অনুনাটক - ডঃ রমলা মুখার্জী


দুর্গা


চরিত্রঃ

বিজয়া- ৫০ বছর, বিধবা, সুদামের মা

সুদাম- ঢাকী, ২৫ বছর, বিজয়ার ছেলে

দুর্গা- ২০ বছর, সুদামের বৌ

রাধা- প্রতিবেশী মেয়ে, ১৮ বছর 


প্রথম দৃশ্য

বিজয়া ।। সুদাম রে, তাড়াতাড়ি কর কেনে- হলুদ মুড়ি ভাজা তো হইয়ে গেল, ও বৌ কুথাকে গেলিন- মুড়ি, লাড়ু সব গুছিয়ে দে কেনে। ও বৌ –, ও সুদাম, সব কুথাকে যে গেল?

সুদাম ।।  এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন বটে মা গো? ও বাবা তুমি যে লাড়ুর পেদর্শনী খুলে বসেঞ্ছো-

বিজয়া ।। সে বছর শান্তিনিকেতনের পেদর্শনীতে আমার রান্না পেরথম হল ঐ লাড়ুর জোরেই লাকি?

সুদাম ।।  এই বীরভূম জিলাতেই এত রকমারী লাড়ু বানায় গো তা কি কি লাড়ু বানাইলে বটে?

বিজয়া ।। কেনে- ছোলার, সিঁড়ির, চিঁড়ের, খইএর, নারকিলের আর তিলের- অনেকদিন থাকবেক, গুড় দিয়ে কড়া করে পাক কইরেঞ্ছি বটে।

সুদাম ।।  তুমি পারও মা, লাড়ুর একদম বন্যা বইয়ে দিয়েছো।

বিজয়া ।। বাপের ঘরে তো কত রান্না, কত লোকগান শিখেঞ্ছি – কিন্তু তুর বাপটা অকালে সাপের কামড়ে মইরে গিল- অভাবের সংসারে-

সুদাম ।।  তুমি তো নেকাপড়াও শিখেঞ্ছ বটে-

বিজয়া ।। সবই কপাল, এইটে উঠলাম, আর বাবা বিয়ে দিয়ে দিল বটে- মাধ্যমিকটা পাশ থাকলে  একটো চাকরি-বাকরি কইরতে পারতাম-

সুদাম ।।  এই অল্পবয়সে মেয়েদের বিয়া দেওনটা ইখনও গিল না মা।

বিজয়া ।। তাই তো আমি তুকে বুলতাম পড় পড় – পাশ দে – তু বিএ পড়তে পড়তে ঢাকির দলে ঢুকে গেলিন – পাশটা দিলি না।

সুদাম ।।  কি করব মা, তুমি পাঁচটা বাড়ি রান্না করে করে কত আমার খরচ জুগাবে? তাছাড়া তুমার রক্ত তো মা, তুমি ভাল লোকগান গাও, আমিও গাই, ঢাক বাজাই, তবলা বাজাই – এসবই আমার বেশি ভাল লাগেন মাগো-

বিজয়া ।। লে লে আর মা-বেটাতে গল্প করলে হবেক লাই- সেই কেলকাতায় যেতে হবেক- যখন খিদে পাবেক, ঢাক বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে লাড়ু মুখে ফেলে জল খেইয়ে লিবি। বৌটা যে কুথাকে গিল?

সুদাম ।।  দুগগা – দুগগা –

বিজয়া ।।  দেখ কেনে শাক তুলতে বাগানে গিয়েছিল বটে-

[সুদাম বাগানে আসে দুর্গার খোঁজে]

সুদাম ।।  দুগগা – দুগগা- তু ইখানে দুগগা?- আমি হেঁকে হেঁকে সারা হইয়ে গিলাম। কি রে রা কাড়ছিস না কিনে?

দুর্গা ।।   আমাকে তুমার সাথে লিয়ে চল কিনে, কুলকাতার ঠাকুর দিখব বটে। সাবেকি আর থিমের 

নাকি বিরাট বহর সিথায় – চল না লিয়ে – 

সুদাম ।।  তু এখন পুয়াতি বটে- বেটাবেটি যাই হোক- একটু বড় হলেই লে যাব কুথা দিলাম তুর জন্যে এবার জামদানী শাড়ি লে আসব।

দুর্গা ।।   অত খরচা করবেক লাই- বেটাবেটি হবে, খরচ আছে না, সাদামাটা তাঁতের শাড়িই ভাল, মা'র জন্যেও এনো বটে।

সুদাম ।।  সি তো পেরতি বারই আনি, মা ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না রে দুগগা। আমরা ছাড়া মায়ের কে আছে - তুই মাকে দিখিস বটে - 

