গল্প - সজল কুমার মাইতি


নীলাঞ্জনা সেদিন বাড়ি ফেরে নি


এক


"নীলু, তোর টিফিন বাক্স টেবিলের ওপর রেখেছি। তোর ব্যাগের কাছে। খেয়াল করে ব্যাগে নিয়ে নিবি। ভুল করে ফেলে রেখে চলে যাবি না।" এই কথাগুলি নীলাঞ্জনার মা যোগমায়া দেবীর। নীলাঞ্জনার উদ্দেশ্যে। 


নীলাঞ্জনা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ফর্সা, দীর্ঘাঙ্গী, সুন্দরী। পদার্থবিদ্যায় পোস্ট গ্রাজুয়েট। কলকাতার এক কলেজের ফিজিক্সের শিক্ষিকা।  বর্তমানে পিএইচডি করছে। সুন্দর করে শাড়ি পরে সেজেগুজে কলেজ যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে মায়ের দেওয়া টিফিন ব্যাগে ভরে নিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে দৌড় লাগায়। যেতে যেতে বলে, " মা আসছি। দরজা বন্ধ করে দাও। আজ ফিরতে দেরি হবে। ল্যাব হয়ে ফিরবো।" 


পাঁচতলা বাড়ির টপ ফ্লোরে থাকে নীলাঞ্জনারা। এই বাড়িতে কোন লিফট নেই। হেঁটেই নামতে হয় নীলাঞ্জনাকে। হাত থেকে মোবাইলের ফিতে গলায় ঝুলিয়ে নেয়। মোবাইল ব্লাউজের ভেতরে ঠেলে দেয়। দ্রুত পায়ে ফুলবাগান মোড়ে পৌঁছে দেখে একটা 44 নম্বর বাস আসছে। হাত তোলে। বাস দাঁড়িয়ে যায়। নীলাঞ্জনা পেছনের গেট দিয়ে বাসে উঠে বাঁদিকে একটি খালি সিটে বসে পড়ে। বাস রাজাবাজার হয়ে শিয়ালদা পৌঁছয়। নীলাঞ্জনা বাস থেকে নেমে গলি পথে হাঁটা লাগায়। কলেজে পৌঁছে দ্রুত স্টাফরুমে ঢুকে চক ডাস্টার ও অ্যাটেন্ড্যান্স রেজিস্টার নিয়ে সেকেন্ড ইয়ার অনার্সের ক্লাসে যায়। পরপর দুটি ক্লাস নিয়ে স্টাফরুম পিয়ন বনমালীকে বলে, " বনমালীদা এককাপ চা নিয়ে এসো। ইতুদি, তুমি চা খাবে?" "না। একটু আগেই খেলাম। জানতো আমি চা বেশি খাই না।" ইতুদির উত্তর। " ঠিক আছে। তাহলে একটাই নিয়ে এসো। তাড়াতাড়ি কিন্তু। এরপরে আমার আর একটা ক্লাস আছে।" 


মধ্য কলকাতার এই কলেজে সায়েন্স ডিপার্টমেন্টগুলোতে প্রত্যেকের আলাদা ডিপার্টমেন্টাল স্টাফরুম আছে। আর্টস আর কমার্সের টিচাররা জেনারেল স্টাফরুমে বসেন। তাদের আলাদা কোন ডিপার্টমেন্টাল স্টাফরুম নেই। নীলাঞ্জনার এই ইতুদি বিভাগীয় সহকর্মী। বয়সে নীলাঞ্জনার চেয়ে একটু বড়। দুজনের খুবই বন্ধুত্ব। প্রায় দিন দুজনে একসঙ্গে কলেজ থেকে বাড়ি ফেরে। নিজেদের মধ্যে সুখদুঃখের গল্প হয়। তা এই ইতুদির সঙ্গে গল্প করার মাঝে বনমালীদা চা দিয়ে যায়। চা খেতে খেতে গল্প চলে। ক্লাসের ঘন্টা বাজতে নীলাঞ্জনা আবার চক ডাস্টার ও অ্যাটেন্ড্যান্স রেজিস্টার নিয়ে বেরিয়ে যায়। কলেজ শেষে দুজনে একসাথে বেরোয়। বাসস্ট্যান্ডে এসে নীলাঞ্জনা ইতুকে বলে, " ইতুদি, আজ তুমি একা যাও। আমি একটু ল্যাবে যাব। বাড়ি ফিরতে আজ দেরি হবে।" দুজনে উল্টোদিকের বাসে ওঠে।


