জেল থেকে লেখা চিঠি - ১
আমি যতবার তোমাদের চিঠি লিখেছি
ততবার বৃষ্টি এসেছে নেমে।
ততবার পলাশ ফুটেছে বিবাদী বাগে।
গত কয়েক বছর সাড়ে সাত মিনিটের বেশী
চাঁদ দেখিনি কোনওদিন।
জানালাটা বড্ড ছোট।
যেমন থাকে আমাদের মতো দেশে। রাজ্যে।
প্রতিটা মহল্লায়।
নতুন ওয়ার্ডেন আমায় খাতা, পেন দিয়েছে।
চিঠি পৌঁছে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেয়নি।
ওঁর বেতন কম।
কনট্রাকচুয়াল।
বসিরহাটে বাড়ি।
ধূপগুড়ি হলেও অবাক হত না কেউ।
আধার আর প্যান কার্ড লিংকড।
অথচ আত্মনির্ভর হয়নি এখনও।
কোনটা খারাপ বুঝতে পারছে না।
কপাল? না ব্যবস্থাটা?
বোনের কথা বলেছে আমায়।
গালভরা নামের ভাতা পায় কিছু।
কাজ পাবে না।
প্রতিটা চিঠিতে আমি ওঁর কথা লিখি,
ওঁদের কথা লিখি।
তবু, চিঠি পৌঁছে দেবে না ও।
আমার চিঠি লেখাকে ও বিলাসীতা ভাবে।
ও জানে, ও দেখেছে,
রাষ্ট্র কীভাবে দেশকে
চা-য়ে ডুবিয়ে খায় প্রতিদিন।
জেল থেকে লেখা চিঠি - ২
গত তিনদিন খবরের কাগজ আসেনি।
ওয়ার্ডেন উত্তর দেয়নি।
প্রশ্ন করলে নিরেট,মহান
দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে থাকে ও।
চোয়াল শক্ত হয়।
ঘনঘন শ্বাস পড়ে।
মুখ ফোটে না।
আমিও ফিরে যাই
আবশ্যিক মেনে নেওয়ার দিকে।
ওঁর দাবিটা ওঁকে বোঝাতে পারিনি।
আমার দোষ।
শেখাতে পারিনি কেড়ে নিতে হয়
শ্রমের দাম। ফসলের ভাগ।
আমার দোষ।
সংবিধান মেনে নিতে শিখিয়েছি।
বুঝে নিতে নয়।
আমার দোষ।
কাটাকুটি খেলায়
অজান্তেই ভিজিয়ে ফেলেছি অর্ধেক শরীর।
তাই ওর পলাশের রঙ জানা নেই।
প্রথম বৃষ্টির স্বাদ চেনা নেই।
শিউলি কুড়ানো নেই ছটফটে শরতে। এমনকি যাতায়াত নেই
হফ্তাহীন কোনও ফেরিঘাটের দিকেও।
অথচ ও জানে ঠিক কীভাবে
স্যালুট থেকে উন্নয়ন ছুঁয়ে
নিঃশব্দে চলে যেতে হয় সাষ্টাঙ্গ প্রণামে।
জেল থেকে লেখা চিঠি - ৩
ধ্বংস হওয়ার আগে
আরও একবার এখানে আসতে চাই।
এই বিকট গন্ধের দমবন্ধ কুঠুরিটায়।
ওয়ার্ডেনকে বলেছি সে কথা।
ও আমায় গোর্গাবুরু যাওয়ার কথা বলেছে।
সে পাহাড়ের মাথা থেকে
ফুটে ওঠা পলাশ আর নিভে আসা আগুন
দুটোই ভালো দেখা যায়।
দেখা যায় নদীর কিনারে দাঁড়িয়ে থাকা
ভর্তুকিহীন সম্ভাব্য সন্ধ্যার ছবি।
আমি তো এর থেকে আরও বেশী কিছু চাই।
আমি চাই কাদামাখা চাষারে শরীর,
গোলা ভরা ধান।
ধোঁয়া ওঠা নদী পাড়,
সাইরেনে ঘুম ভাঙা দিন।
আমি চাই হাপিত্যেশে বসে থাকুক
দু'টাকা কিলোর ফেয়ার প্রাইস সপ।
বিকেল রঙে ফিরে আসুক পড়ুয়ার দল,
খিলখিলে পানবাড়ি শিশু নিকেতন।