দুর্গা ।।   মাই আমাকে বুক দিয়ে আগলে রাখবে গো- ইমন মা পাওয়া ভাগ্যের কুথা গো; ও হ্যাঁ শুনো, একটা রূপোর হার এনো কেনে- বেটাবেটি যাই হোক না কেনে, তার লিগ্যে –

সুদাম ।।  বেটিই হোক, ঠিক তুর মত সোন্দর-

দুর্গা ।।   ধ্যাৎ, খুব হইছে, লাও লাও – ঐ যে মা ডাকতেছে –

[দুর্গা ও সুদাম বাগান থেকে এসে ঘরে প্রবেশ করে। বিজয়া পোঁটলাপুটলি বাঁধছে]  

বিজয়া ।।  নে নে সব গুছিয়ে রেখেছি পোঁটলায়, বৌ ভাত বেড়ে দে সুদামকে, দেরি হয়ে যাবে বটে।

দুর্গা ।।    দিচ্ছি মা – তুমি বস কিনে।

সুদাম ।।   মা তোমার মোচার ঘণ্ট রান্নাটা সত্যই অমিত্ত। ক’দিন কলকাতায় আইজে বাইজে খাবার খেইয়ে কাটাইতে হবে বটে। তোমার মুড়ি লাড়ু খুব কাজে লাইগবে গো। তোমরা খুব সাবধানে থেকো, দিনকাল বড় খাইরাপ পইড়েছে বটে।

বিজয়া ।।  বৌটা পোয়াতি তাই চিন্তা বটে। তু একদম দেরি করবিক লাই।

সুদাম ।।   না মা, একাদশীর দিন বৈকালে কেইনাকাটা সেইরে দোয়াদশী বা তেয়োদশী লাগাদ   ফিরবো বটে, তুমি চিন্তা করো লাই।

দুর্গা ।।    লাও পান লাও। সাবধানে যেও – কলকাত্তায় মিলা গাড়ি ঘোড়া বটে।

সুদাম ।।   চিন্তা করিস না দুগগা – তু সাবধানে থাকিস। মা গো আসি – আসিরে দুগগা।

বিজয়া ।।  দুগগা – দুগগা – মাগো  মা –বিটাটাকে রক্ষা করো--


দ্বিতীয় দৃশ্য


সুদাম ।।   কই গো মা? ইদিকে এসো কেনে, দেখ কত কি আইনছি। দুদিন দেরি হইয়ে গেলন বটে। তোমার শাড়ি লাও। দুটো বিছানার চাদর, এই দেখ ফুলকাটা বালিশের ঝাড়ন  -কি হল মা, কাঁদতে লাইগলে কেনে? শরীর খারাপ? দুগগা কুতায়? দুগগা দুগগা –

 কুথাকে গেলিন, এসে দেখ কেনে তুর লেইগ্যে কি সোন্দর শাড়ি, দুল, বেটাবেটির লেইগ্যে রূপোর হার, দুগগা – মা গো কি হল তুমি কাঁইদছ কেন বটে? দুগগা– দুগগা -  

বিজয়া ।।  ওরে সুদাম রে, দুগগা লাই রে [কান্না]

সুদাম ।।   কি বুললে বটে? না, না, এ হতে পারেক লাই- না- না- দুগগা- দুগগা- রে-

বিজয়া ।।  ওরে দুগগা আর ফিরবেক লাই, দশমীর দিন দুগগা বিসর্জন হইয়ে গিয়েঞ্ছে।

সুদাম ।।   কি ভাইবে আমার দুগগাকে তুমি বিসর্জন দিলে গো মা, আমি যে তুমার কাছকে রেইখে গিয়েঞ্ছিলাম।

বিজয়া ।।  ওরে তুর দুগগাকে আমি রাইখতে লারলাম রে (কান্না), দশমীর দিন সিন্দুর খেইলে এল বটে ঘরকে-

সুদাম ।।   তারপর, তারপর কি হল বটে গো মা- পুকুরে ডুব্বে- কিন্তু দুগগা তো মেলা সাঁইতর জানতো বটে।

বিজয়া ।।  না রে সুদাম, দুগগা আমায় জোর করে পাঠালো বারোয়ারি তলায় মা দুগগাকে পেন্নাম করে আসার লেইগ্যে-

সুদাম ।।   তুমি গেলে কেনে গো মা-

বিজয়া ।।  আমি যিতে চাইনি বটে; দুগগা বল্লে ঘরে খিল দিয়ে থাকবে, কিচ্ছু হবেক লাই।

সুদাম ।।   তাহলে ও কি আমাকে ছেড়ে চইলে গেছে বটে?