ল্যাবে কিছু কাজ করার পর সুপারভাইজার স্যারের রুমে উঁকি দিয়ে দেখে স্যার আছেন কিনা। স্যার নিজের রুমে বসে কাজ করছিলেন। নীলাঞ্জনা জিজ্ঞেস করে, " স্যার, আসবো?" স্যার মুখ নীচু করে কিছু একটা লিখছিলেন। মুখ তুলে নীলাঞ্জনাকে দেখে বলেন, " ও তুমি? এসো।" নীলাঞ্জনা স্যারের রুমে ঢুকে স্যারের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে। " বাহ। আজতো তোমায় খুব সুন্দর লাগছে। ও, হ্যাঁ। বল তোমার কাজ কদ্দূর?" প্রাথমিক লজ্জার জড়তা কাটিয়ে নীলাঞ্জনা বলে, " হ্যাঁ স্যার। মোটামুটি কমপ্লিটের পথে। আপনি যদি একটু সময় দেন, তাহলে মাস ছয়েকে গুটিয়ে আনব।" এই কথা শুনে স্যার  কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকেন। কি যেন চিন্তা করেন। তারপর বলে ওঠেন, " হুম। আগামী কয়েক মাস আমি ভীষণ ব্যস্ত থাকবো। তাছাড়াও আমার একটা ফরেন ইউনিভার্সিটিতে ইনভাইটেড লেকচার আছে। তারপর তোমাকে সময় দিতে পারবো হয়তো।" 


" স্যার, আমার রেজিস্ট্রেশনের পাঁচ বছর হতে আর বেশি বাকি নেই। এরমধ্যে সেমিনারটা না হলে আবার রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। সে অনেক ঝামেলার কাজ। তাছাড়া দেরিও অনেক হয়ে যাবে।"

" দেন হোয়াট ক্যান আই ডু? "

" না স্যার। আপনি যদি একটু সময় দিতেন। আমার তো মোটামুটি কমপ্লিট।"

" ইন দ্যাট কেস ইউ হ্যাভ টু কাম টু মাই হাউস। লেট আস কন্টিনিউ টিল নাইট।"

" স্যার, আমার মা বাবা দুজনই অসুস্থ। বাবার বাইপাস হয়েছে। মায়ের একটা স্টেন্ট বসেছে। আমার পক্ষে এত সময় বাইরে থাকা সম্ভব নয় স্যার। "


" দেন, হাউ ক্যান আই ফাইন্ড টাইম আউট অফ মাই শিডিউল্ড প্রোগ্রাম? ইফ ইউ কান্ট টেক কেয়ার অফ মি, হাউ ক্যান আই টেক কেয়ার অফ ইউ?"

" ওকে স্যার।"

নীলাঞ্জনা ল্যাব থেকে বেরিয়ে দেখে রাত অনেকটাই হয়ে গেছে। একটা ট্যাক্সি ধরে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এইসব কথোপকথনের একটি ইতিহাস আছে। আসলে মহিলারা সুন্দরী হলে তার অনেক মূল্য চোকাতে হয়। নীলাঞ্জনার এই স্যার অবিবাহিত। সুন্দরী নীলাঞ্জনা তার পছন্দের তালিকায় এক নম্বরে। আকারে ইঙ্গিতে অনেকবারই স্যার তার মনের ইচ্ছা নীলাঞ্জনাকে জানিয়েছেন। নীলাঞ্জনা না বোঝার ভান করে উপেক্ষা করেছে। আজ তার মূল্য চোকাতে হচ্ছে। ট্যাক্সিতে বাড়ি যেতে যেতে নীলাঞ্জনা  সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় এই স্যারের কাছে আর সে পিএইচডি করবে না। ডক্টরেট ডিগ্রী না হোলে হবে না। তবু কভি এই ব্যক্তির কাছে নয়। ট্যাক্সি বাড়ির কাছে এসে গেছে। ট্যাক্সি থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে পাঁচতলার ফ্ল্যাটে পৌঁছয়। দরজা খুলে মা জিজ্ঞেস করেন, " আজ এত দেরি হোল কেন রে?"