আমি চাই নির্মেদ ভালবাসা লেগে থাকা
লেঠেলবিহীন প্রায়ান্ধকার গলি।
এই সব কিছুর জন্যই আমাকে
এখানেই ফিরে আসতে হবে। বারবার।
আমি জানি,
প্রতিটা পলাশে আগুন পেরোতে হয়।
প্রতিটা আগুনে লেখা থাকে ক্রোধ,
পবিত্র শোকের হিসেব।
জেল থেকে লেখা চিঠি - ৪
এখান থেকে যতবার ফিরে গেছি
ততবার অন্তত
দু'বছর বয়স বেড়েছে সোহিনীর।
সন্ধে গাঢ় হয়েছে অলকার।
উঠোন লেপে পুজো দিয়েছে মা।
ঈশ্বরে বিশ্বাস আছে কিনা
তা তোমাদের বলব না আমি।
মায়ের হাতের সিন্নিতে আমার বড় বিশ্বাস।
কাস্তে বা কমরেডের থেকেও বেশী।
ওতে কর্পূরের গন্ধ আছে।
আছে ঢালু রোদ,রঙবেরঙের পাখি,
রাস্তায় উপচে আসা বৃষ্টি ছোঁয়া নদী-গান।
ভোট এলেই সুগভীর রাত ফিরে আসে।
ফিরে আসে সুনিপুণ অমুকতমুক।
দেরি করে দল ছাড়ে কেউ।
ছাড়ে ভদ্দলোকি পাড়া।
কেউ বসে বিহ্বল ছায়ার কাছে
ত্যাঁদোর জন্তুর মতো।
বড়শিতে ভোট তোলে, লাশ তোলে কেউ।
সলতে ছুঁয়েছি বলে, সন্দেহজনক।
আমাকে নিয়ে আসে ওরা,এখানে।
এই দমবন্ধ কুঠুরিতে।
চৌকাঠে পুলিশের গাড়ি আসে।
সোহিনী কলম গুছিয়ে দেয়।
অসাড় আঙুলে ঠোঁট চেপে ধরে মা।
অলকা উনুন নামিয়ে রাখে সুঠাম শরীরে।
মুঠো করি হাত,আগুন ফুটিয়ে রাখি বুকে।
নিজেকে নিজেই বলি-
যদি,জিরাফের নাম গণতন্ত্র,
সীমানার নাম ভোট।
তবে,সোহিনীর নাম জয়দেব বসু
মানুষের নাম জোট।
জেল থেকে লেখা চিঠি - ৫
তোমরা কেউ
দেবদত্তার নাম শোননি কখনও।
দেবদত্তা সোরেন। বাড়ি গোকরুই।
ঠিক রোগা নয়, রুগ্ন। মাজা রং।
পলাশ পোড়া মানুষের যেমন হয়।
যেমন হয় বহুদিন আধপেটা খেলে।
চোখের নীচের কালিটা ডাগড় বর্ষাতেও
শরীরের মতো
ফ্যাকাশে হয়নি কখনও।
বড় বেশী কথা বলা মেয়ে।
ধানের ভাগ বুঝে নেওয়া মেয়ে।
দগদগে বোরো ধান।
ফিলোজফি পড়েনি।
জানে না বিপ্লবী মানুষের কথা।
তবু রক্তের ভিতর অজস্র ফড়িংয়ের ডানা
বিছিয়েছে যৌথ খামার।
বিছিয়েছে শীতলপাটির মাপে সেঁকে রাখা
কোজাগরী রাত।
আর কখনও ডাকতে পারব না আমি।
নিজের ভিতর ছাড়া
দেখতে পাব না কোথাও।
দেবদত্তাকে ওঁরা খুঁচিয়ে মেরেছে!
অথচ ওঁদের জন্যই ও মিছিলে হেঁটেছে।
হেঁটেছে তাঁদের জন্যও,
শ্রী-এর জন্য যাঁদের
শ্রী ত্যাগ করতে হয়েছে বহুবার।
হাঁটতে হাঁটতে সাঁকো পেরিয়ে
ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছে অসম্ভবের খোঁজে।
লাফিয়ে উঠেছে ঢেউয়ের মাথায়,
একটা ভাতাবিহীন
থৈ থৈ শ্রাবণের দেশ দেখবে বলে।
যেখানে গলাভর্তি বিলাপ পেরিয়ে যায় নদী।
মহুল ফোটে
সহজবোধ্য কাস্তে রঙের চাঁদে।
বাহ , অসাধারণ ।
ReplyDelete