তুই জীবন ছাড়িয়া গেইলে রে
- ১ -
ইয়াকুব ব্যাপারীর সঙ্গে আবার আমাদের দেখা হয়ে যায় ঘুঘুডাঙার হাটে।তখন মধ্য দুপুর।ভরা হাটের
গুমগুম শব্দ।ইয়াকুব গরুহাটির পাশে ঝাঁকড়া শিমুল গাছের নিচে ভবেন বৈরাগীর গান শুনছিল।ভবেনের গায়কখ্যাতি তিরিশ চল্লিশ গঞ্জ হাটে কিংবদন্তির মত।গৌরীপুরের লালজি রাজা তার গান ভালোবাসে।প্রতিমা বাইদর দলেও একসময় দোতরা
বাজাতো সে।
হাটে হাটে গান গেয়ে গেয়েই জীবন কাটিয়ে দিল ভবেন বৈরাগী।
ইয়াকুব আজ বায়না করেছিল দেহতত্ত্ব মনশিক্ষার
গানের।
আমরা যখন ইয়াকুবকে ভরা হাটের পাশে ঝাঁকড়া শিমুল বৃক্ষের নিচে আবিষ্কার করি,তখন সে ভবেনের
গানে উদ্বেল_
"ওরে টাকা পয়সা ভিটা বাড়ি
জীবন গেইলে সব রইবে পড়ি
সঙ্গের সাথী তোর কেউ তো হবে না"
গান শুনতে শুনতে ইয়াকুবের চোখ ভিজে যাচ্ছিল চোখের জলে।
সে কি দূরাগত হাওয়ায় মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়েছিল!
জন্ম কিংবা মরন নিয়ে কোন দার্শনিকতা তাকে আক্রান্ত করেছিল!
সমাধানহীন এই প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে গান কিন্তু বেজেই চলছিল_
"আরে হাতি মার্কা কেরাসিন তেল
কায় বা আইনছেন দ্যাশতে
বাপরে বাপ
মাওরে মাও
আজি মোর গাও ঝনঝন করে রে"
- ২ -
গঙ্গাধরের উজানে মাইল মাইল হাঁটতে হাঁটতে একসময় দাড়িয়েই পড়তে হয় বিমল মালিকে।
সে মুখ ফিরিয়ে পেছনে শীতের নদীকে দেখে।বিমলের কাধে ঢোল।গোয়ালপাড়ার কাঠি ঢোল।
এই ঢোলের জাদুতে অন্তহীন গানবাড়ির মানুষেরা উদ্বেল হয়ে ওঠে। বিমল মালির ঢোল কথা বলে।মানুষের দৈনন্দিন যাপন গানে আর ঢোলে ছড়িয়ে পড়ে দিক ও দিগরের দিকে।
"রাজার বেটির" দলে কত কত বছর জুড়ে বেজে চলেছে বিমল মালির জাদু ঢোল।
গত রাতে বিমল গিয়েছিল সিতানন্দ বুড়ার বাড়ি।
সীতানন্দর সারিন্দা আর বিমলের ঢোল_প্রায় সারারাত চলেছিল তাদের আসর।এমন আসর প্রায়ই বসে তাদের।সঙ্গে "চাওলা" আর "নাসিরউদ্দিন বিড়ি"।
গান চলে।গান থামে।
দুঃখ সুখের কথা হয়।দেশ গ্রামের কথা হয়।
এভাবে মত্ততা জাগে।স্মৃতিকন্দর থেকে ভুস করে জেগে ওঠে গানের কলি_
"বুড়া মাছ মারে রে
গঙ্গাধরের পারে
মাছ মারিতে মাছ মারিতে
বুড়াক নিল চিলে"
অন্যমনস্কতার ঘোর থেকে একসময় বেরিয়ে আসে
বিমল মালি।তারপর সে আবার হাটতে থাকে
গঙ্গাধরের উজানে।
এভাবে কত গল্প জমে ওঠে আমাদের এই চারপাশের পৃথিবীতে।
- ৩ -
"গঙ্গাধরের পারে পারে রে
কাশিয়া ঝোপা ঝোপা
তারি তলে সোনার বন্ধু ডাঙায় দোতরা"
