সোনালী রঙের ফ্যান্সি হেয়ার ক্লীপ
মা, তুমি আরও একবার ভেবে দেখো কিন্তু। তোমার সারাদিন স্কুল, আমার আবার সেলসের চাকরি- দেন হু উইল লুক আফটার দ্যট ডাইনি বুড়ি?
'শুভ, মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ। উনি তোমার ঠাম্মা- তোমার বাবার জন্মদাত্রী মা। আমি যখন এই অসহায় বৃদ্ধাকে এখানে এনে রাখার কথা ভেবেছি তখন তাকে দেখাশোনার ভারও আমার, তুমি চিন্তা কোর না'- আলনা গোছাতে গোছাতে সুমনা ছেলের দিকে না তাকিয়েই কথাগুলো বলে। সুমনার 'তুমি' করে কথা বলা শুনেই শুভ বুঝে যায় মাদার ইজ সিরিয়াস। কিন্তু ঐ ডাইনি বুড়িকে এখানে এনে রাখার ব্যাপারে ছেলের মতামতের কোন তোয়াক্কাই যেন করতে চাইছে না মা- সেটাই বা শুভ মেনে নেয় কিভাবে।
'মা, তুমি সত্যি আশ্চর্য মানুষ! ঐ অসভ্য, অমানবিক উইচ-কে ডাইনি বুড়ি বললাম বলে তুমি রাগ কোরছ। কিন্তু আমার তো মনে হয় আমি ঐ বৃদ্ধাকে ঠাম্মা বললেই বরং তোমার রাগ করা উচিত। ছয় বছর বয়সটা কারো কারো জীবনে অনেক কিছু বোঝার জন্য যথেষ্ট বয়স- তা' ভুলে যেওনা মা'। ছেলে কি বলতে চাইছে তা' না বোঝার কারণ না থাকলেও সুমনা চুপ থেকেই নিজের কাজ করে যায়। নিজের মুখে সেসব কিছু না বললেও শৈশবেই পিতৃহীন ছেলেকে তার আপন অভিজ্ঞতায় কিছু বুঝে নেওয়া থেকে বিরতও করতে পারেনি। শাশুড়িমাকে এখনে নিয়ে আসার সিদ্ধান্তটার পেছনে মায়ের ভাবনার শরিক যে শুভ হতে চাইবেনা এই মুহূর্তে সেটাইতো স্বাভাবিক।
'তোর বিছানার চাদর, বালিশের ঢাকনাগুলো বদলে দিই'?- সুমনা বিষয়ান্তরে যাওয়ার প্রয়াস করে। যদিও
ছেলে ওর ঘরে মায়ের প্রবেশ একরকম 'নিষিদ্ধ' করে রেখেছে মাস কয়েকতো হলোই। শুভ হাত নাড়িয়ে জানায় দরকার নেই, তারপর 'একটু আসছি' বলে মোবাইল হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মা অপলক চেয়ে থাকে পুত্রের গমনপথের দিকে। সুমনা এক রকম নিশ্চিত শুভর চেতনা জুড়ে এই মুহূর্তে রয়েছে সেই প্রায় বিশ বছর আগের সেই দিনগুলোর বারংবার ভুলে যেতে চাওয়া স্মৃতিটা। যখন ছ'বছরের ছেলের হাত ধরে এক বিধবা মহিলাকে তার শ্বশুরবাড়ির লোকজন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে একরকম বাধ্য করেছিলো।
সুমনা আর বিতনুর ভালোবাসার বিয়েটা সুমনার অভিভাবকরা মেনে নিতে পারেনি। সুমনাও কোনদিনই আর নিজেদের বাড়িতে যায়নি বা বাড়ির লোকও কোনদিন আসেনি। বিয়ের দ্বিতীয় বছরেই আনন্দের বন্যা বইয়ে সংসারে নতুন অতিথি হয়ে শুভর আগমন। শ্বশুরবাড়িতে কয়েকটা বছর খারাপ কাটেনি সুমনাদের। বিতনু প্রমোশন পেয়ে আরো ব্যস্ত মানুষ- দায়িত্বের সাথে পাল্লা দিয়ে সিগারেট খাওয়াও বাড়ে।