" ল্যাবে কাজ ছিল। দেরি হয়ে গেল। তুমি তাড়াতাড়ি ভাত বাড়। বড্ড ক্ষিদে পেয়েছে। আমি বাথরুম থেকে ফ্রেশ আসছি।"


এই বলে নীলাঞ্জনা সোফায় ব্যাগ, ওয়াচ আর মোবাইল রেখে নাইটি নিয়ে সোজা বাথরুমে ঢুকে যায়। শাওয়ার ট্যাপ পুরো খুলে তার তলায় দাঁড়িয়ে থাকে। অঝোর ধারায় শীতল জল নীলাঞ্জনার শরীরের প্রতি অঙ্গ, মনের সব ক্লেদ ধুয়ে পরিষ্কার করতে থাকে। 


দুই 


কথায় বলে 

'অতি বড় ঘরনীর না জোটে ঘর

 অতি বড় সুন্দরীর না জোটে বর'

নীলাঞ্জনার ক্ষেত্রে যেন তাই ঘটে চলেছে। দেখতে দেখতে কত বসন্ত পেরিয়ে এল। এখনো বিয়ে হোলো না। মাঝেমধ্যে মায়ের পীড়াপীড়ি তাগাদা কিছুতেই কিছু হওয়ার  নয়। পরীক্ষার ইনভিজিলেশন ডিউটি করার সময় একদিন নীলাঞ্জনাদের কলেজের মর্নিং সেকশনের এক টিচারের সঙ্গে পরিচয় হয়। নীলাঞ্জনার ভাল লাগে ভদ্রলোককে। ধীরে ধীরে এই ভাললাগা ভালবাসায় পরিনত হয়। দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়। দুই বাড়িতে এই খবর জানাজানি হয়। বিয়ের শানাই বেজে ওঠে। দুজনে বিবাহ বন্ধনে বাঁধা পড়ে। 


আজ নীলাঞ্জনার ফুলশয্যা। সকাল থেকে শানাইের সুরে উৎসব উৎসব মেজাজ। উস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের শানাই বাজনার ক্যাসেট অবিরাম বেজেই চলেছে। লোকজনে নীলাঞ্জনার গোটা শ্বশুর বাড়ি গমগম করছে। চারদিকে আলোর রোশনাই। নীলাঞ্জনা আজ পারলার থেকে সেজে এসেছে। একে সুন্দরী আজ আরও যেন সুন্দর লাগছে। সবার নজর আজ নীলাঞ্জনার দিকে। সবাই ব্যস্ত অথিতি আপ্যায়নে। রাত বাড়তে থাকে। একে একে সবাই যে যার বাড়ি ফিরে যায়। অনুষ্ঠান স্থল ফাঁকা হয়ে যায়। নীলাঞ্জনা ও তার বর খাওয়া দাওয়া করে নেয়। নীলাঞ্জনা সারাদিনের ধকল সামলে ভারী বেনারসি চেঞ্জ করে। ফেস ওয়াশ দিয়ে ভাল করে মুখ হাত পরিষ্কার করে। ফুলশয্যার ঘরে ঢোকার আগে হালকা পোশাক পরে নেয়। ফুল শয্যার ঘর, পালঙ্ক সুন্দর করে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিছানায় গোলাপের পাপড়ি  ছড়িয়ে দেওয়া আছে। নীলাঞ্জনা ফুলশয্যার ঘরের সোফায় বসে এসবই দেখছিল। এমন সময় তার বর অম্লান ঘরে ঢোকে। তসরের পাঞ্জাবিতে সুন্দর দেখাচ্ছিল। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এসে নীলাঞ্জনার কাছে সোফায় বোসলো। কিছুক্ষন দুজনে গল্প করতে থাকে। অম্লান বলে, " নীলু, চল ঘুম পেয়েছে। শুতে চল।" দুজনে পালঙ্কে শুয়ে পড়ে। অম্লান ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে নাইট ল্যাম্প জ্বেলে দেয়। কিছু সময় ঘর নিস্তব্ধ। বাইরে কিছু পথ কুকুরের ডাক। মাঝেমধ্যে গাড়ির হর্ন, রিকশার যাওয়ার শব্দ। একটা পেঁচা হঠাৎ কর্কশকণ্ঠে ডেকে ওঠে। রাতের নিস্তব্ধতা যেন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। ফুলশয্যার ঘরের নিস্তব্ধতা ও ধীরে ধীরে ভঙ্গ হতে থাকে। দুই নরনারীর অনভিজ্ঞতা বেড়া ডিঙিয়ে অভিজ্ঞতায় প্রবেশ শুরু করতে থাকে। অনাস্বাদিত থেকে আস্বাদনের পরম পরিতৃপ্তি, যন্ত্রণার মাধ্যমে পরমানন্দের সন্ধানে যাত্রা শুরু। এই মিলনে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য ও অভিজ্ঞ করতে থাকে। পরম প্রাপ্তির আনন্দ সংগ্রামে কখন রজনী অন্তর্ধান করেছে দুজনের কারুরই খেয়াল নেই। উষাকালের ভোরের স্বল্পালোক, কিছু প্রভাতী পাখির মৃদুগুঞ্জন দুই ক্লান্ত শরীরে ঘুমের মদন বাণ নিক্ষেপ করে। দুজনে নিবিড় ঘুমে ঘুমপরীর দেশে যাত্রা করে।


