গল্প - মঞ্জুশ্রী ভাদুড়ী


ঐশ্বর্য

 

চুপ করে অন্যদিকে চাইতে চেষ্টা করে দোলন। সামনে সুন্দর সুন্দর সব ছেলেমেয়ে, সবাই ঝকঝকে, তকতকে। তবে সকলকে ছাপিয়ে ওই লম্বামতো ছেলেটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে বারবার, এভাবে তাকানোটা একেবারেই অনুচিত কাজতবুও  আটকাতে পারছে না চোখ দুটোকে!
 
 
এটা জয়িতাদের বাড়ি। জয়িতা আর দোলন একই বিষয় নিয়ে পড়ে সুনীতি দেবী কলেজে, ---ভূগোল। জয়িতা মাকে অনেক বলে-কয়ে পুজোর 'টা দিনের জন্য ওকে  এখানে নিয়ে এসেছে, ওদের পারিবারিক দুর্গাপুজোটা যেখানে হয়, সেই কুসুমপুরের বাড়িতে। খুব সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ এখানে। বাড়িটা পুরোনো বটে, কিন্তু প্রাচীনকালের লাল ইঁটের মস্ত বাড়ি, বিরাট বিরাট দরজা জানলাসহ প্রকাণ্ড সব ঘর! এখানে না এলে দোলন বুঝতেই পারতো না, মানুষের কতো ঐশ্বর্য থাকতে পারে! সকালে বিকেলে পাত পড়ছে শত শত লোকের। যতো খাওয়া হচ্ছে, নষ্ট তার চেয়ে কম হচ্ছে না। দোলনের মা একটি ভাতের দানাও নষ্ট করে না। রোজ রাত্তিরে বাবা হিসেব করে দৈনিকের খরচের, দোলন জানে কেন! বাঁধা টাকা, আজকে একটু বেশি খরচ হয়ে থাকলে কাল সেটাকে কমিয়ে দিতে হয়। তাও অষ্টমীতে পরার জন্য মা একটা ভালো নতুন শাড়ি কিনে দিয়েছে ওকে, এখানে আসবে যে, তাই!
 
 
সপ্তমীর দিন সেটাই পরলো ও। বিশাল উঠোনের একদিকে একটা ছোটো মঞ্চ তৈরি করে মাইক রাখা হয়েছে, হারমোনিয়াম-তবলাও আছে। সন্ধে-আরতির পর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলবে রোজ! সেখানেই সমবেত নাচ-গান চলছে, মজাই লাগছে দেখতে!
 
অষ্টমীর দিন দোলন আবার সেই শাড়িটাই পরলো। জয়িতা বারবার বলছে,
 
-শাড়ি পালটে নে, আজ সবাই মিলে ছবি তোলা হবে। অষ্টমীর নতুন শাড়ি পর।
 
হাসি পাচ্ছে দোলনের। ওদের কি অতগুলো শাড়ি কেনার উপায় আছে না কি! বোঝে না মেয়েটা। বাড়িশুদ্ধ সক্কলে সেজেগুজে রেডি। কাছাকাছি থাকা আরও আত্মীয়কুটুমরা উপস্থিত হল নানান পোশাকে গয়নায় সেজে। বেশ গণ্যমান্য ব্যক্তি মনে হচ্ছে, সবাই ছুটে গেল ওদের দিকেওই লম্বু ছেলেটাও! এতক্ষণে জেনে গেছে ওর নাম সুকোমল, জয়ির পিসতুতো দাদা, সদ্য ডাক্তারি পাশ করেছে, পড়াশুনোয় তুখোড় ছেলে! আরও অবাক করা কথা, ওর বাবা হলেন সুশোভন সেন, যাঁর গান শুনলে দোলন সব ভুলে যায়। এদের সকলের সৌন্দর্যে-গরিমায়-বৈভবে মুগ্ধতা আসে দোলনের, পাশাপাশি বুকের ভেতর খচখচ করে একটা দুঃখের কাঁটা, এর থেকে সামান্য কিছু তো বিধাতা তার ভালোমানুষ বাবা-মাকেও দিতে পারতেন! বাবার ছেঁড়া গেঞ্জি পরা পিঠটা মনে পড়লো, তৎক্ষণাৎ আবার মনে পড়ে গেল বাবার মুখের অনাবিল হাসিটা, কোনও দুঃখই যাকে ছুঁতে পারে না! একা একাই হেসে ফেললো ও। হঠাৎ চমক ভাঙলো জয়িতার কথায়,---
 
