গদ্য - সুব্রত ভট্টাচার্য


পূজো আসে, পূজো যায়

             

পূজো আসছে। ব্যাপারটাই আমাদের মনে একটা অদ্ভুত অনুভুতির সৃষ্টি করে। এসময় আকাশ পরিস্কার হয়ে যায়। গরম অথবা বৃষ্টির প্রাবল্য কমে আসে। নদীর পারে এবং অন্যান্য জায়গায় কাশফুল হাওয়ার দোলায় দোল খায়।

যারা বিদেশে চাকরি করেন, বাড়ী ফেরার দিন গোনেন। সময়মতো ছুটির ব্যাবস্থা করতে হয়, সাথে রিজার্ভেশন। তারপর সময় হলেই বাড়ী ফেরার পালা। ষষ্ঠীর আগেই পৌঁছুতে হবে বাড়ীতে। আত্মীয় পরিজন, বন্ধুদের সাথে দেখা হবার সময়তো এই পূজোর ছুটিতেই। তারপর আবার বছরভর কর্মব্যস্ততা।  

যারা বছরভর বাড়ীতে থাকেন তারা একটু বাইরে ঘুরে আসার খোঁজখবর নেন। এ খবর হঠাত নিলে হয় না।  মাস দুয়েক আগে থেকেই ট্র্যাভেল এজেন্সির  সাথে যোগাযোগ করে পাকা করে ফেলতে হয়। উত্তর না দক্ষিণে। ডুয়ার্স না দার্জিলিং নাকি সিকিম বা উত্তর পূর্বে।

পূজোর একদিন বা দু দিন আগে চেপে বসা ট্রেনে। তারপর গ্রাম শহর নদী মাঠ পেরিয়ে কয়েকদিনের জন্য নতুন ঠিকানায়।  দুটো বা তিনটে পরিবার একসাথে গেলে আরও মজা।

হোটেলওয়ালা, ট্যাক্সি, টোটো, অটোওয়ালা সবাই অপেক্ষায়। মানুষ আসবে, ঘুরে বেড়াবে পাহাড়ে, সমদ্রে, জঙ্গলে অথবা অন্য শহরে। মানুষ আসলেই দুটো পয়সা রোজগার। বাড়ীর মানুষ গুলোর মুখে একটু হাসি দেখা যাবে।

শহরের পূজোগুলোতে রয়েছে চাকচিক্য, আলোর রোশনাই। ভীড় করে মানুষ দেখছে সেসব । কিন্তু নাড়ীর যোগ কি একটু কম, বোঝা মুস্কিল। ছোট জায়গাতে কিন্তু মানুষের পুজোর সাথে যোগ বেশী। কাজকর্ম নিজেরাই বেশি করেন লোকজন। ভাড়া করা মানুষ কম। দুর্গাপূজো এখন অনেকটাই সামাজিক  অনুষ্ঠান। সব ধর্ম, ভাষাভাষীর মানুষ মিশে যান এ অনুষ্ঠানে । 

ইদানীং শহরের আবাসন গুলোতে পুজো হচ্ছে। যে পুজোয় মানুষের যোগদান দেখে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে একান্নবর্তী পরিবার আবার ফিরে এসেছে। সারা বছরের রেষারেষি ফেলে পুজোর কটা দিন আনন্দে মেতে উঠছে সবাই। পুজোর কটা দিন  দুপুরে আর রাতে  খাওয়া দাওয়ার ব্যাবস্থা পুজো কমিটির লাগোয়া প্যান্ডেলেই। পূজোর পাশাপাশি অনেক জায়গাতেই আবার চলছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।  অনেক অভিভাবকের অভিযোগ – ছেলে মেয়েদের আবাসন ছেড়ে বাইরে যাবার আপত্তিতে বাইরে ঘোরার ইচ্ছে বাতিল করতে হচ্ছে।

পূজো করতে গেলে ভালো পুরোহিত প্রয়োজন। পুরোহিত পেশায় মানুষের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। কিছু যুবক  অবশ্য আসছেন এ পেশায় তবে সংখ্যা বড় কম। পুরোহিতদের অভিযোগ ছিলো পূজোর জাঁক জমকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হলেও পুরোহিতদের কথা চিন্তা করতেন না অনেক কমিটি। সম্ভবত পুরোহিতদের অভিযোগ বর্তমানে কিছুটা কম।

মহালয়ার ভোরে পবিত্র মন্ত্রোচ্চারণে চারিদিক গমগম করে ওঠে। বিভিন্ন ঘাটে পিতৃপুরুষদের তর্পণ  হয়। শুরু হয় দেবীপক্ষ। সব পূজোর দল ব্যাস্ত  হয়ে পড়েন তাদের বাকী কাজ শেষ করতে।

পঞ্চমীর সন্ধ্যায় মা আসেন পূজোর প্যান্ডেলে অথবা মন্দিরে। ষষ্ঠী থেকে শুরু হয়ে যায় মায়ের উৎসব। ষষ্ঠী থেকে দশমী পুরোহিত আর কর্মকর্তারা ব্যাস্ত হয়ে পড়েন মায়ের পূজোয়। চলতে থাকে বোধন, অধিবাস, নবপত্রিকা স্নান, সাথে প্রতিদিনের পূজো, অষ্টমীতে পুষ্পাঞ্জলি তারপর সন্ধিপুজো ইত্যাদি।  দশমীতে মাকে বিদায় দেওয়া, সিঁদুর খেলা এবং শেষে প্রতিমা বিসর্জন।  আবার মাকে নিমন্ত্রন আসছে বছর ফিরে আসবার জন্য। বিজয়াতে বড়দের প্রণাম, ছোটদের আশীর্বাদ আর সমবয়সীদের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়।

ঢাকীরা পূজোর আগেই বেরিয়ে পড়েন। কোথাও বা বায়না করা থাকে, কোথাও আবার নতুন বায়না করতে হয়। তারা পূজো শেষ করে বাড়ী ফিরলে হাসি ফোটে ছেলে মেয়েদের মুখে। সরকারী কর্মীরা ভাগ্যবান, বোনাস ঘোষনা হয়। কল  কারখানা  বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের  কর্মীরা কম বেশী বোনাস পান। যারা স্বনিযুক্ত এবং ছোট ব্যাবসায়ী  তাদের ভরসা এই সরকারী , বেসরকারী কর্মী এবং বড় ব্যাবসায়ীরা। 

বর্তমানে কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পূজোর সময় পথশিশু অথবা গরীব ছেলেমেয়েদের বা বড়দের হাতে নতুন বস্ত্র তুলে দেন। কিছু সংগঠন পূজোর একদিন পথশিশু অথবা অনাথ শিশুদের নিয়ে পুজো দেখতে বের হন। কুর্নিশ এই সমস্ত সংগঠনের কর্মীদের।

পুলিশ, জল, বিদ্যুত, রেল, স্বাস্থ্য, প্রশাসন, পরিচ্ছন্নতা, প্রশাসন ইত্যাদি বিভাগের কিছু কর্মীর ছুটি থাকেনা এই উৎসবের সময়। তাদের সেবায় নির্বিঘ্নে পালিত হয় এই উৎসব। কুর্নিশ এই সব কর্মীদেরও।

দুবছরের অতিমারিতে এইসব হিসেব নিকেশ পাল্টে গেছে। অন্য রাজ্যে চাকরি করতে যাওয়া ছেলেমেয়েরা অনেকে ঘরে বসেই কাজ করছে। অনেকে আবার কাজ হারিয়ে অন্য কাজের সন্ধানে। অনেকের আবার বেতন কমে গেছে। অন্য রাজ্যে যাওয়া বিপুল পরিমান শ্রমিকের একটা বড় অংশ ফিরে যেতে পারেনি। অনেক মানুষ তাদের পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। অতিমারীর জন্য পুজোর আনন্দ খানিকটা ম্রিয়মান।

আমরা বিশ্বাস করি মায়ের আগমনে পৃথিবীর মানুষ দুঃখ কষ্ট ভুলে আনন্দে মেতে উঠবে। দু;খের দিন শেষ হয়ে মানুষের জীবন আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসবে।


Comments

  1. যথারীতি লেখক তার মরমী লেখার অনবদ্য ধারাটাকে এই লেখাতেও অব্যাহত রেখেছেন। লেখকের দৃষ্টিতে শারদোৎসবের অনুষঙ্গগুলি অনুপমভাবে ফুটে উঠেছে। এই উৎসব সবাইকে নিয়েই সেই সহজ সত্য টাই লেখক আমাদের অবার মনে করিয়ে দিলেন। লেখককে ধন্যবাদ। আপনার কলম সচল থাক।

    ReplyDelete
  2. অনেক ধন্যবাদ দাদা l ভালো থাকবেন l

    ReplyDelete

Post a Comment