গল্প - রাজর্ষি বিশ্বাস

 

পাখি



ইউনিভার্সিটির পড়া শেষ করে বাড়িতেই ফিরে আসে উপল। উপায় ছিলনা। ক্লাসমেটরা অনেকেই শিবমন্দিরে থেকে গেলেও সে পারেনি। কিন্তু এ কোন ফিরে আসা! নদী ঘেরা প্রান্ত এই শহরটি যে এত দ্রুত পাল্টে যাবে ভাবে নি সে। শহরের আনাচে কানাচে জমে উঠেছে যান্ত্রিকতার স্তূপ। চারপাশের মুখ ঢেকে গেছে বিজ্ঞাপনে। ডিস টিভির অত্যাচারে হারিয়ে গেছে রেডিওর চিরাচরিত আত্মীয়তা। চেনা ছবি ও মুখগুলো বড্ড অপরিচিত ঠেকছে। যেন মুখোশে ঢাকা। পুরোনোকে আকরে থাকা এক মফস্‌সল শহরের হঠাৎ এই খোলনলচে বদল কিছুতেই মিলিয়ে নিতে পারে না। নয়ের দশক যেন হয়ে ওঠে হাঁপিয়ে ওঠার দশক। অথচ উপলের মন পড়ে থাকে শহরের চাকচিক্যহীন প্রাচীন মানচিত্রে ও ক্যানভাসে। ইতস্তত রাজ আমলের লাল বাড়ির সাথে জড়িয়ে থাকা আটপৌর টিনের চালা বাড়ি, অপরিসর পথঘাট,অনাড়ম্বর চৌপথি, ঝোপ জঙ্গল ও গাছগাছালিতে ঘেরা গ্রাম্যতা মাখা রূপকথার মত শহরটা দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকে। পুরনোর হাতছানি হঠাৎই উধাও। সন্ধ্যে হলে প্রায় অন্ধকারে ডুব দেওয়ার দিনগুলো ক্রমশ যেন হারিয়ে যেতে থাকে। মানসাইও যেন অভিমানে দূরে সরে যেতে থাকে।



ফিরে এসে উপল নিজেই টের পায় ভেতর ভেতর এক ভাঙনের। সব কিছু যে আগের মত আর নেই সেকথা বুঝতে অসুবিধা হয় না। অভাব অনটনে বাড়ির আনাচে কানাচে জড়িয়ে থাকে যে দীর্ঘ শ্বাস,অনিশ্চিয়তা তা অতিক্রমের কোন পথ জানা নেই। দুএকটা টিউশন করে কি আর হাল পাল্টায়! বড্ড অসহায় লাগে। মনে হয় সে যেন এক বোঝা। এদিকে চাকরিরও কোন নিশ্চয়তা নেই। অথচ তার মুখ চেয়েই বসে থাকে একজন।



উপলের চারদিক ঘিরে থাকে শুধুই দীর্ঘশ্বাস আর অন্ধকার। আর সে ক্রমাগত হাতরে চলে আলোর পথ। নিয়ম করে প্রায় রবিবারই ছুটে যায় হাজার হাজার অসহায় বিবর্ণ মুখগুলোর মাঝে। তখন মনে হয় সে তো একা নয়! হাজার হাজার উপল চারপাশে। মনের মধ্যে শুধু ঘুরপাক খেতে থাকে অনেক প্রশ্ন। করা সব কিছু পায়? কাদের কপালে যে জোটে এসব ...



এদিকে শহরের সব পথ যেন মিশেছে ওই ঝান্ডাওয়ালা বাড়িতে। ওখান থেকেই সব কিছুর নির্ধারণ হয়। সে ওই বাড়ির বাসিন্দা নয়। সেখান থেকে অনেক দূরত্বের বিবর্ণ বাড়ির এক কোণে বসে থাকেন অসুস্থ বাবা। সর্বদা চিন্তায় ডুবে থাকা তার মুখ যেন তাড়িয়ে বেড়ায় উপলকে। নিজের কাছে সে যেন নিজেই পালিয়ে বেড়ায়। গুটিয়েও যেতে থাকে।



ক্রমশ সিস্টেমটার প্রতি ঘেন্না ধরে যায়। ওসব তত্ত্বকথাও তিক্ত লাগে। স্বপ্নভঙ্গ হয়েই চলেছে। তবু মিছিল মিটিং চলতে থাকে। চলতেই থাকে। বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়া মিছিলের যান্ত্রিক মুখগুলোকে কিছুতেই নিজের সাথে রিলেট করতে পারেনা। বরং সেসব দেখে তার ভয় হয়। অনেক অনেক অদৃশ্য পরিচিত মুখগুলি বলে, সবই তো ঠিকঠাক চলছে ! যা হচ্ছে ঠিকই হচ্ছে! এলাকায় বেটে খাট্টাগোট্টা ওই কদর্য মনের বিধায়কই যেন সব কিছুর সর্বেসর্বা। গণতান্ত্রিক ভগবান ! তার বিরুদ্ধাচরণ নৈব নৈব চ। সে যা বলবে সবাই যেন তার সুরেই সুর মেলাবে। যেন হ্যাঁ হ্যাঁ বলা সন। অথবা 'ঠিক' 'ঠিক' বলে চলা কলের পুতুল। ঘেন্না ধরে যায় উপলের। মেজাজটাও খিঁচড়ে থাকে সবসময়। সবকিছু ভেঙে ফেলতে চায় সে।