বেশ কিছুদিন ধরেই বিতনুর কাশি আর তার সাথে পিঠব্যথাটা সারছেই না। মাঝে একদিন প্রায় জোর করেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল সুমনা। নানান পরীক্ষানিরীক্ষার পর বায়োপসি রিপোর্টে বিতনুর স্টেজ ফোর ফুসফুসের ক্যান্সার ধরা পড়লো।
সবরকম চেষ্টা করেও বিতনুকে এক বছরের বেশী বাঁচিয়ে রাখা গেলোনা। শুভর বয়স তখন মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর। বিতনুর চিকিৎসার খরচের অনেকটাই ওর কোম্পানি দিলেও সুমনার সঞ্চয়ের ভাঁড়ার এখন শূন্য। কিছুদিন পর ইন্স্যুরেন্সের
টাকা, পিএফ, গ্র্যাচুইটি মিলে কিছু টাকা সুমনার হাতে এলে সেটার পুরোটাই বড়জা প্রথমে ভালো কথায় পরে হুমকির স্বরে চেয়ে বসে। সুমনা রাজী না হলে চলে শুরু হয় নানান ভাবে নির্যাতন। শ্বাশুড়ি তো কথায় কথায় স্বামীখেকো বলে গালাগাল দে'য়া শুরু করে।
বিতনুর এভাবে চলে যাওয়ার খবর পেয়ে দীপশিখাদি একদিন দেখা করতে আসে। দীপশিখাদি একটা স্কুলে পড়ানোর সাথে সাথে মেয়েদের সামাজিক ন্যায়ের অধিকার নিয়ে 'সোচ্চার' নামে একটা এনজিও চালায়। সুমনাও একসময় সক্রিয়ভাবে 'সোচ্চার'-এর সাথে যুক্ত ছিলো। সুমনার মুখে সবকিছু শুনে দীপশিখাদি ওকে শ্বশুরবাড়ির অন্যায় দাবীর কাছে হার না মানার সাহস যোগায়। সুমনাও চাকরির চেষ্টা শুরু করে।
মাঝে একদিন একটা স্কুলে ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যায় সুমনার। এসে দেখে শুভ ঘুমিয়ে আছে। ঘুম থেকে ওঠালে শুভ কাঁদতে কাঁদতে বলে কেউ ওকে খেতে তো দেয়ইনি- উল্টে ঠাম্মা মেরেছে। সেদিন
সুমনা আর কান্না সামলাতে পারেনি। শুভ মাকে কাঁদতে দেখে নিজের ক্ষিদে ভুলে যায়। সুমনা বুঝে যায় সদ্য পিতৃহারা শুভর জন্য এই বাড়ি নিরাপদ নয়।
দীপশিখাদির চেষ্টাতেই একটা স্কুলে গ্র্যাজুয়েট টিচারের চাকরি পেয়ে যায় মাস দুয়েকের মধ্যে। স্কুলের কাছাকাছি একটা ছোট বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে আসে সুমনা-দীপশিখাদিই এক আত্মীয়স্বজনহীন বয়স্কা মহিলাকে শুভকে দেখাশোনা আর বাড়ির কাজকর্ম করার জন্য সাথে দিয়ে দেয়। সেই বীনাদি এই বাড়িতেই চার বছর আগে মারা যায়। বীনাদি না থাকলে সুমনার এমএ পাশ করাটা আর হতনা।
