেক করত। ক্লাসে কারোর পেন্সিল নিয়ে এলে থাম্মি বলত – ‘এমা এটা তো তোমার নয়!’  পৌ কিছু বলার আগেই বলত – ‘যার থেকে এনেছ তাকে ফেরত দিয়ে দেবে কাল। আর সরি বলবে।’ থাম্মি পুরো ব্যপারটা বুঝলেও পৌ কে কোনোদিন চোর বলেনি। বরং গল্প শুনিয়েছে চুরি করলে কেউ ভালো বলে না। পৌ বুঝে গিয়েছে কারোর কোন জিনিস না বলে নিতে নেই। তাকে চুরি বলে। চুরি করলে কেউ ভালোবাসে না।

‘কী হল পৌ চুপ কেন ?’

থাম্মিকে জড়িয়ে ধরল পউ – ‘থাম্মি আমি মাথায় উকুন পুষে ছিলাম। ভেবেছিলাম ওটা আমার গুডলাক।’

থাম্মি অবাক হয়ে বলল – ‘উকুন! কে দিলো?’

- ‘মিমিদিদি। কিন্তু এখন নেই সব সাফ। মিমিদিদিরও। তুমি কিন্তু বাবা মাকে কিছু বল না। তাহলে মিমিদিকে তাড়িয়ে দেবে। আমি তখন কার সঙ্গে খেলব?’

থাম্মি হেসে ফেলল – তাহলে এখন তোমার গুডলাক নেই?

- ‘আছে তো। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড তাতাই আমায় চড়ুই দিয়েছে।’

থাম্মি এবার ভীষণ অবাক হয়েছে – ‘আমাদের ফ্ল্যাটে চড়ুই রেখেছ ?চড়ুই তো খাঁচায় বাঁচেনা।’

‘উফ না থাম্মি। দাঁড়াও দেখাচ্ছি। বলে দৌড়ে পেন্সিল বক্স থেকে দুটো চিরকুট নিয়ে এলো। একটায় লেখা সাত নম্বর চড়ুই আরেকটায় লেখা পনের নম্বর চড়ুই। ওতে ছোট দুটো পাখি আঁকা।’

- ‘দিদিভাই কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। কী হবে এগুলো দিয়ে?’

- ‘থাম্মি এটাই গুডলাক। সাত নম্বর চড়ুইটা দিয়ে চলো প্রে করি তুমি আবার আগের মতো হাঁটতে পারবে।’

থাম্মি উদাস গলায় বলল – ‘তা কী আর হবে কখনও?’

- ‘ঠিক হবে। আর পনের নম্বর চড়ুইটা রেখেদি।’

- ‘হ্যাঁ। দিদিভাই। রেখে দাও এই শহরে তো আর চড়ুই দেখা যায় না। মোবাইল টাওয়ারের জন্য পাখি হারিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এরাই আমাদের গুডলাক দিদিভাই। পাখি না থাকলে গাছও থাকবে না। পাখিদেরমল থেকে ফলের বীজ ছড়িয়ে যায় কত দূর দূরান্তে। কতো গাছের জন্ম হয়। এখন মানুষ নির্বিচারে গাছ কাটছে। বৃষ্টি কমে গিয়েছে। মাটির ভিতরে জল কমে গিয়েছে। তাপ বেড়ে গিয়েছে। আসলে সবার সঙ্গে সবার যোগ। আরও বড় হলে বুঝতে পারবে। এদের মধ্যে কোন একটা কম হলেই পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়।’

থাম্মি হাসতে হাসতে বলল – ‘পশু, পাখি, গাছ, নদী, পাহাড় এদের জন্য পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে। যদি কোন একটা নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে পৃথিবী ধপাস করে আমার মতো শুয়ে পড়বে।’

