গদ্য - অর্ঘ্য দে


কৈশোরের লুডো


 

লাল ঘুঁটি - জিম্বাবোয়ে বা ওয়েস্টইন্ডিজ

নীল - ভারত, শ্রীলঙ্কা বা ইংল্যান্ড

সবুজ - পাক বা দক্ষিণ আফ্রিকা

হলুদ - অস্ট্রেলিয়া

 

     এসব শুনে আপনারা ভাবছেন নানা রঙের ঘুঁটি সাথে দেশের কী সম্পর্ক। আমার আর আমার পিসতুতো দাদা কৃশানু ওরফে বাবাইয়ের ছোটবেলা এমনকি কিশোর বয়সেও লুডোর সাথে জড়িয়ে আছে এমনি অদ্ভুত মায়াবাস্তবতা। তখন সবার মনে ক্রিকেটের পাগলামো। এই পাগলামো নতুন রূপ নিয়েছিলো লুডোয়। চেনা লুডোর সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলাম ক্রিকেট। এই দুয়ের সংমিশ্রণে জন্ম নিয়েছিল আমাদের মস্তিষ্কপ্রসূত লুডোক্রিকেট খেলা।
 
   লুডোক্রিকেটের পাশাপাশি আমরা খেলাটাকে লুডোবিশ্বকাপ বলতাম। লুডোয় প্রথাগত নিয়ম মেনেই খেলা চলত। শুধু লাল-নীল ঘুঁটিগুলো দেশ হয়ে যেতো দু’জনের কল্পনায়। এভাবেই বিভিন্ন এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের খেলা হতো। ঘুঁটি বা দেশগুলোকে গ্রুপে ভাগ করে নিতাম। প্রথমে লিগের খেলা, তারপর সেমি ফাইনাল আর শেষে ফাইনাল। তবে সবসময় দেশের জার্সির রঙ মিলিয়ে ঘুঁটি নেয়া যেতো না। প্রয়োজনে পাল্টাতে হতো। যেমন জিম্বাবোয়ের সাথে ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলা হলে দু’জনকেই লাল ঘুঁটি হিসেবে ধরা যেত না। তখন যেকোনও একটা দলকে অন্য রঙের বেছে নিতে হতো ঘুঁটি। অ্যাওয়ে কিট বা দ্বিতীয় জার্সির মতো ব্যাপার অনেকটা। লুডোর সেই চার রঙা খোপ আর সাদা সাদা ঘরের মধ্যেই ঢুকে পড়ত ইডেন, পার্থ কিংবা লর্ডস।
     
     খেলায় ভারত সবসময়ই ফেভারিট ছিলো। আর বলাবাহুল্য ভারতকে জেতানোর চেষ্টা চলত টুর্নামেন্টের প্রথম থেকেই। ফাইনাল জিতলে তবেই টুর্নামেন্ট সার্থক হতো। খেলায় ভারত, মানে নীল ঘুঁটি যদি বিপাকে পড়তো বা বোঝা যেত যে নীল ঘুঁটির হার অবধারিত তখনই নানান ফন্দি-ফিকির ক'রে, যুক্তি সাজিয়ে খেলা বা টুর্নামেন্ট বাতিল করার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠতাম দু’জনেই। বিভিন্ন যুক্তির মধ্যে অতিপরিচিত ছিলো বৃষ্টি। মানে বৃষ্টিতে ম্যাচ বাতিল। অথচ ইনডোর গেম বৃষ্টিতে কখনই বানচাল হতে পারে না। তবু বৃষ্টি নামত কোনও এক অমোঘ নিয়মে। অতএব উপায়? “ফের ম্যাচ শুরু হোক”! আমার আর বাবাইয়ের পক্ষ থেকে আসতো এই প্রস্তাব। যদিও আমি বা বাবাই বিপক্ষের হয়ে খেলছি। ঘর হাসিতে ফেটে পড়তো। নিজেদের বানানো অদ্ভুত যুক্তিতে নিজেরাই হেসে লুটোপুটি যেতাম। এতটাই সরল আর ছেলেমানুষ ছিলো সেই ষড়যন্ত্র।
        
     তবে সমস্ত কূটনীতি আর নাশকতার গন্ডি পেরিয়ে চেনা সেই লুডো নতুনভাবে তার স্বকীয়তা মেলে ধরেছিল। সেই লুডো খেলা এতটাই উপভোগ্য হয়ে উঠেছিলো যে খেলতে খেলতে পৃথিবী থেকে আমরা দু’জন আলাদা হয়ে যেতাম। তারপর সময় বদলেছে। ইন্ডোর গেমস্‌-এর জায়গা নিয়েছে মোবাইল, কম্পিউটার গেমস্‌। বন্ধ হয়ে গেছে মাটিতে পাতা লুডো। তার সঙ্গেই যেন ভাঁজ করে তুলে রেখে দিয়েছি অপার্থিব সেই রম্যতার দিনগুলো।
   

Comments