মাসখানেক আগে একদিন দীপশিখাদির মুখে ঘটনাটা শুনে অবাক হয়ে যায় সুমনা। দুদিন আগে পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে 'সোচ্চার'-এর কয়েকজনকে নিয়ে দীপশিখাদি যেখানে যায় সেটি সুমনার ছেড়ে আসা শ্বশুরবাড়ি। শ্বশুরমশাই ও ভাসুরের মৃত্যু আগেই হয়েছিল। এখন বড়জা আর তার আধা-বেকার ছেলে বাড়িঘর সম্পত্তি তাদের নামে লিখে দেওয়ার জন্য সুমনার প্রায়ান্ধ শাশুড়ির উপর বেশ কিছুদিন ধরেই মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছিল। 'সোচ্চার'-এর হস্তক্ষেপে পুলিশ বড়জা আর তার ছেলেকে গ্রেপ্তার করেছে আর অসুস্থ বৃদ্ধাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
সুমনা ঠিক করে শাশুড়িমা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে নিজের কাছে নিয়ে আসবে। অন্যেরা হয়ত বলবে বৃদ্ধার এই শাস্তি প্রাপ্যই ছিল। 'সবাই যদি চোখের বদলে চোখ নিতে থাকে তবে এই পৃথিবী দ্রুত অন্ধলোকদের বাসভূমি হয়ে যাবে'- গান্ধীজীর এই কথাটা অন্তত সুমনা বিশ্বাস করে। প্রশ্নটা মানবিকতার, প্রশ্নটা নারীচেতনার, প্রশ্নটা নারীদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতির। বিতনুর বৃদ্ধা মা অসুস্থ ও অসহায়- এটাই এই মুহূর্তে সুমনার কাছে একমাত্র বিবেচ্য।
মা যে আজ হাসপাতালে ডাইনি বুড়িকে দেখতে যাওয়ার জন্য ছুটি নেবে তা' ভাবতেই পারেনি শুভ। অদ্রিজা দুপুরে অফিস ম্যানেজ করে আবার এসে না পড়ে! - মা'র সামনে পড়ে গেলেই চিত্তির! বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে অদ্রিজাকে ফোন করে আজ আসতে মানা করে। অদ্রিজা কারণ কিছু জানতে চায়না শুধু বলে চারদিন আগে ও শুভর বিছানায় ওর প্রিয় সোনালী রঙের ফ্যান্সি হেয়ার ক্লীপটা ফেলে এসেছে, শুভ যেন খুঁজে বের করে রাখে। মনে মনে গজগজ করলেও শুভ মুখে বলে- জানি রে বাবা- ঐ সোনালী রঙের উপর রুপোলী ছিট ছিট প্রজাপতি ডিজাইনের তো?
বিকেল নাগাদ সুমনা হাসপাতাল থেকে ফিরে এল। শুভ কিছু না জিজ্ঞেস করলেও সুমনা জানায় আর দিন চারেক পরেই শাশুড়িমাকে ছেড়ে দেবে- এই সময়ের মধ্যেই ওনার এ'বাড়িতে থাকার ব্যবস্থাটা সুমনাই করে নেবে। সন্ধ্যে হতেই শুভ বাইক নিয়ে বেরিয়ে যায়, অদ্রিজাকে পিকআপ করে একটু নিরিবিলি জায়গায় যেতে হবে, অনেক কথা আছে। কিছুদূর গিয়ে শুভর খেয়াল হয় অদ্রিজার বিছানায় ফেলে যাওয়া সোনালী রঙের ফ্যান্সি হেয়ার ক্লীপটা তো খুঁজে দেখাই হয়নি। আচ্ছা ঠিক আছে- অদ্রিজা জিজ্ঞেস করলে কিছু একটা বলে দেওয়া যাবে। আজ বাড়ি ফিরে এই ক্লীপ খোঁজার কাজটাই আগে করবে- নিজেকে কথা দেয় শুভ।