রাতে শুয়ে শুয়ে ভাবছিল পৌ। যদি পৃথিবীতে পাখি না থাকে, গাছ না থাকে কি বিচ্ছিরি দেখতে হবে পৃথিবীটাকে। আর জল না থাকলে এক ভয়ঙ্কর অবস্থা হবে। কেউ বাঁচবে না। পৌ বাবার সঙ্গে টিভি তেখবর দেখেছে কত জায়গায় জলের জন্য হাহাকার। তাতাই এর সঙ্গে একটা প্রজেক্ট করতে হবে।থাম্মিকেও নেওয়া যায়। মিমিদিদিকেও সঙ্গে নেবে। প্রজেক্ট এর নাম হবে – “ সেভ ওয়াটার”

সোমবার তাতাইয়ের সঙ্গে দেখা হল পৌ এর। তাতাই খুব উত্তেজিত – ‘কিরে আমার গুডলাক কিছু কাজ দিলো?’

পৌ বিজ্ঞের মতো বলল – ‘রবিবার অ্যাপ্লাই করেছি। সাতদিন দেখি। আমার গুডলাকগুলো তোর জন্য ভাগাতে হল।’

তাতাই হা হা করে হেসে উঠল – ‘যাক এবার তোর পাশে নিশ্চিন্তে বসা যাবে।’

এক সপ্তাহের মধ্যে সত্যি পৌএর থাম্মি হাঁটতে শুরু করেছে। যদিও দুবেলা ফিসিওথেরাপিস্ট এসেছে।তবু এর ফুল ক্রেডিট থাম্মি পৌ এর গুডলাক সাত নম্বর চড়ুই পাখিকেই দিয়েছে। পৌ থাম্মিকে জড়িয়ে বলল – ‘তাতাইকে একদিন আইসক্রিম খাওয়াবো। ও যদি না দিতো গুডলাক চড়ুই তবে তো আমারথাম্মি হাঁটত না।’

থাম্মি এক গাল হেসে বলল – ‘ও যেমন ওর মূল্যবান চড়ুই তোমায় দিয়েছে। তোমারও ওকে কিছু দেওয়া উচিত।’

- ‘কিন্তু আমার তো কিছু নেই থাম্মি।’

থাম্মি ফিসফিস করে বলল – ‘আমার আছে সোনা। বলে আলমারি থেকে ছোট একটা কাঠের বাক্স বার করল। এই দেখো দিদিভাই আমার জমানো কতো ফলের বিজ! এটা ছিল আমার গুডলাক। এর মধ্যে কিছু মাটিতে পুতে দিয়েছিলাম। আম, জাম, কাঁঠাল গাছ হয়েছিল। আমার বাপের বাড়িতে কত ফল হত।’

পৌ হাতে নিয়ে দেখছিল শুকন বীজগুলো। ‘থাম্মি এগুলো পুঁতলে এখন গাছ হবে?’

- ‘না দিদিভাই। আমের আঁটি শক্ত হয়ে গিয়েছে।কাঁঠালের বিজ শুকিয়ে কাঠ।’

পৌএর মুখ শুকনো।‘ও তাহলে কি দেব তাতাইকে?’

- ‘আছে সোনা।’

- ব্যল্কনির থেকে একটা ছোট টব নিয়ে এলো থাম্মি। তাতে একটা আমের চারা। থাম্মির চোখ চকচক করছে –‘তাতাইকে এটা দিলে খুশি হবে না?’

পৌ আনন্দে হাত তালি দিয়ে উঠল। - ‘খুব খুশি হবে। ওদের বাগান আছে। কিন্তু সেখানে গাছ নেই।’

থাম্মি পৌ এর হাতে টবটা দিয়ে বলল – ‘এটা দিয়ে বলবে এই গাছ আমাদের সবার গুডলাক। যখন বড় হয়ে ফল দেবে। অনেক পাখি আসবে। একটা গাছ থেকেই অনেক গাছ হবে। তবে তার আগেই আমাদের এরকম অনেক গুডলাক তৈরী করতে হবে এই পৃথিবীর জন্য।’

Comments