গল্প - প্রগতি মাইতি


খোঁজ-খবর

 

গিন্নি বললো, আজ কী বার গো? আমার তখন প্রবীর মণ্ডলের কবিতার একটা লাইন ক্যানিং লোকালের কোনো রোববার নেই। মনে পড়ে গেল। আমি বললাম, এখন রবিবার ছাড়া আর কোনো বার নেই। গিন্নি মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, রাখো তো তোমার কাব্যি! আমার তখন খেয়াল হল, এখন সবদিন রবিবার হলেও গিন্নি তো আবার শনি মঙ্গল বারের দিকে খেয়াল রাখে। | অফুরন্ত সময় কাটাতে আমি রোজ পালা করে একে ওকে তাকে ফোন করে খোঁজ খবর নিই। তাতে খবরাখবর যেমন পাওয়া যায় আবার বহুদিনের সম্পর্কটা একটু ঝালাই হয়। আর এই খোঁজ খবর নিতে গিয়ে কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হল। তবে একজন ছাড়া কেউই কিন্তু বললো না যে সে খুব ব্যস্ত। ব্যস্ত শব্দটা যেন থম মেরে কোথাও লুকিয়ে আছে। অধিকাংশই জানতে চায়, কে কেমন করে চব্বিশ ঘণ্টা কাটাচ্ছে। যাদের যাদের ফোন করছি তাদের নাম একটা কাগজে লিখে রাখছিলাম। কাউকে কোনো কারণে আবার ফোন করার দরকার থাকলে তার নামের পাশে একটা লাল টিক দিতাম।


গত কালই তো অর্ণবকে ফোন করলাম। অর্ণব কবি। লিটল ম্যাগাজিনের কবি হলেও দু’একটা বাণিজ্যিক কাগজের পুজো সংখ্যায় লিখছে। হাইস্কুলের শিক্ষক। প্রায় দেড় বছর স্কুলে প্রায় যেতে হয় না। সপ্তাহে দু’দিন অন লাইনে ক্লাস নেয়। অর্ণবকে বলার মধ্যে আমি বলে ফেলেছিলাম, এখন তো তোর অফুরন্ত ছুটি। তা কীভাবে সময় কাটাচ্ছিস। অর্ণব কবিতার মতো উত্তর দিল, ‘ছুটি শব্দটার মধ্যে এখন আর অনাবিল আনন্দ খুঁজে পাই না। বরং এই শব্দটা জীবনে বড় ক্লান্তিকর ও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। অর্ণবের এমন কাব্যিক ঢঙে না বললেও বেশির ভাগই যে মানসিক ক্লান্তিতে ভুগছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হল না। অর্ণবের পর ফোন করলাম মনীষাকে। থাকে দুর্গাপুর। খুব সুন্দর গানের গলা মনীষার। সকাল সন্ধে গানের টিউশান করে বেশ সময় কাটাতো। স্থানীয় কোনো অনুষ্ঠান হলে মনীষার ডাক পড়েই। ওর গলায় নজরুলগীতি খুব ভালো। ওর কাছে জানতে চাইলাম, কেমন আছো ? মনীষা বললো, জানেন দাদা, গান মনে হয় ভুলেই যাব।


ছাত্রছাত্রীরা তো আর আসে না। আমি বললাম, কেন ? তুমি নিজে নিজে প্র্যাকটিস করো। ও বললো, ভাল্লাগেনা। চার দেওয়ালকে কি গান শোনাবো ? তবে একটা জিনিস করছি, প্রচুর গান শুনছি। ভাবছি ইউটিউবে গান লোড করবো। দাদা আপনাকে লিংক পাঠাবো কিন্তু। সাবস্ক্রাইব করবেন তো?