শুভর মুখে ওর ঠাম্মাকে নিজেদের বাড়িতে আনার ব্যাপারে মায়ের জেদ ইত্যাদি সবিস্তারে শুনে অদ্রিজা খিক খিক করে হেসে বলে- আমি আর তোমাদের বাড়িতে অভিসারে যাচ্ছিনা। বাট ইয়েস, ইফ য়্যু থিঙ্ক অফ ম্যারেজ- দ্যাটস ওকে। কিন্তু তাহলেও বিয়ের পর তোমাদের বাড়িতে আমি থাকতে যাচ্ছিনা। আমি স্যাঙ্গুইন তোমার মা'র সাথে আমার বনবেই না।
আমার মা'র সাথে ঝামেলা?- অ্যাবসার্ড ডার্লিং, অ্যাবসার্ড!- তুমি আমার মাকে জানো না তাই বলছো। শি ইজ গ্রেট - নাহলে যে শাশুড়ি তার ছেলের বৌকে দিনের পর দিন নির্যাতন করেছিলো তাকেই এখন নিজের বাড়িতে এনে রাখতে চায়'?- শুভ অদ্রিজাকে বোঝাতে প্রয়াসী হয়।
'আমার ভাবনাটা ফ্রম এ ডিফারেন্ট অ্যাঙ্গেল'- অদ্রিজাকে একটু সিরিয়াসই মনে হয় শুভর- 'তোমার
বাবা যখন মারা যান তখন তোমার মায়ের বয়স বিলো থার্টি হবে। শি ওয়াজ এডুকেটেড অ্যান্ড কোয়াইট গুড লুকিং। স্টিল দেন উনি আবার বিয়ে করার কথা ভাবেননি, কেন জানো? জাস্ট তোমার জন্য শুভ, তোমার জন্য। পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর ট্রমাটিক অভিজ্ঞতার পর তোমাকে আর কোন কষ্ট যাতে পেতে না হয় তার জন্য। ইয়েস শি মে বি এ গ্রেট লেডি টু হার সন। কিন্তু তার ডটার-ইন-ল'র জন্য- মে বি দ্য রিভার্স।
'মানে'?- শুভ অদ্রিজার কথা কিছুই বুঝতে পারেনা।
'আমি এত কনফিডেন্স নিয়ে কথাগুলো কি করে বলছি জানো?- আমার এক জ্যাঠতুতো দিদির বিয়েও ঠিক তোমার মত অল্প বয়সে বিধবা হওয়া এক মায়ের একমাত্র ছেলের সাথে হয়েছিলো। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ডিভোর্সের মামলা। ইউ নো হোয়াই?- ছেলের মা তার বৌমাকে তাদের মা-ছেলের সুখের সংসারে ইনট্রুডার, অনুপ্রবেশকারী ভাবতো- যখন তখন ছেলেবৌমার ঘরে ঢুকে পড়ত- উঁকি মারত। কারণটা সাইকোলজিক্যাল- এমন মায়েদের তাদের একমাত্র ছেলের উপর একটা প্রবল অধিকারবোধ নিজেদের অবচেতন মনে গ্রো করার সম্ভাবনা থাকে। অ্যান্ড দ্যাটস দ্য রুট অফ অল দ্য প্রবলেমস'- অদ্রিজা এবার শুভর দিকে সোজাসুজি তাকায়- 'হোয়াই শুড আই বিলিভ যে তোমার মা অন্যরকম'।
মা'র সাথে অদ্রিজার অবনিবনার সম্ভাবনা শুভকে ভাবায়। মা যে তার নিজের মনোভাবে অনমনীয় তা' তো ঠাম্মার ব্যাপারে দেখাই যাচ্ছে। আর অদ্রিজার যা মুখ!- দুজন এক ছাদের তলায় থাকলে প্রতিদিন কুরুক্ষেত্র বাধা প্রায় অনিবার্য। কিন্তু অদ্রিজাকে ছাড়া বাঁচবেই বা কি করে! বাড়ি ছেড়ে আলাদা থাকা ছাড়া উপায় কি? কিন্তু মা'কে একথা বলবে কিভাবে? এই মুহূর্তে মা'র ঠাম্মাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসার একতরফা সিদ্ধান্তটাকে শুভর আবেগে বিরাট আঘাত হিসাবে দেখিয়ে বাড়ি ছাড়ার একটা অজুহাত খাড়া করা যেতেই পারে।
