গল্প - রীতা মোদক



আগুনের পরশমনি


গরীব চাষী রবি। সামান্য আয়ে কোনরকমে সংসার চলে।


দুই   ছেলে -মেয়ে। বড় বাড়ির মত নার্সারি স্কুলে দেওয়ার মত সামর্থ নেই রবির। প্রাইমারী স্কুলে আদর্শলিপি, বর্ণপরিচয় পরেই বড় হচ্ছে রবির ছেলে - মেয়েরা।  পাশের বাড়ির ছেলে মেয়েরা যখন এসি ঘরে বসে কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলায় মত্ত ,এ বাড়ির উঠোনে  তখন মৃদু লণ্ঠনের আলোয় মা মৃণালিনী দেবী ছেলে মেয়েদের পড়াচ্ছেন বিদ্যাসাগরের জীবনী।  তাল পাতার পাখা দিয়ে হাওয়া দিতে দিতে তখনকার সমাজের মেয়েদের কি অবস্থা ছিল ও বিধবা বিবাহের গল্প কাহিনী ছেলে মেয়ে দের শোনাচ্ছেন। 


ছেলে মেয়ে দের ইংলিশ মিডিয়ামে দিতে পারেননি বলে রবির আক্ষেপের সীমা নেই। মৃণালিনীর তাতে কোনো আপত্তি নেই। বরং খুশী হয়েছেন।  মৃণালিনী ভাবেন, কচি বয়েসে যদি বাচ্চারা বাংলা অক্ষর ভালো করে না চেনে তাহলে বাংলা ভাষা কিভাবে শিখবে?একদিন খেলার মাঠে বড় বাড়ির ছেলে দের সঙ্গে রবির বাচ্চাদের ঝগড়া লেগে গেলো। বড় বাড়ির ছেলে কৌশিক রবির মেয়ে  সায়ণীকে দেশি কুত্তি বলে গাল দিল। ইংরাজিতে কি জানি  বড় বড়  বুলি আওরে সায়নিকে খুব অপমান করলো। সায়নি কাদতে কাদতে বাড়ি চলে এলো।  মেয়ের অপমান শুনে মৃণালিনীর মনে জেদ চেপে গেলো। তিনি সেলাই কাজ করে বাচ্চাদের লেখা পড়া শেখাতে  লাগলন। 


প্রায় দশ পবছর পর।  সায়নী এখন  মেখলিগঞ্জ   ব্লকের বিডিও। তার ভাই সুদর্শন মাথাভাঙ্গা কলেজ ইতিহাসে অনার্স নিয়ে পড়াশুনা করছে। সে ও  ভবিষ্যতে WBCS দিয়ে বড় কিছু হতে চায়। এদিকে বড়ো বাড়ির বড়ো ছেলে মদ আর পার্টিতে মজে গিয়ে বাপের টাকার  শ্রাদ্ধ করে চলেছে। মৃণালিনী দেবী এখন ও সেলাই কাজ করে চলছেন। তবে নিজের জন্য নয়। গরীব স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের হাতে কলমে সেলাই কাজ শেখাচ্ছেন। সায়নীর মনে পড়ে, একদিন কলেজ যাওয়ার সময় কৌশিক রাস্তায় সায়ণী কে কি অপমান তাই না করেছিল। আজ কৌশিকের  স্ত্রী   দীপা তার স্বামীর ব্যাপারে সায়নীর কাছে অফিসে নালিশ জানতে আসে -- "ম্যাডাম আমাকে বাঁচান। আমার স্বামী প্রতিদিন মদ জোয়া খেলে আমার খুব  সাথে অত্যাচার করে।আমাকে বলেছে বাড়ি থেকে বের করে দেবে। দুটো ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে নিয়ে কোথায় যাবো বলেন তো?"


দীপার দিকে তাকালে বড় কষ্ট হয়। সায়নীর  দীপাকে বোঝায়,-- "এত ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। এই দেখো তোমার মত মহিলারা কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন, ছেলে মেয়দের পড়াশুনা শেখাচ্ছেন। তুমিও স্বনির্ভর গোষ্ঠীতে যোগদান করো।"


দীপা এখন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যা। সায়নী মহিলাদের বিভিন্ন কাজের বিষয়ে প্রশিক্ষণ এর সাথে সাথে পণ প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর কথা শেখায়। অত্যাচার মাতাল দের হাত থেকে বাঁচতে সব  মহিলারা একত্রিত হয়ে মদ গাঁজার ঠেক ভেঙ্গে দেয়। সায়নীর আর একটা বড় কাজ রয়েছে -- বাল্য বিবাহ ঠেকানো। গ্রাম গঞ্জে এখনো মেয়েদের অল্প বয়েসে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সায়নীর পক্ষে একা ঠেকানো কিছুতেই সম্ভব নয়। সায়নী  স্বনির্ভর গোষ্ঠীর শিক্ষিত মহিলাদের নিয়ে প্রত্যেক গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে মিটিং করে। অল্প বয়েসে বিয়ে হলে কি কি অসুবিধে হতে পরে বোঝায়, মেয়ে দের পড়াশুনা করতে বলে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলে। একদিন এক গ্রামে বাল্য বিবাহের খবর শুনে সায়নী অফিসের দুজন স্টাফ নিয়ে রাত নয়টার সময় চলে যায় বিয়ে আটকাতে। এদিকে বরযাত্রীর চলে এসেছে। সায়নিকে দেখে সবাই থতমত খেয়ে গেল। সায়নী রেগে গিয়ে  বলে --- "এবাড়িতে কি বিয়ে হচ্ছে? মেয়ের মা - বাবা  কোথায়?"


মেয়ে র মা এসে সায়নীর পায়ে জড়িয়ে ধরে বলল -- "কাল তাদের বিয়ে হলে গেছে। এখন তারা চলে যাবে।আপনারা দয়া করে চলে যান। মেয়ে বিদায় অনুষ্ঠান টা করতে দিন"। 


সায়নী এক ধমক দিলো মেয়ে র মাকে -- "চুপ করুন! একদম মিথ্যা কথা বলবেন না। আমরা সব খবর নিয়েই এসেছি।মেয়েকে ডাকুন।"


মেয়ে কাদতে কাদতে সায়নীর সামনে এসে বলল -" ম্যাডাম আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। আমি আরো পড়তে চাই। সামনে আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা। মা বলছে -- পড়াশুনা করে আর কি লাভ, শেষে হাড়ি-খুন্তিই নাড়তে হবে। আমি পড়তে চাই ম্যাডাম।"


সায়নী তখন দুই পক্ষ কেই বোঝালো -- "দেখুন অল্প বয়েসে বিয়ে হলে মেয়েরা ঠিক মত পুষ্টি পায় না।তাদের অপুষ্টি সন্তান জন্ম হবে। তাছাড়া বাবা- মা যদি শিক্ষিত না হয় তাহলে ছেলে - মেয়েরা সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারবে না। তাই ছেলে- মেয়ে দের সঠিক বয়েসে বিয়ে দিন।"


দুই পক্ষই রাজি হলে মুচলেখা লিখিয়ে চলে আসে সায়নী। সায়নী ঘরে আসে  মায়ের কোলেমাথা রেখে শুয়ে পড়ে ।


দূর থেকে ভেসে আসে -- আগুনের পরশমনি... ছোয়া ও প্রাণে।

Comments