মনীষার পর কাটোয়ার কৌশিক। কৌশিক ভালো ফুটবল খেলে। খেলার কোটায় চাকরি পেয়েছিল। অফিস ছুটির পর স্থানীয় ক্লাবে ছেলেদের ফুটবল কোচিং করাতো। ফুটবল পাগল ছেলে। মোহনবাগানের অন্ধ সমর্থক। মোহনবাগান হারলে এই বয়সেও শিশুর মতো কেঁদে ফ্যালে। আর জিতলে ক্লাবে সব্বাইকে ডেকে ডেকে রসগোল্লা খাওয়াতো। এমনকি ইস্ট বেঙ্গলের সমর্থকদেরও বাদ দিত না। কৌশিকের খোঁজ নিয়ে জানলাম, সে সকালে মাস্ক পরে হেঁটে হেঁটে ক্লাবে যায়। চেয়ার নিয়ে মাঠের পাশে বসে ফাঁকা মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে। কেয়ারটেকার ভোলা নাকি শুনেছে, কৌশিক একা একা চেঁচাচ্ছে বাঁ-দিকে ডজ করো, এ্যাই বিনয় মাঝ মাঠ ছাড়িস না। আর সন্ধেবেলা মেয়ে-বৌয়ের সাথে লুডো খেলে।


নরেশ, দিগন্ত, অমিত-কে ফোন করলাম। তিনজনেরই ফোন ব্যস্ত আছে। শুধুমাত্র অমিত পরে রিংব্যাক করে একে অপরের খোঁজ-খবর নিল। কিন্তু নরেশ বা দিগন্ত রিং ব্যাক করেনি। খুব দুঃখ পেলাম নরেশ ও দিগন্তের ব্যবহারে। ওরা কি আমাকে ভুলে গেল? নাকি ওরা সাংঘাতিক কোনো বিপদে পড়েছে! নরেশ দিগন্তের নাম লিখে লাল দাগ দিয়ে রাখলাম। পরে সময় পেলে আর একবার ফোন করবো। আর ঠিক তখনই আমার ফোন বেজে উঠল। বাঁকড়ার অনির্বাণ ফোন করেছে। দু’এক কথা ভালো মন্দের পর অণির্বান জানতে চাইল আমি কীভাবে সময় কাটাচ্ছি। আমার লেখালেখি কেমন হচ্ছে। আমি বললাম, লেখালেখি তো চাইলেই আর আসে না। তার জন্য মনের দরকার। অনির্বাণ খুব সুন্দর উত্তর দিল, তার মানে আপনার মধ্যে যন্ত্রণা হচ্ছে। আর শুনেছি কবি-লেখকদের যন্ত্রণা থেকেই কলম চলে বেশি। আমি কয়েক মুহূর্ত উত্তর দিতে পারিনি। তারপর বললাম, তুমি খারাপ কিছু বলোনি। কিন্তু এ এমন একটা যন্ত্রণা যা শুধু অলস-অকর্মণ্য আর হতাশায় ভরা। যন্ত্রণা লিখতে হলেও মনটা খুশি থাকতে হয়।


অন্য সময় খবর কাগজের হেডলাইনে চোখ বুলিয়ে বিশেষ বিশেষ কিছু খবর পড়তাম। এখন বিজ্ঞাপনও পড়তে হচ্ছে। যে রাশিফলে কোনোদিন বিশ্বাস ছিল না তাও বাদ দিচ্ছি না। রান্নার রেসিপি গিন্নিকে দেখিয়ে অনুরোধ উপরোধ করে দু’একটা খাবারও টেস্ট করলাম। ছেলে বললো, মা, খবর কাগজের রেসিপির চেয়ে বরং তুমি ইউটিউবে লাইভ দেখে নিলে আরও ভালো হবে। তুমি বললে আমি মোবাইল থেকে দেখিয়ে দেব। গিন্নি তো ছেলেকেও এক হাত নিল, তোদের বাপ-ব্যাটার এই খাই খাই মেটাতে তো আমার জান কয়লা হয়ে যাবে দেখছি। এ সময়ে যা পাচ্ছিস তাতেই সন্তুষ্ট থাক। সংসারের কাজ যে দু’গুণ বেড়ে গেছে সেটা তোদের খেয়াল আছে? সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকলে এমনই হয়। যত চাপ আমার ওপর। আমি বললাম, তোমাকে তো কতবার বলেছি আমাকে কিছু কাজ দাও, সময় কাটবে আবার তোমাকে হেল্প করাও যাবে। শুনলে আমার কথা! তাহলে আর মিছিমিছি আমাদের দোষ দিচ্ছ কেন? এখন তো ‘দশে মিলে করি কাজ...’। গিন্নি আমার কথায় কোনও উত্তর না দিয়ে ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। | টিভি দেখতেও ইচ্ছা করে না। জীবনে কখনও সিরিয়াল দেখিনি। বিশেষ কোনো খবর আর খেলা থাকলে টিভির সামনে যাই। আর এখন ইচ্ছে না থাকলেও খবরের চ্যানেলটা খুলে সময় কাটানোর চেষ্টা করি। আবার সেখানেও একঘেঁয়েমি। যতক্ষণ না খবর দেখায় তার চেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন। তারপর একই খবর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। এ নিয়ে ফোনে কথা হচ্ছিল আশিসের সাথে। আশিস বলেছিল, দ্যাখ আমাদের এত সমস্যা—পেট্রোল, ডিজেল, রান্নার গ্যাসের দাম বেড়েই চলেছে। জিনিসপত্রের দাম তো ঘোড়ার মতো ছটছে। কত লোকের কাজ নেই। এসব নিয়ে মিডিয়া কিছু করছে? এরাও চক্রান্ত করে আমাদের মনটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইছে। অথচ এরা নাকি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ! আশিসের কথা ফেলে দেওয়ার মতো নয়। ও সব সময় সবকিছু রাজনীতির চোখে দ্যাখে। ওর সব কথা সব সময় আমাদের ভালো না লাগলেও, পরে দেখেছি ওর কথায় যুক্তি আছে।।