বিয়ের পর একসময় অদ্রিজাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে বাড়িতে আবার ফিরেও আসবে। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবে না! অদ্রিজাকে নিজের পরিকল্পনাটার কথা কিছু আর বলে না শুভ।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গতে অনেক দেরী হয়ে যায় শুভর। মা সেই সকাল থেকে ফোনে কাদের সাথে এত কথা বলে যাচ্ছে? হাতমুখ ধুয়ে সারতে না সারতেই মা চা নিয়ে হাজির। মনে মনে অনেকবার রিহার্সাল করা কথাগুলো শুভ সকাল সকাল সেরে নিতে চায়।
'মা, তুমি যখন একতরফা ভাবে ঐ ডাইনি বুড়িকে এখানে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ- তখন আমার পক্ষে এই বাড়িতে আর থাকা সম্ভব নয়- আমাকে ক্ষমা কোর মা'- শুভ অন্য
দিকে মুখ করে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে।
'তোমার ডাইনি বুড়ি সম্ভবত এখানে আর কোনদিনই আসবেনা। সকালবেলায় হাসপাতাল থেকে খবর দিলো কাল রাতে শাশুড়িমা বেড থেকে পড়ে গিয়ে মাথায় ভীষণ চোট পেয়েছে, বাঁচার আশা ক্ষীণ। তবে তুমি এমনিতেও এই বাড়ি ছাড়ার কথা ভাবলে আমি অখুশী হবোনা। একটা ফ্ল্যাট নিয়ে বিয়ের পর বৌ নিয়ে থাকার মতো করে আগেভাগেই গুছিয়ে নাও। আমাদের এনজিও-র জন্য একটা বড় অফিসঘর দরকার- তুমি ছেড়ে দিলে তোমার ঘরটাই এই কাজে লাগানো যাবে'- মায়ের মুখে 'তুমি' সম্ভাষণ শুনে শুভর বুঝতে দেরী হয়না যে মাদার ইজ সিরিয়াস।
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে শুভ নিজের ঘরে ঢুকে মাথাটা এপাশ ওপাশ ঝাঁকিয়ে সচল করার চেষ্টা করে। এতো মেঘ না চাইতেই জল! কিন্তু মা হঠাৎই কেন বিয়ের কথাটা বললো? মা
কি কিছু টের পেয়েছে? সর্বনাশ! কোনমতে চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে শুভ ওর বিছানায় অদ্রিজার ফেলে যাওয়া সোনালী রঙের ফ্যান্সি হেয়ার ক্লীপটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকে। কিন্তু পায় না। শুভ মাথায় হাত দিয়ে বিছানায় বসে পড়ে।
সুমনা স্কুলের জন্য বেরিয়ে যেতেই শুভ অদ্রিজাকে তড়িঘড়ি ফোন করে। অফিসে যাওয়ার জন্য স্কুটিটা স্টার্ট করতেই যাচ্ছিলো অদ্রিজা। ব্লুটুথ হেডসেট অন করাই আছে, স্কুটি চালাতে চালাতেই বললো- ইয়েস শুভ- এনিথিং আর্জেন্ট?