-এখনও তুই একইভাবে বসে আছিস দোলনচাঁপা! আমার হবু শ্বশুর-শাশুড়ি এসেছে, ওই যে, তোকে দেখাবো বলে ডাকতে এলাম। সেজে নে না একটু, নতুন একটা শাড়ি পর----এটা লাট হয়ে গেছে।
 
-আমার এই একটাই পুজোর শাড়ি জয়ি, তুই জানিস না আমরা গরিব খুব
 
-যাঃ! তাই বলে একটাই শাড়ি এনেছিস--, আমাকে বলতে পারতিস তো---
 
-তুই বুঝবি না এসব, বোঝার সাধ্য নেই তোর---
 
 
একটু শক্ত হয়ে গেল কথাগুলো! কেমন আমতা আমতা করে জয়িতা চলে যায়। দামী শাড়ি-গয়নাবিহীন বন্ধুকে দেখাতে লজ্জা পেল বোধহয়! মৃদু হাসে দোলন, মনে মনে বলে,
 
-বাইরের সজ্জাটাই সব নয় রে জয়ি, অন্তরের ঐশ্বর্যও কিছু কম থাকে না মানুষের। তা না থাকলে তো কবেই দুঃখে-লজ্জায়-হীনতায় মরে যেতাম, তোদের উঠোনে দাঁড়াবার সাহস হত না আমার।
 
-কোথায় জয়িতা, তোমার বন্ধুকে ডাকলে না তো!
 
-না, যে কোনদিকে গেল
-সুকোমল, গান গাও না একখানা, বাবা এতো ভালো গায়
 
-কেউ গান গাও না একটা, মঞ্চটা ফাঁকা যাচ্ছে যে----রাহাবাবু বলছেন বারবার
 
রাহাবাবু জয়িতার হবু শ্বশুর বুঝতে পারলো দোলন। গান ভালোবাসেন শুনে আবার বাবার কথা মনে পড়লো।
 
একটু ইতস্তত করে দোলনচাঁপা উঠে দাঁড়ায়, মৃদু পদবিক্ষেপে মঞ্চে উঠে হারমোনিয়াম টেনে নেয়। তার ডানদিকে সকলে বসে, বামদিকে জগৎজননী দুর্গা। চোখ বন্ধ করে সে সুর ধরে। সুরের সুমধুর অভিঘাতে স্তব্ধ হয়ে যায় সমস্ত কোলাহল, সব কথা থেমে যায়। কি সুন্দর দেখাচ্ছে, সালঙ্কারা সুবিশাল দেবীমূর্তির বুকের কাছে দেবীর আলোকে আলোকিতা নিরাভরণা আর এক ক্ষুদ্র দেবীমূর্তি যেন! অপূর্ব সুন্দর সেই ভাববিভোর মুখমণ্ডলের দিকে বিস্মিত, উৎসুক মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকে শত জোড়া চোখের সাথে আরও দুটি চোখ, সেই চোখ কান দুটি চিরকালের জন্য মনের মধ্যে গেঁথে নেয় এই অনুপম দৃশ্য সুর। সকলের অগোচরে বাঁধা পড়ে দুটি হৃদয়! দেবীর মঙ্গলহস্ত থেকে আশীর্বাদ ঝরে পড়ে।

 



Comments

  1. পড়লাম l ভালো লাগছিলো l একটু তাড়াতাড়ি শেষ হলো l

    ReplyDelete

Post a Comment