বন্ধুরা উপলকে বলে, তুই কিন্তু পাগল হয়ে যাবি। হয়ত ওরা ভুল বলে না। নিজেরও অনেক সময় তা মনে হয়। ওদেরও অবস্থা প্রায় একই। তবু তারা বেশ মানিয়ে নিয়েছে। যত দিন যায় বেশি কথা, রাজনীতির আলোচনা, মিছিল মিটিং এর হট্টগোল শুনলে তার মাথার শিরা উপশিরা ছিড়ে যেতে চায়। শুধু এই মানসাই পাড়ে এলেই সে যেন প্রাণভরে নিশ্বাস নেয়। নির্বাক উপল প্রতিটা দিন নিয়ম করেই তাকিয়ে থাকে নদীর বিস্তৃতিতে... দিগন্তে। মন ভালো করতে মাঝে মধ্যে গীতবিতানটাও নিয়ে আসে সে। এই বইই যেন তার একমাত্র আশ্রয়। শ্বাস প্রশ্বাস। এই গীতবিতানের জন্যেই হয়ত সে পাগল হয়ে যায়নি।


বিষাদের বিকেলেও পশ্চিম আকাশ লাল হয়ে ওঠে নিয়মমাফিক। আর এরপরেই তো দীর্ঘস্থায়ী অন্ধকার পর্ব। এই সময়টায় সব পাখির দল ঝাঁক বেঁধে মানসাইয়ের ওপর দিয়ে বাড়ি ফেরে। পাখির মত দলবদ্ধভাবে বাড়ি ফেরার কোন সুযোগ তার নেই। উপল ভাবে, কি হয় পড়াশোনা করে? একগাদা ডিগ্রী যোগাড় করে? সব কিছুই অর্থহীন - এমনকি চারপাশও। শেষপর্যন্ত সেও কি নিহিলিজমের পাঁকে ডুবে যাচ্ছে? না কি চোরাগোপ্তা ডিপ্রেশনের হাতছানি? মানসাই পাড়ের বাঁধের ধারে তখনও বস্তির মত বাড়ি গজিয়ে ওঠে নি। চারপাশ অনেকটাই ফাঁকা ও শুনশান। সন্ধ্যার মুখে স্তব্ধতা গ্রাস করে নেয় সমস্ত নদী পাড়। উঠে দাড়ায় উপল। বাড়ি ফিরতে হবে। অন্ধকার দ্রুত নেমে আসছে। শেষ সিগারেটটা ধরায়। হঠাৎই দেখে, এক অস্পষ্ট অবয়ব দূরে নদীর মাঝে গজিয়ে ওঠা চরে গর্ত করে চলছে। আর চিৎকার করে বলছে, আয় আয়... কোন কিছুতে অতিরিক্ত কৌতূহল না থাকলেও, ফিরে যেতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়ে সে। ততক্ষণে চারপাশ ডুবে যায় অমাবস্যার নিকশ অন্ধকারে। কোন আওয়াজও আর নেই। কোথায় গেল লোকটা? এই অন্ধকারে কি হারিয়ে গেল? উপল চিৎকার করে বলে, -- এই যে শুনছেন... আপনি কোথায়? কোন উত্তর নেই। শুধুই নদীর সো সো শব্দ...


রাতে ঘুম আসে না। কোথায় হারিয়ে গেল লোকটা? মনে হলো কোন তান্ত্রিক সাধু ! নয়ত উন্মাদ কোন ব্যাক্তি! প্রায় অন্ধকার জনমানবহীন চরে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে কেনইবা ওই লোকটি গর্ত করছিল! নিশ্চয়ই কোন মতলব আছে... উপল এসব ভেবে যেতে থাকে। শুধু এই এক চিন্তাই চেপে বসেছে। কেন লোকটি চরের মধ্যে গর্ত করছিল? কাউকে কি পুঁতে রাখবে? তাহলে আয় আয় বলে কাকেই বা ডাকছিল? সবই যেন রহস্যে ঘেরা। এমন একটা মানুষকে সে কি কোথাও দেখেছে! কিছুতেই মনে করতে পারে না। গভীর রাতে সে ঠিক করে কাল দিনের বেলায় একবার ওই চরে যাবে। না দেখে এলেই নয়।