আজ প্রথম ফোনটা করলাম অসীমকে। স্কুলের বন্ধু। দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। ওর ফোন বেজে গেল, কেউ ধরলো না। আমি একটু পরে আবার ফোন করলাম। কিছুক্ষণ বাজার পর একজন মহিলা ফোন ধরল। আমি বললাম, আমি অসীমের বন্ধু বলছি। ও কোথায়? আপনি কে বলছেন? মহিলা উত্তর দিল, আমি এবাড়িতে কাজ করি। আপনি কিছু শোনেননি? আমি বললাম, না তো, কী হয়েছে? অসীমের কি কিছু...। মহিলা বললো সাতদিন আগে উনার বাবা মারা গেছেন। তখন উনার মা নার্সিংহোমে ছিলেন। মা-কে বলা হয়নি বাবার মৃত্যুর কথা। কাল রাতে উনারউউ মাও চলে গেলেন। সবাই শ্মশানে গেছে। আমি বললাম, কাকুর কী হয়েছিল ? মহিলাটি বলল, হার্ট অ্যাটাক আর উনার মা করোনাতে মারা গেলেন। বলতে বলতে মহিলাটি বলল, উনারা শ্মশান থেকে এসে গেছেন। ধরুন, আমি দরজা খুলে ফোন দিচ্ছি। আমি বললাম, না, থাক। আমি পরে কথা বলে নেব।। | মনটা খারাপ হয়ে গেল। কি ঝড়টাই না অসীমের উপর দিয়ে বয়ে গেল। অথচ একবারও ওর পাশে থাকতে পারলাম না। এখনও যাওয়া যাবে না। কারণ ঐ মায়ের মৃত্যু। আতঙ্ক-ভয় চাচা আপন প্রাণ বাঁচা। ঘণ্টাখানেক আর কাউকে ফোন করলাম না। তারপর ফোন করলাম বারুইপুরের শক্তি-কে। যথারীতি একথা সেকথার পর জানতে চাইলাম শক্তি সময় কাটাচ্ছে কীভাবে। শক্তির কথাবার্তা বেশ উৎসাহব্যঞ্জক। ও বললো, একদম সময় পাচ্ছি না রে। ঘরে থেকে কাজের যেন আর শেষ নেই। ছাদের বাগানটা দেখভাল করতেই কত সময় চলে যায়। ফুল ছাড়াও টবে শাক সবজির চাষ করেছি। লাল শাক, কলমি শাগক, পুঁইশাক, লঙ্কা, বেগুন, টমেটো, ক্যাপসিকাম, তেঁড়স—এসব আছে। তারপর ছেলেটা তো স্কুলে যায় না। ওকে সময় নিয়ে পড়াতে পারছি। কখনও কখনও বৌ-কেও ওর কাজে সাহায্য করছি। খবর কাগজটাও ভালো করে পড়া হয়ে ওঠে না।


এরপর ফোন করলাম অভিজিৎ-কে। ফোন ধরলো ওর বউ মিতা। মিতাকে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করার পর অভিজিৎ কোথায়, কী করছে জানতে চাইলাম। মিতা বললো, আপনি জানেন না? আমি বললাম, না তো? কী হয়েছে! মিতা বললো উনি তো ‘ই’ নিয়ে ব্যস্ত। আমি বললাম ই’! মানে! মিতা বললো, ই’ মানে ই-ম্যাগাজিন। আর গুগুল মিটে একটার পর একটা প্রোগ্রাম। ওর নাওয়া-খাওয়ার সময় নেই। কিছু বললেই খিচিয়ে উঠছে। আমি তো বলি, তোমাকে ‘ই’-তে পেয়েছে!


পাশের পাড়ায় থাকলেও বিবেকের সাথে অনেকদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। বেশ কিছুক্ষণ ফোন বাজার পর বিবেক ফোন ধরলো। কিন্তু শুনতে পেলাম বেশ হৈ-হট্টগোলের শব্দ। বিবেক বললো, একটু পরে তোকে রিং ব্যাক করছি। একটা ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ এসেছে। পরে বলছি। ঘণ্টা খানেক বাদে বিবেক ফোন করল। আমি বললাম, কী হয়েছে? পুলিশ...! ও বললো, আর বলিস না আমাদের পাড়ার ছোট্ট। গরিব মানুষ। ট্রেনে হকারি করতো। এখন সুযোগ পেলে পাড়ার রাস্তায় ডালমুট বাদাম বিক্রি করে। পুলিশ ওকে তাড়া করেছে। বলছে, লকডাউনে বাইরে কেন? ছোট্ট কোনো রকমে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেছে। পুলিশ ওকে ধরতে বাড়ি পর্যন্ত এসেছিল। পুলিশ দেখে ছোটুর বউ কমলা পুলিশের মুখের ওপর বলে দিল, আমাদের তো একটা মাত্র ঘর। ঘরে ছ’ছটা প্রাণী। আপনাদের সামাজিক দূরত্ব কি শুধু বাইরে? আর ঘরে? পুলিশ কোনো কথা না শুনে ছোট্টকে ঘর থেকে বের করে দিতে হুমকি দিচ্ছিল। আমরা গিয়ে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে পুলিশকে ফেরত পাঠিয়েছি।


এবার ফোন করলাম সোনারপুরের দিলীপকে। দিলীপের কথা শুনে তো আমি থ। আমি বললাম, দিলীপ কেমন আছো? ও বললো, ইমিউনিটি বাড়াতে যা যা করতে হয় তাই তাই মেনে চলছি। আমি বললাম যেমন ? দিলীপ বললো, যোগব্যায়াম, প্রাণায়াম, ছাদে হাঁটাহাঁটি, সকালে খালি পেটে উষদুষ্ণ জলে পাতিলেবু মিশিয়ে খাই, আধঘণ্টা রোদে দাঁড়াই, দুধ-হলুদ, আমলকি, চ্যবনপ্রাশ, কাঁচা রসুন ও আদা, কাঠবাদাম, গোলমরিচ, কালোজিরে, লবঙ্গ, ছোট এলাচ দারচিনি দিয়ে পাচন, উষ্ণ নুন জলে চারবার গার্গেল, গরম জলের ভেপার অন্তত চারবার, গরম চা-দুধ, তুলসিপাতা, নিমপাতা মধু দিয়ে, আর্সেনিক এলবাম, মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট, ভিটামিন সি ট্যাবলেট...! দিলীপ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু লাইনটা কেটে গেল। বার বার চেষ্টা করেও ওকে ধরতে পারলাম না। কিন্তু আমাকে জানতে হবে ও তাহলে ভাত-রুটি খায় কখন। আর আরও কী কী ও খাচ্ছে! তাছাড়া এখনও আরও অনেককে ফোন করা হয়নি! তাদের খোঁজ-খবর নিতে হবে।

Comments