বিজয়া ।।  না রে, দুগগা মা আমার সতিলক্ষ্মী, সোওয়ামী-অন্ত পেরান। তুর কথাই ও কেবল বলত। মা-বেটিতে তো তুর গল্প করেই দিন কাটাইতাম। তু ভাইবতে পারলি বটে-হ্যাঁ

সুদাম ।।   তাহুলে বলছো না কেন বটে দুগগার কি হল? বল কিনে মাগো, আমি সহ্য কইরেতে পারবক, পাইষাণে বুক বেঁন্দেছি- তুমি বল কেনে-

বিজয়া ।।  মাকে পেরনাম করে এসে দেখি- লম্পটের দল দুগগার ইজ্জত লুটে মেইরে ফেইলে রিখ্যে গিয়েঞ্ছে রে- (কান্না)

সুদাম ।।   কি কি বুললে মা, আমার দুগগাকে যারা ইভাবে মেইরেছে, আমি তাদের শোধ লিব-

বিজয়া ।।  কি করিস কি সুদাম- দা হাতে কুথাকে চললি? বস- শান্ত হ কেনে- আমি বা তু কাউকে তো চিনিক লাই।

সুদাম ।।   আমি যে(২বার) শান্ত হুতে পারছিক লাই মা গো- –(কান্না)-তুমি থানায় যাও লাই? 

বিজয়া ।।  গিয়েঞ্ছি বটে- বড়বাবুরে গিয়ে সব বলেঞ্ছি- ওরা কত খুঁজছে- কিন্তু লম্পটগুলোর হদিশ কইরতে পারছে না- তবে বড়বাবু চেষ্টা চাইলে যাইঞ্ছে বটে-

সুদাম ।।   কিন্তু আমার কি হবে- আমি তো আর আমার দুগগাকে ফিরত পাবক লাই- আমার সব হারিয়ে গেল গো মা- আমার আর বেঁচে থেকে কি হবে- [কান্না]

বিজয়া ।।  তুই কি পাগল হইয়ে গেলি? আমার কথা একবারটি ভাববিক লাই। শোন কেনে-আমাদের দুগগা বিসর্জন হইঞ্ছে, কিন্তু হাজার দুগগা এখনও রইঞ্ছে গেরামের ঘরে ঘরে-

সুদাম ।।  কিন্তু মা, আমার দুগগা –

বিজয়া ।। সেই লেগ্যেই তো বুলছি – আর একটিও দুগগা যাতে লা বিসর্জন হয় তারই ব্যবস্থা করতে হবে-

সুদাম ।।  কি করে মা, তুমি-আমি-আমরা একা কি করে উদের রইক্ষ্যা করব বটে?

বিজয়া ।। মাইয়াদের ইস্কুলে যে ম্যাডামটা ক্যারাটে শিখাইতে আসে, উনার বাড়ি আমি গিয়েঞ্ছিলাম বটে- উনার এখন ফুরসৎ আঞ্ছে- পুজোর ছুটি বুলে- উনি রোজ এইস্যে গেরামের মাইয়াগুলানকে লিয়ে ক্যারাটে শিকখ্যে যাইচ্ছেন বটে। কোন লম্পট আর কোন একটা ম্যাইয়ারও ইজ্জত লুটতে লারবে।

সুদাম ।।  তুমি এত মনের জোর কুথাকে পেলে মা গো? তুমি মা জগদ্ধাত্রী বটে। তুমি এক দুগগা হারিয়ে শত দুগগাকে রইক্ষ্যা করার কুথা ভাবলে?তবে মা আমিও একটা কুথা ভাবছি-

বিজয়া ।।  চল এখন হাত মুখ ধুয়ে নে, খাবি চল- সব শুনবো –


তৃতীয় দৃশ্য


বিজয়া ।। কি রে কিছুই তো খাচ্ছিস না-

সুদাম ।।  মাগো এই অন্ন ছুঁয়ে পিতিজ্ঞা করছি গেরামের সব মেয়ে মরদরা মিলে দুগগার প্রতি এই অত্যাচারের জন্যি থানার বড়বাবুকে গে আবার বলব – অত্যাচারীদের খুঁজে বের করতেই হবে মা। না হইলে আমার খেইয়ে, শুয়ে শান্তি হবেক লাই গো মা – 

বিজয়া ।।  হ্যাঁ, দুটো সার্টের বোতাম, লম্পটদের মাথার চুল এসব ঘর থেকে পাওয়া গিয়েঞ্ছে।

 হাসপাতালের ডাক্তারবাবু সার্টিফিকেটও দিয়েঞ্ছেন,আতিপাতি করে খুঁইজলে লম্পটগুলাকে ঠিকই খুঁইজে পাবে রে, তা, হ্যাঁ তু কি যেন বুলছিলিস–

সুদাম ।।   ও হ্যাঁ গো মা, কুলকাত্তায় দিখলাম মেয়ে ঢাকীর দল বটে, কি সোন্দর একরকম ডিরেস পিনে ঢাক বাজাইছে গো মা, আর উদের দিখার জন্যে কি ভিড় বটে গো মা-

বিজয়া ।।  তা মেয়ে মানুষ ভাল ঢাক বাজাইতে পাইরছে?