সকালে প্রতিদিনের রুটিন শুরু হয়ে যায়। নীলাঞ্জনা অম্লান দুজনেই কলেজের যাওয়ার জন্য রেডি হতে থাকে। সদ্য বিবাহিতের কোথায় হানিমুন কোথায় বেড়াতে যাওয়া সবই মাথায় উঠেছে। কলেজে এখন এগজাম ইমারজেন্সি। ছুটি নেওয়া যাবে না। অগত্যা, ফুলশয্যার পরের দিন ও কলেজ থেকে অব্যাহতি নেই। সকালের চা বিস্কুট খেয়েই অম্লান কলেজে দৌড় লাগায়। কিছু সময় পর নীলাঞ্জনার পালা। রাতের আগে দুজনের দেখা হওয়ার উপায় থাকে না। তবুও রাতের মিলন দুজনের সুখপ্রাপ্তি। কিন্তু এই সুখ দীর্ঘস্থায়ী হোলো না। সাংসারিক ছোটখাটো ঝগড়া ঝাটি মন কষাকষি লেগে থাকতো। সে তো সব সংসারের ধর্ম। এই অশান্তির মূল কারন নীলাঞ্জনা প্রতিদিন বাবা মায়ের কাছে যায়। অনেকটা  সময় সেখানে কাটিয়ে তাদের ওষুধ ও অন্য সব ব্যবস্থা করে শ্বশুর বাড়ি ফেরে। স্বভাবতই তার এই বাড়ি ফিরতে বেশ একটু দেরিই হয়। এ থেকেই গন্ডগোলের শুরু। কিন্তু নীলাঞ্জনা স্পষ্ট ভাষায় অম্লানকে জানিয়ে দেয় এটা তাকে করতেই হবে। কিচ্ছু করার নাই। ছোট্টখাট্টো ঝগড়া ঝাটি বাদ বিস্মবাদ থেকে তা একদিন চরমে পৌঁছয়। অম্লান রাগের মাথায় বলে বসে, " দেখ নীলু, এভাবে চলতে পারে না। একসঙ্গে দু নৌকোয় পা দিয়ে চলা যায় না। হয় এ সংসার কর, নয়তো ওই সংসার দেখ।" 


" আমার মা বাবা দুজনে বয়স্ক। দুজনেই অসুস্থ। আমাকে তো তাদের দেখতে হবে। তাদের তো আর কেউ নেই।"

" তা বলে তোমার এই আসল সংসারকে উপেক্ষা করবে? তা তো চলতে পারে না।"

" আমার কিছু করার নেই। অসুস্থ মা বাবাকে ফেলে রেখে শুধু তোমার সংসার সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।"

" এ কথা বলার এত সাহস কোথা থেকে হয় এক কেরানির মেয়ের?"

অম্লানের এই কথায় যেন আগুনে ঘি পড়ে। উত্তেজিত নীলাঞ্জনা আর কোনো কথা না বলে সরাসরি বেডরুমে ঢুকে নিজের জামা কাপড় ট্রলি ব্যাগে গুছিয়ে নিয়ে দোতলার এই বেডরুম থেকে নীচে নেমে যায়। বাড়ির দরজা দিয়ে বাইরের রাস্তায় যায়। হাত দেখিয়ে চলন্ত এক ট্যাক্সিকে দাঁড় করায়। ট্যাক্সির পেছনের দরজা খুলে প্রথমে ট্রলি ব্যাগ রাখে। পরে নিজে ঢুকে দরজা লক করে দেয়। ট্যাক্সিওলাকে বলে, " বেলেঘাটা চলুন। একটু তাড়াতাড়ি চলুন। "