- আর্জেন্ট মানে! তোমার হেয়ার ক্লীপটা-
- পেয়েছো- গুড, সন্ধ্যেবেলায় নিয়ে এসো কিন্তু- অদ্রিজা ফোন কেটে দেয়।
নাও ল্যাঠা! এই হাফ-পাগলি পুরো কথাটা শুনলোই না কিন্তু সন্ধ্যেবেলায় ক্লীপটা চেয়ে যখন পাবেনা তখন একটা সিন ক্রিয়েট করবে। ঠিক আছে, যা হবে দেখা যাবে- এসব নিয়ে পড়ে থাকলে চাকরি যাবে। স্নান খাওয়া সেরে শুভ অ্যাটাচি গুছিয়ে বাইক নিয়ে আউটডোর ভিজিটে বেরিয়ে পড়ে। সারাদিনে ইচ্ছে করেই অদ্রিজাকে ফোনটোন করেনি শুভ- যা কথা হওয়ার সন্ধ্যেবেলায় মুখোমুখি বসেই হবে- সে সময় অন্তত কথার মাঝে ফোন কেটে দেওয়ার মত ব্যাপার ঘটবেনা।
সন্ধ্যেবেলায় দেখা হলে অদ্রিজা একবারের জন্যও হেয়ার ক্লীপটার কথা ওঠায় না। শুভও চটপট আসল প্রসঙ্গে যায়- সকালে ওর আর মায়ের মধ্যে হওয়া কথাগুলো সবিস্তারে বলে। 'আজ থেকেই একটা ফ্ল্যাটের খোঁজ শুরু করি কি বলো'- শুভর কন্ঠে ছেলেমানুষি উচ্ছ্বাস। অদ্রিজা যেন শুভর ফ্ল্যাট খোঁজার কথাটা শুনতেই পায়না। অন্যদিকে তাকিয়েই গলায় একরাশ বিস্ময় নিয়ে স্বগতোক্তি করে - 'তোমার মা সত্যিই তাই বললেন- গ্রেট সোল ইন্ডিড'!
'শুভ'- অদ্রিজার গলাটা একদম অপরিচিত শোনায়- 'ইয়েস নাউ আই অ্যাম কনভিন্সড তোমার মা সত্যি অন্যরকম। তুমি ছেলে হয়েও তোমার মায়ের ভাবনার গ্রেটনেসটা ধরতে পারনি- দ্যাটস ডিসগ্রেসফুল! শি উড বি গ্রেট টু মি অ্যাজ মম-ইন-ল। বিয়ের পরও আমি ওনার সাথেই থাকবো- ইউ স্কাউন্ড্রেল মে স্টে সামহোয়্যার এল্স ইফ ইউ সো লাইক। তুমি তোমার অসুস্থ ঠাম্মাকে সেই ছোটবেলার অভিজ্ঞতার ন্যারো পার্সপেক্টিভে যেভাবে বিচার কর সেটা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতই। কিন্তু তোমার মায়ের বিচারধারাটার ভিত্তি ভালোবাসা, ক্ষমা, মানবিকতা। উনি তার একমাত্র সন্তানকেও মায়েদের সেই চেনা অধিকারবোধের ঘেরাটোপে আটকে রাখতে চাননি। দ্যাট রিয়্যালি মেক্স হার ইউনিক'!
'মাই গড! কাল যা বলেছিলে আজ তার থেকে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেলে'?- শুভর গলায় বিস্ময়- 'তুমিতো সকালে আমার কথাটা পুরো শুনলেই না- তোমার ফেলে যাওয়া হেয়ার ক্লীপটা আমি খুঁজে পাইনি, শিওরলি ওটা আগেই মায়ের হাতে পৌঁছেছে। অ্যাজ এ রেজাল্ট মা রাগে, ক্ষোভে আমাকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেছে। আর যখন বলেই ফেলেছে তখন'- শুভ ফ্ল্যাট খোঁজার প্রস্তাবটা আঁকড়ে থাকতে চায়।
'দ্যাটস সিম্পলি নট পসিব্ল শুভ'- অদ্রিজা অদ্ভুত হেসে উঠে দাঁড়ায় তারপর মাথাটা পুরো ঘোরায়- 'আজ অফিসে ব্যাগে কি একটা খুঁজতে গিয়ে ক্লীপটা পেয়ে গেলাম- কখন যে রেখেছিলাম মনেই নেই'।
শুভ অদ্রিজার চুলে শোভমান প্রজাপতি ডিজাইনের সোনালী রঙের ফ্যান্সি হেয়ার ক্লীপটার দিকে অপলক চেয়ে থাকে।
পড়া হলো l লেখার ধরণ চমৎকার l শেষ পর্যন্ত আকর্ষণ থেকে যায় l সুন্দর সামাজিক বাৰ্তা আছে l সব মিলিয়ে ভালো গল্প l শুভেচ্ছা রইলো l
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDelete