স্বর্গদূত
- ১ -
মুখার্জি বাড়ির ফুটফুটে সকাল,
বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছেলে সাক্য তার ভূগোল বই নিয়ে স্যারের পড়া করতে বসেছে,অবশ্য পড়ায়
তার মন কতটা সেটা সেই জানে,
"লাইকা নামে একটি রাশিয়ান
কুকুর সর্ব প্রথম মহাকাশে পারি দেয় এরপর ইউড়ি গ্যাগারিন প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশে
পারি দেন...."
সাক্যর ঘরে আস্তে আস্তে একটি ছেলে
প্রবেশ করলো। বয়স সাক্যর থেকে বছর পাঁচেক বেশি হবে,মানে তেরো কী চোদ্দো, কালো গায়ের
রং, রুগ্ন চেহারা।দেখলেই বোঝা যায় এইটুকু বয়সেও সে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর অনেক নিষ্ঠুরতার
নিদর্শন পেয়েছে। তবে তার উজ্জ্বল চোখদুটি যেন অন্ধকারেও এক চিলতে আলো, যা অনেক লড়াইয়েরর
শক্তি জোগাতে যথেষ্ট। ছেলেটার নাম বিপ্লব। ওর মা এই বাড়িতেই কাজ করতো, কিন্তু করোনার
জন্য মা ওকে ছেড়ে চির ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়। বাবা ছিল পরিযায়ী শ্রমিক। বাড়ি ফেরার সময়
ওদের দলটা রেল লাইনে ঘুমিয়েছিল আর সেই ঘুম ওর বাবার জীবনে কাল হয়ে নেমে এলো। একটা ট্রেন
ছিন্ন ভিন্ন করে দিয়ে যায় ওর বাবার দেহ।
সেই থেকেই মুখার্জি বাবু ওকে বাড়িতে
স্থান দিয়েছে। তবে সাক্যর মা ওকে খুব একটা পছন্দ করেন না,ভাবেন বিপ্লব থাকলে হয়তো সাক্য
নষ্ট হয়ে যাবে।
"অ্যাই, মহাকাশ যানটা কী
রে? আর মহাকাশটাই বা কী? আকাশ শুনেছি, কিন্তু মহাকাশ বলে তো কিছু শুনিনি!" বিপ্লব
জিজ্ঞেস করলো সাক্যকে।
"আরে, তুই এটাও জানিস না,
মহাকাশ যান মানে হলো....." কথাটা শেষ করতে পারলো না সাক্য, তক্ষুনি শ্রীমতি মুখার্জি
ঘরে এসে ঢুকলেন। সাক্যকে ধমক দিয়ে বললেন, কিরে, তুই পড়া ফেলে ওর সাথে কথা বলছিস যে!"
সাক্য আমতা আমতা করে বললো, "না মানে.... মা, ইয়ে মানে আমি
তো পড়ছিলামই, ও ই তো এসে আমায় বিরক্ত করছে।"
কথাটা শুনে বাঁজখাই গলায় চেঁচিয়ে
উঠলেন শ্রীমতি মুখার্জি, "তোর এত বড়ো সাহস, তুই আমার ছেলেকে বিরক্ত করছিস! যা,
নিজের কাজ কর!"
বিপ্লব মাথা নিচু করে, চোখের জল
গড়িয়ে পড়ে বালতিতে রাখা ঘর মোছার জলের মধ্যে হারিয়ে যায়। সে বেরিয়ে যায় ঘর ছেড়ে।
ইতিমধ্যে শ্রীমতি মুখার্জী রাগে
আত্মভোলা হয়ে মোবাইলটা টেবিলে রেখে বেরিয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা বাগিয়ে নিয়ে সাক্য
আপনমনে গেম খেলতে শুরু করে।
সেই রাতে ঘুমের ঘোরে বিপ্লব কত
হিজিবিজি স্বপ্ন দেখলো। স্বপ্নে সে ভীষণ জোরে আকাশযান চালাচ্ছে। তার যানটা আকাশ থেকেও
আরও ওপরে, অনেক ওপরে উড়ে চলেছে। ওই যে সাক্য পড়ছিলো 'মহাকাশ' না কী, সেখান দিয়ে ছুটে
চলেছে বিপ্লব। কী সুন্দর সিঁদুরে রঙের মহাকাশ! কত রকমের ফুল ফুটে আছে, ছোট্টো ছোট্টো
মেঘের পাখি ভেসে বেড়াচ্ছে চারপাশে। সামনেই লাল টকটকে একটা নদী! কী সুন্দর একটা গন্ধ
চারদিকে, ঠিক মায়ের গায়ের গন্ধের মতো। আরও দূরে চলে যাচ্ছে বিপ্লব, নদী পেরিয়ে, পাহাড়
পেরিয়ে, আরও দূরে। হঠাৎ সে দেখলো সারা মহাকাশ জুড়ে ওর মায়ের মুখ ভেসে উঠেছে।
"বিলু, আমি জানতাম তুই একদিন অনেক বড়ো আকাশ যান চালাবি। আমি খুব খুশি হয়েছি বিলু।"
"মা, তুমি কেমন আছো মা? তুমি
চলে এসো আমার আকাশ যানে, আমি তোমায় নিয়ে যাবো আমার সাথে। আমার ওই বাড়িতে ভালো লাগে
না মা, সবাই খুব বকে আমায়।" বিপ্লব অঝোরে কেঁদে বলে।
"অ্যাই অসভ্য ছেলে, সারাদিন
শুধু কাজে ফাঁকি দেবার ফন্দি, তাই না?"
চমকে উঠে বিপ্লব দেখে তার মায়ের
মুখটা ক্রমশ শ্রীমতি মুখার্জির মতো হয়ে যাচ্ছে।
"চিৎকার করে গলায় রক্ত উঠে
গেলো, তবুও কেমন মোষের মতো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে দেখো! অ্যাই শুয়োরের বাচ্চা, ঘুম থেকে
না উঠলে একেবারে গলা টিপে মেরে ফেলবো!"
ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বিপ্লব।
"বেলা আটটা বাজে, এতক্ষণে উঠলেন আমার নবাবপুত্তর। যাও, বাথরুমে জামাকাপড় রাখা
আছে, ওগুলো কেচে আমায় উদ্ধার করো। ভালো লাগেনা বাপু, যত্তসব!"
রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন
মুখার্জি গিন্নি।
চোখ কচলাতে কচলাতে বিছানা ছেড়ে
উঠলো বিপ্লব। আচ্ছা, স্বপ্নটা কি ভোর বেলায় দেখলো সে? ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়!
তবে কি ওর স্বপ্নটাও একদিন সত্যি হবে?
তবে ঐ স্বপ্ন সত্যি হবে কিনা জানা
নেই, তার আগেই দু'বস্তা দুঃস্বপ্ন এসে ওর ঘরে উপস্থিত হলো। শ্রীমতি মুখার্জি বাড়ির
যত কাপড় আছে সব নিয়ে এলেন ওর ঘরে,তাকে শাসিয়ে গেলেন কাপড়গুলো যেন ঠিক করে পরিষ্কার
করা হয়। এত জামাকাপড়ের অর্থ বিপ্লব বুজতে পারে। আসলে শ্রীমতি মুখার্জি চান যে বিপ্লব
যেন সারাদিন এই সাংসারিক ফাই-ফরমাসের কর্ম বিপ্লবেই আবদ্ধ থাকে। তার ছেলের সঙ্গে যেন
সে কখনই মিশতে না পারে।
- ২ -
এখন সময়
অনেক পালটে গেছে। বিপ্লব এখন নিজের মর্জির মালিক, মুখার্জিদের সাথে তার সম্পর্কের পাট
বহুদিন হলো চুকে গেছে। সে এখন সারাদিন ব্যস্ত থাকে। ব্যস্ত থাকাটাই তো স্বাভাবিক কারণ
তার যে কখন ডিউটি পড়বে সেটা সে নিজেই জানেনা। আসলে কাজটা তো সমাজসেবার, তাকে রোজ অন্তত
পক্ষে পাঁচ থেকে ছয় জন কে আকাশে পৌঁছে দিতে
হয়। না,সে নিজে ওখানে যেতে পারেনি। তার ছোটবেলার মহাকাশে যাওয়ার স্বপ্নটা এখনও পূরণ
হয়নি ঠিকই, কিন্তু আকাশ যান চালিয়ে তার স্বপ্ন কে আংশিক ভাবে পূরণ করেছে সে। এখন সে
স্বর্গদূত হয়েছে, বহু মানুষের স্বর্গের ঠিকানা তার আকাশ যান দিয়েই তো ঠিক হয়!
Comments
Post a Comment