" ম্যাডাম, পঞ্চাশ টাকা বেশি লাগবে। রাত হয়ে গেছে।" ট্যাক্সিওলার দাবি।

" ঠিক আছে। আগে তো চলুন।"


ঘটনার আকস্মিকতায় অম্লান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে। পরে সম্বিত ফিরলে দৌড় লাগায়। " নীলু, নীলু। কোথায় যাচ্ছো? এতো রাত হয়ে গেছে।" বলতে বলতে নীলাঞ্জনার পেছন পেছন রাস্তায় যায়। কিন্তু, ততক্ষণে ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়েছে। নির্বাক অম্লান নির্নিমেষ নয়নে ট্যাক্সির হারিয়ে যাওয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে। রাতের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় নিজের ছায়া দেখে চমকে ওঠে। অজানা আশঙ্কায় দুরু দুরু বুকে ধীর পায়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে।


তিন 


নীলাঞ্জনার মাত্র একমাসের সংসার জীবনের এখানেই ইতি। কিন্তু এই এক মাসের সংসার জীবন নীলাঞ্জনার শরীরে তার স্মৃতি চিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে। শরীরের বায়োলজিক্যাল পরিবর্তনই তার প্রমাণ বহন করছে। নীলাঞ্জনার শরীরে নতুন অতিথি আগমনের বার্তা স্পষ্ট। এর মধ্যে কলেজ, ছাত্র, সহকর্মী সবকিছুই চলছে। বাবা মায়ের সেবাযত্ন কোনো কিছুতেই ফাঁকি নেই। নিয়ম মেনেই সবকিছু এগিয়ে চলে। অম্লান দু একবার কলেজে এসে বোঝাবার চেষ্টা করেছে। তাতে ফল কিছুই মেলে নি। বরং কথা কাটাকাটিতে সম্পর্কের আরও অবনতি হয়েছে। নিয়ম মেনে যথাসময়ে নীলাঞ্জনা একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। দাদুদিদু নাতির মুখ দেখে নতুনভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। নীলাঞ্জনা নিজের অভিশপ্ত অতীতকে ভুলতে থাকে। আরও বেশি করে কলেজের কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। বাবা মায়ের ওষুধ থেকে চেকআপ সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। দুই বয়স্ক অসুস্থ বুড়ো বুড়ির ' অন্ধের যষ্টি', ' নয়নের মনি' হয়ে ওঠে। এদিকে দাদুদিদু নাতি অন্তপ্রান। খেলার সঙ্গী, সর্বক্ষনের সাথী। নাতিকে নিয়েই তাদের সময় কেটে যায়। 


অম্লান এখন মানসিক রুগী। সবকিছুর জন্য সে মনে মনে নীলাঞ্জনাকে দায়ী করে। অস্থিরচিত্ত অম্লান সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। রাত বিরেতে নীলাঞ্জনাকে ফোন করে জ্বালাতন করে। ধমকি দেয়। মেন্টাল টরচার করে। অম্লানের বিধবা মা এই বিষয়ে নিয়মিত মদত যুগিয়ে যান। এমনকি মাঝে মাঝে কলেজে এসে অম্লান ও এই কাজ চালিয়ে যায়। বেশিরভাগ সময় নীলাঞ্জনা ইগনোর করে। যখন সহ্য করতে পারে না, তখন রিঅ্যাক্ট করে। তখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।


একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে দেখে এক পাখিওলা খাঁচার মধ্যে একটি টিয়া পাখি নিয়ে বসে আছে। নীলাঞ্জনাকে দেখে সে বলে, " দিদি, এই টিয়া সুন্দর শিস দিতে পারে। কথা ও বলে। দিদি তুমি একে বাড়ি নিয়ে যাও। ভাল লাগবে। মন খারাপ হলে এর সঙ্গে কথা বলে তোমার সময় কেটে যাবে।" নীলাঞ্জনার কি মনে হল সে খাঁচাসুদ্ধু টিয়া নিয়ে বাড়ি এল। টিয়া পাখি দেখে নীলাঞ্জনার ছেলের আনন্দ আর ধরে না। তার দাদুদিদু ও খুব খুশি। টিয়াকে খাওয়ানো, শিস দেওয়ানো, কথা বলানোয় সবাই মিলে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। স্কুল লাইফ থেকেই নীলাঞ্জনার টবে ফুলের গাছ লাগানো হবি। প্রতিদিন সকাল বিকেল জল দেওয়া, পরিচর্যা করা তার নিয়মিত অভ্যেস। প্রতি সিজনে নতুন নতুন চারাগাছ নিয়ে এসে নিজে হাতে টবে লাগাবে। জল সার দেওয়া তো আছেই। মাঝেমধ্যে গাছগুলো ট্রিম করা সেটা ও নীলাঞ্জনার কাজ। কি ফুল নেই নীলাঞ্জনার বারান্দায় বাগানে? যুঁই, টগর, বিভিন্ন রঙের জবা। অপরাজিতা, দোপাটি। মরুগোলাপ অ্যাডেনিয়াম। কয়েক রকমের ক্যাক্টাস ও আছে। গরমের সময় বেলফুলের গন্ধে ঘরের ভেতর একটা মিষ্টি হাওয়া সবসময় বইতে থাকে। নীলাঞ্জনার মায়ের পূজোর ফুলের যোগান এখান থেকেই আসে। সকাল সন্ধে এই মনোরম দৃশ্য মন ভাল থাকতে সাহায্য ও করে। এই দেখে সব ভুলে থাকা যায়।


আজ নীলাঞ্জনা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। টিয়ার খাঁচায় জল, খাবার দিয়েছে। ফুলের টবের পরিচর্যা করে জল, সার দিয়েছে। মনটা আজ ফুরফুরে আছে। গুন গুন করে গান করছে এইসব কাজের মধ্যে। বাবা মায়ের ঘুম থেকে ওঠার পর সবার জন্য চা করে নিয়ে এসে সোফায় বসে। চা খেতে খেতে তিন জনের মধ্যে কিছু কথাবার্তা হয়। ঘর থেকে ছেলের কান্নার শব্দে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় শোয়া ছেলেকে আদর করে কান্না থামায়। কোলে করে ছেলেকে নিয়ে এসে বাইরের ঘরে বসায়। তখনও ঘুমের রেশ কাটছে না দেখে টিয়া পাখির খাঁচার কাছে নিয়ে বসিয়ে দেয়। টিয়া পাখি দেখে ছেলের ঘুম উবে যায়। পাখির সঙ্গে খেলায় মেতে যায়। একে একে কাজের মাসি, রান্নার মাসি ঢোকে। সবাইকে টুকিটাকি নির্দেশ দেয়। মাকে জিজ্ঞেস করে কি রান্না হবে। আসলে  রান্নার সব্জি বাজার নীলাঞ্জনা কলেজ থেকে ফেরার পথে শিয়ালদা থেকে কিনে আনে। অন্যান্য জিনিস এখানকার বাজার থেকে কিনে নেয়। রান্নাঘরের মূল দায়িত্ব নীলাঞ্জনার মা সামাল দেন। ছেলের দেখাশোনা ও মা করেন। এদিকে নীলাঞ্জনার কলেজে যাওয়ার সময় হয়ে যায়। মা বাবার ওষুধ দিয়ে নিজে বাথরুমে ঢোকে। 


আজ নীলাঞ্জনা হালকা নীল রঙের বুটিক পাড়ের শাড়ি পরেছে। সবুজ সরু টিপ কপালে পরেছে। বব কাটের সুন্দরী নীলাঞ্জনাকে আজ আরও সুন্দর লাগছে। নিজের টিফিন কৌটো নিয়ে কলেজ বেরিয়ে যায়। কলেজে ঢুকে থার্ড ইয়ার অনার্সের একটা ক্লাস নিয়ে ফিরে দেখে ইতুদি ডিপার্টমেন্টাল স্টাফরুমে ওর জন্য অপেক্ষা করছে। এই ইয়ারের পরের ক্লাসটা ইতুদির। " ইতুদি, সরি। আমার একটু দেরি হয়ে গেল। ওরা খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্সটা শুনছিল। তাই একটু দেরি হয়ে গেল।" নীলাঞ্জনার এই কথার উত্তরে ইতুদি বলে, " আরে এতো হতেই পারে। তুমি নাও আমি নিই ছাত্রদের ক্লাস তো হচ্ছে।"


"হ্যাঁ। শোন ইতুদি। আজ সকালে ও কলেজে এসে আবার ঝামেলা করেছে। আমায় থ্রেট দিচ্ছে ছেলেকে নিয়ে চলে যাবে। মনটা ভাল নেই। বেশ টেনশন লাগছে। আজ তাড়াতাড়ি আমরা বেরিয়ে যাব কিন্তু।"