সুদাম ।।   পাইরছে গো মা – বেশ বাজাইছে, তাই তো আমি ভাবতেছি গেরামের মেয়েগুলানকে

 লিয়ে একটা ঢাকীর দল গড়ি কেনে?

বিজয়া ।।  কর কেনে – খুব ভাল হবে বটে।

সুদাম ।।  খুব চাহিদা গো মেয়ে ঢাকীর মা, ডবল টাইকা দিয়ে ওদের সব বাইনা কইরে লিয়ে এসেছিল।

বিজয়া ।। হ্যাঁ, উদেরও রুজগারের একটা পথ খুইলে যাবে বটে। তবে আমি গেরামের বউগুলানকে নিয়ে যে লোকগানের দল খুলেছিলাম, গরমেন্টো পৌষপার্বণের সময় সবলা মিলায় আমাদের পেগ্রাম দিবে বলেঞ্ছে। তবে আমি যাব কিনা ভাবছি, মন মেজাজ ভাল নাই –

সুদাম ।।  যাবেক লাই কিনে, গান গাইলে মা সব দুঃখ তুমি ভুলে থাইকতে পারবেক –

বিজয়া ।। গেরামের বউগুলানরও খুব উৎসাহ – ওদের কুথা ভেবে –

সুদাম ।।  তুমিও কত দরদ দিয়ে উদের শিখাও – আমিও ভেবেঞ্ছি তুমাদের জন্যেও পেরগ্রাম লিব।

বিজয়া ।। আর দুটি ভাত লে কেনে – কখন বেরিয়েছিস-

সুদাম ।।  দাও মা, কদ্দিন পরে তুমার হাতের রান্না খাচ্ছি- অমিত্ত- খেয়েই বেরিয়ে যাব- দুগগার খুনে ক’টাকে ধরতেই হবে।

বিজয়া ।। হ্যাঁ, চল আমিও যাব।


চতুর্থ দৃশ্য


রাধা ।।  মাসি গো, তুমাদের দুগগা দলের গান খুব নাম কইরেছে গো আজকের কাগুজে-  তুমাকে পেরাইজ দিয়েঞ্ছে?

বিজয়া ।। হ্যাঁ, সবই তো হল – কিন্তু আমার দুগগার অত্যাচারীরা ধরা পড়ল কই বটে?

রাধা ।।  হ্যাঁ গো তুমরা যখন মিলায় গিয়েঞ্ছিলে তখন থানা থেকে লোকজন এসেছিল –

বিজয়া ।। তাহলে চিস্টা চরিত্রি চইলঞ্ছে –

রাধা ।।  পশুগুলান ধরা পড়লে ফাঁসী চাই-ই চাই।

বিজয়া ।। ওরা তো পশুরও অধম – পশুরা কখনও ধর্ষণ করেক লাই – 

রাধা ।।  ঠিকই তো বুলেঞ্ছ মাসি – 

[সুদামের প্রবেশ] 

সুদাম ।।  মা, মা গো – দুগগার অত্যাচারীরা সব ধরা পইড়েছে বটে –

বিজয়া ।। বিচারে টাকা দিয়ে খালাস পেয়ে যাবেক, দেখিস বটে –

রাধা ।।  তা হবেক লাই- আমরা সবাই মিলে থানা ঘেরাও করবেক – ফাঁসি চাইই – চাই-

সুদাম ।।  সব গেরামের লোক যেভাবে এগিয়ে এইসেছে – তাতে ওদের খাইলাস পাবার আর উপায় লেই মা –

বিজয়া ।। কিন্তুক আর একটিও দুগগা আর বিসর্জন লয় – তু মেয়ে ঢাকীর দল গড়েছিস, আমি গানের দল গড়েছি, ক্যারাটেতে রীতিমত মেয়েগুলান পারদর্শী হইয়ে উঠেঞ্ছে-

রাধা ।।  মাসি – আমরা নিজেদের রইক্ষা করতে নিজেরাই শিখে লিয়েছি আর একটাও দুগগা বিসর্জন হবেক লাই।   

সমাপ্ত



Comments