বিকেল আর সন্ধ্যের ফাঁকে এই গান গাইতে গাইতে নদী গঙ্গাধরের বিস্তীর্ণ চরের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকেন বসন্ত মালি।বসন্তের কাঁধে মস্ত এক ঢোল। কাঠি ঢোল।এই জনপদের সকলেই এই ঢোল আর ঢোল কাঁধে হেঁটে যাওয়া বসন্ত মালিকে প্রায় সমার্থক ভাবেন।প্রায় তিন কুড়ি বছর জুড়ে এই ভূগোল পরিধী জুড়ে ঢোল নিয়েই কাটিয়ে দিলেন।তার ঢোল কথা বলে।গানের জুলুস জুড়ে এক তীব্র মাদকতা নির্মিত করতে থাকে বসন্তের ঢোল।
আজ বসন্ত যাচ্ছে কইমারির চরে।সেখানে "রাজার বেটির" গানের আসর।সারারাত ধরেই গানের জলসা চলে এই অঞ্চলে। গানবাড়ি জুড়ে মস্ত মেলা বসে যায়।আবার গান শুনে গঞ্জ গ্রামের বউ বিটিদের চোখ ভিজে যায়।আবার গানের মাঝে শরীরে পুলক জাগিয়ে দু চার পাক নেচেই ওঠেন শশীকান্ত,তারামোহন,চন্দ্রধরেরা।গান বুঝি তাদের জীবনের মস্ত উৎসব!অদ্ভুত যৌথতায় বেঁচে থাকা।
বসন্ত মালি যেমন ছাড়তে পারলেন না এই গানের মায়া।গান আর ঢোল তার জীবনকে কিভাবে পাল্টে দিল!
পুরোন দিনের স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে বসন্ত গঙ্গাধরের চর পেরোতে থাকে।স্মৃতি তাকে বিমনা করে।এত সবের মাঝে প্রায় সন্ধ্যের রহস্যময় পরিসর জুড়ে বসন্ত তার চোখের মায়াজল সামলাতে না পেরে পুনর্বার গেয়ে ওঠে গান_
"এপার থাকি না যায় দেখা রে
নদীর ওই পরের কিনার"
- ৪ -
জীবন খুব সুন্দর।জীবন আশ্চর্যরকম সুন্দর।ভরা সভায় যখন বসন্ত মালি ঢোল বাজায়, ঢোলে ঝড় তোলেন তখন জীবনের প্রতি মায়া বেড়ে যায়।
গঙ্গাধরের চর অতিক্রম করতে করতে কিংবা কইমারীর চরে প্রবেশ করতে করতে বসন্তের একটা প্রস্থানভূমির কথা মনে পড়ে যায়।কার্তিকের চর জুড়ে তখন দুধের সরের মতন হালকা কুয়াশায় পর্দা।আকাশে কুয়াশা মাখা অনবদ্য চাঁদ।বসন্তের অন্যমনস্কতা কাটে না! সে বুঝি অন্যমনস্কতার মধ্যে আবার গান টেনে এনে তার শরীরের পেশিসমগ্রতায়
কিরকম দূরাগত হয়ে পড়তে থাকে।আর চরের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পরে গানের সুর_
"হামার দ্যাশত বড় বাঘের ভয়
রে সোনা রায়"
জীবনের পর জীবন এভাবেই বাঁচা। বেচেঁ থাকা।
জীবন আদর করে।জীবন নিয়ে যায় ভরা হেমন্তের খেত মাঠে শূন্যতায়।বসন্ত প্রবেশ করেন কইমারির
চরে।আর এই প্রবেশের অনুষঙ্গে অন্তরীক্ষে ঘুরে বেড়ায়,উড়ে বেড়ায় গান_
"তুই জীবন ছাড়িয়া গেইলে
আদর করিবে কায় জীবন রে"
Comments
Post a Comment