" হ্যাঁ। ঠিক আছে।" বলে ইতুদি ক্লাসে চলে যায়।

তাড়াতাড়ি যতই বলুক, তা আর হয়ে ওঠে না। সেই বিকেল বেলায় ইতুদি নীলাঞ্জনা দুজনে মিলে কলেজ থেকে বেরোয়। বেরনোর সময় নীলাঞ্জনা বলে, " বুঝলে ইতুদি? আজ আমার মাথাটা কেমন করছে। বুকটা চিন চিন করছে। আজ আর বাসে যাব না। ট্যাক্সি করে চলে যাব।"

" তার জন্য তো বড় রাস্তায় যেতে হবে। এই গলিতে ট্যাক্সি পাবে না।"

এইসব কথাবার্তার মধ্যে নীলাঞ্জনা বলে ওঠে, " ইতুদি আমায় একটু ধর। আমার বুকে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।" বলতে বলতে নীলাঞ্জনা রাস্তায় বসে পড়ে। ইতুদি চিৎকার করে রাস্তার সবাইকে অনুরোধ করে, " দাদা। আপনারা কেউ একটা ট্যাক্সি যোগাড় করে দিন না। এখানে কোন ডাক্তার বসেন?"


" হ্যাঁ কাছেই একজন হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের চেম্বার আছে। নিয়ে যান।" এক দোকানির পরামর্শ।

এমন সময় মালবাহী এক ভ্যান রিকশা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল। অনুরোধ করে তাতেই উঠে পড়ে দুজন। পাশেই ডাক্তারের চেম্বার, কিন্তু তখনও ডাক্তারবাবু আসেন নি। লোকজনের পরামর্শ, " সোজা চলে যান। মেডিক্যাল কলেজ কাছেই। ইমারজেন্সিতে নিয়ে চলে যান।" অগত্যা মেডিক্যাল কলেজের উদ্দেশ্যে ওই ভ্যানেই দুজনে রওনা দেয়। মাঝে নীলাঞ্জনার যন্ত্রণা বাড়ে। শারীরিক অস্বস্তিতে সে ভ্যানের ওপরে দাঁড়িয়ে পড়ে। যন্ত্রণায় বুক জাপটে ধরে। আইঢাই করতে করতে হঠাৎ ইতুদির কোলে মাথা রেখে নেতিয়ে পড়ে। ইতুদি " নীলাঞ্জনা, নীলাঞ্জনা" বলে ডাকতে থাকে। কোন উত্তর আসে না। এদিকে ভ্যান রিকশা মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছে গেছে। ইমারজেন্সীতে তড়িঘড়ি স্ট্রেচার আসে। ডাক্তার দৌড়ে আসেন। পরীক্ষার পর ডাক্তারবাবু বাইরে বেরিয়ে এসে বলেন, " কলেজের দিদিমণির সঙ্গে কে এসেছেন?" ধীর পায়ে ইতুদি এগিয়ে যায়। শঙ্কিত গলায় জিজ্ঞেস করে, " নীলাঞ্জনা কেমন আছে?"


" সি ইজ নো মোর। সি হ্যাজ বিন ব্রট ডেড।" ডাক্তারের এই কথা শুনে ইতুদি বিচলিত হয়ে পড়ে। জিজ্ঞেস করে, " সে কোথায়? ডাক্তারবাবু নীলাঞ্জনাকে কোথায় রাখা আছে?" হাতের ইশারায় ডাক্তারবাবু দেখিয়ে দেন। ইতুদি দৌড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। দেখে সামনেই শোয়ানো নীলাঞ্জনার শরীর। ইতুদি এগিয়ে যায়। কাছে পৌঁছে দেখে নিশ্চিন্তে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে নীলাঞ্জনা। নিজেকে আর স্থির রাখতে পারে না ইতুদি। নিজের দুহাত দিয়ে নীলাঞ্জনার দুহাতে ঝাঁকুনি দেয় আর চিৎকার করে ওঠে, " নীলাঞ্জ...না, নীলাঞ্জ...না।" সেই ধ্বনি হসপিটালের কোনায় কোনায় প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। ইতুদির চোখের দু ফোঁটা জল নীলাঞ্জনার কপালে পড়ে গড়িয়ে যায়।

Comments