মানসাই নদীর বিস্তৃত বুকে সুবিশাল এক চর জেগে উঠেছে। তবে সেখানে যেতে গেলে নদীর কিছুটা অংশ পার করেই যেতে হয়। কোমর জল। পার হওয়া যায় অনায়েসেই। অনুমান করে পৌঁছায় চরের সেই স্থানে। গত সন্ধ্যায় অন্ধকারের মধ্যেও ভুল কিছু দেখিনি সে। সত্যি সত্যিই সদ্য খোড়া এক গর্ত। আর পাশে পরে আছে একটি মৃত পাখি। তাহলে আয় আয় বলে ওই লোকটা হয়ত পাখিদেরই ডাকছিল। মৃত পাখির পাশে রয়েছে কিছু নেতিয়ে থাকা জবা ফুল। লোকটা তান্ত্রিক গোছের কেউ হয়ত হবে! গর্তের পাশে পরে থাকা গাছের শুকনো একটা ডাল নিয়ে পাখিটাকে ঠেলে গর্তের মধ্যে ফেলে। আর সেই শুকনো ডালটা দিয়েই চলে দফন প্রক্রিয়া। ভাবে, মাটিতেই সবাই মিশে যায়। হঠাৎই দেখে দূরে চরের পূব প্রান্ত থেকে উন্মাদের মত দৌড়ে আসতে থাকে একটি লোক। মনে হল কিঞ্চিৎ পাগল প্রকৃতির। চিৎকার করে বলতে থাকে, মাটি ফেলবি না। মাটি ফেলবি না। উসকো খুসকো চেহারার লোকটা কাছে এসে পাগলের মত গর্তের থেকে মৃত পাখিটাকে তুলে নিয়ে আকাশের দিকে তাকায় এক অদ্ভুত ভঙ্গিমায়। গতকাল এই লোকটিই ছিল নিশ্চিত হয় উপল। না তাকে কোনদিনই সে দেখেনি। এরপর সে যা করল তাতে অবাক হওয়ারই মত। বা হাতের তালুতে পাখিটিকে রেখে ডানহাতে একটা কাঠি নিয়ে চরের মধ্যেই শুষ্ক ভূমিতেই এঁকে যেতে থাকে একটার পর একটা পাখি। জনমানবহীন মানসাইয়ের চরে এই পাখি আঁকার কোন কারণ খুঁজে পায় না উপল। কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনি কেন শুধু শুধু পাখির ছবি আঁকছেন? থেমে যায় লোকটা। কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এগিয়ে আসে উপলের দিকে। কিছুটা ঘাবরেও যায় সে। বলে, একটা সিগারেট দে। পাশে এসে বসে। দিগন্তের দিকে তাকিয়ে বলে, আমরা সবাই বন্দী। তুই বন্দী, আমি বন্দী... তোরও তো চারপাশে জেলের উঁচু উঁচু দেওয়াল! কোথাও পালাতে পারবি না। কি রে পারবি? উপল এসব হেয়ালি বুঝে উঠতে পারে না। বলে, কেন আঁকছো শুধু পাখিরই ছবি? এবার বিকট আওয়াজ করে হাসতে থাকে। বলে, জানিস কালকে সারা রাত পাখির ছবি এঁকেছি।

- কোথায় ?

- শহরের দেওয়ালে দেওয়ালে...

- কেন আঁকলে ?

- সবাইকে বলি এটা তো আস্ত একটা জেলখানা। ডানা ঝাপটে বেড়িয়ে যা...

হাতের মুঠোয় তখনও সেই মরা পাখিটা ধরা। কিছুক্ষণ আর কোন কথা নেই। উপল ভাবে সে মরছে তার চিন্তায়। আর এই লোকটা ভাবছে শুধু পাখির কথা! মাথায় আবার ঘুরপাক খেতে থাকে বাবার পেনশন নেই। সংসার কি ভাবে চলবে! সে কি কঠিন সময়ের শেকল ছিড়ে বেরিয়ে যেতে পারবে... কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পরে সে। হঠাৎই লোকটা পাখিটাকে ছুড়ে মারে মাঝ নদীতে। বলে, যা উড়ে যা। ভেগে যা। আমাদের মত বন্দী থাকিস না। মৃত পাখিটা নদীতে পড়ার সাথে সাথেই অদৃশ্য হয়ে যায়।


- দ্যাখ দ্যাখ পাখিটা জেলখানা ভেঙে বেরিয়ে গেল। ও এখন মুক্ত। আর তুই, আমি এখনও বন্দী।


অতঃপর আর কোন কথা না বলেই সে হন হন করে হাটতে শুরু করে। উঁচু চরের প্রান্ত সীমা যেখানে নেমে গেছে সেখানেই অদৃশ্য হয়ে যায় লোকটি।


মিথ্যে বলে নি সে। উপল দেখে শহরের অনেক দেওয়ালেই কাঠ কয়লার অজস্র আঁকিবুকি। ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গিতে পাখিদের উড়ে যাওয়ার সেই সব গ্রাফিত্তি যেন ঘোর তৈরী করে।


রাতে তখনও লোডশেডিং। হ্যারিকেনের আলোয় খেতে বসে দ্যাখে বাবা মাথা নিচু করে খাচ্ছেন। আজকাল তার বাবার সাথে খুব কমই কথা হয়। তবু মনে হয় বাবা যেন বলছেন, কি রে কিছু ভাবলি ? উপলের কাছে কোন উত্তর নেই। সে যেন অস্ফুট স্বরে বলে, আমিও তো পাখি হতে চাই...


Comments