অনুগল্প - অর্পিতা রায় চৌধুরী


দুগ্গা দুগ্গা 

 

 

পৃথিবী জুড়ে মরণ রোগে জর্জরিত মর্তবাসী। গত বছরের আগের বছর ২০২০ সালে বিষয় টার সম্বন্ধে কৈলাশ অবধি বিশেষ তথ্য না পৌঁছনোয়, স্বপরিবারে মা দুগ্গা এসেছিলেন বাপের বাড়ি অক্টোবর মাসে। এসে তো চক্ষু চরোগ্গাছ। ভক্ত দের ঘরে ঘরে রোগের থাবায় চিতা জ্বলতে দেখে গৃহবন্দী অবস্থাতেই বাপের বাড়ির ছুটি কাটাবেন ঠিক করেন। ছেলে মেয়েদেরও পই পই করে বারণ করে দেন বাড়ির বাইরে এক পাও যেন না ফেলে। কিন্তু তাই বললে কি আর চলে? বাপের বাড়ি আসা হয় তার হাতে গুনে শুধু একবার। লক্ষ্য লক্ষ্য ভক্ত সারা বছর অপেক্ষা করে বসে থাকে বছরের এই কটা দিনের জন্যে। শেষে ভক্তদের দল এক রকম চ্যাঁঙদোলা করে তাঁকে নিয়ে যায় মণ্ডপে মণ্ডপে। চার ছেলে মেয়ে আর বাহন সহ মা অবশেষে মাস্ক আর স্যানিটাইজার বিহীন দাঁড়িয়ে থাকেন মণ্ডপে। মনে মনে প্রমাদ গোণেন যেন এই যাত্রায় ভালোয় ভালোয় স্বামীর কাছে স্বপরিবারে ফিরতে পারেন !
 
 
এগারোই মার্চ ২০২১ সালে ভক্ত দের নিয়ে তাঁর বিখ্যাত তাণ্ডবনৃত্য করতে মর্তে এসেছিলেন মহাদেব। স্ত্রী দুগ্গা সপ্তাহ খানেক অনশন - ধর্মঘট করেছিলেন প্রতিবাদে। স্বামীটি কে তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন। সিদ্ধি খেলে তাঁর কোনো হুশ থাকে না। চার দিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই আর খেয়াল থাকে না তাঁর। এই নিয়ে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে প্রতিনিয়ত মনোমালিন্য লেগেই থাকে। শান্ত স্বভাবের দুই কন্যা লক্ষ্মী স্বরস্বতী কোনো রকমে সেই ঝগড়া থামায়। মাতৃ ভক্ত গনেশ মায়ের আঁচলের তলায় লুকিয়ে থাকে বাপের মেজাজের ভয়ে। এই দৃশ্য মহাদেবের পরিবারে নতুন নয়। পাড়ার ছেলেরা কার্তিক কে এই নিয়ে ঠাট্টা করে বলে --- "কি রে কার্তিক? গতকাল বাসন ফেলার আওয়াজ  পেলাম না? সবাই সুস্থ তো বাড়িতে?"
 
 
স্ত্রীর কাছে মর্তে আসবেন না বলে কথা দিলেও একদিন মাঝ রাত্তিরে লুকিয়ে মর্তে চলে আসেন মহাদেব। ভক্ত দের সাথে তান্ডবনৃত্য করবেন না তা কি করে হয়? ভক্ত রা চোটে গেলে ব্যবসা লাটে উঠবে যে! তারপর স্ত্রী আর সন্তান দের  কে খাওয়াবেন পরাবেন কি? দুগ্গা অবুঝের মতো কথা বললেই চলবে নাকি? ছেলেদের পড়াশুনো আছে মেয়ের বিয়ের খরচা আছে! এমনিতেই এই হতভাগা মরণ রোগের জন্যে রোজগার অনেক কমে গেছে। তেমন ফল মূল পড়ে না থালায়। এইভাবে চললে বেশিদিন আর টিকে থাকা যাবেনা। তাই বুকে পাথর বেঁধে মর্তের উদ্দেশ্যে রওনা দেন মহাদেব। 
 
 
সকালে ঘুম ভাঙলে স্বামী কে দেখতে না পেয়ে দুগ্গা বুঝতে পারে কি ঘটেছে। পণ নেয় স্বামী বাড়ি ফেরা অবধি জল অবধি স্পর্শ করবেন না। অনেক চেষ্টা করেও ছেলে মেয়েরা মায়ের মুখে খাবার তুলতে পারেনা। ছোট্ট গনেশ মায়ের কোলে বসে কাঁদে। কিন্তু মা তবুও পণ ভাঙেন না। এদিকে মর্তে এসে ভক্তদের অবস্থা দেখে রীতিমতো অবাক হন মহাদেব। ঘরে ঘরে মৃত্যু। ঘরে ঘরে শুধু অভাব। হাসপাতালে গিয়ে দেখেন সেখানে উপচে পড়ছে রুগী। বিনা চিকিৎসায় হচ্ছে মৃত্যু। যাচ্ছেতাই অবস্থা চারদিকে। মহাদেব কে দেখেও তেমন কোনো হেলদোল নেই ভক্তদের মধ্যে। যা জুটছে তা হলো অজস্র প্রণাম আর সব ঠিক করে দেয়ার অনুরোধ।পয়সা করি ফল ইত্যাদি কিছু দেয়ার মতো আর অবস্থা নেই ভক্তদের কারুর। অল্প বিস্তর যা জুটেছে তা কৈলাশ ফিরতেই খরচ হয়ে যাবে। এসব দেখে আর সহ্য করতে না পেরে একটি শ্মশানে গিয়ে হাজির হন মহাদেব। দেখেন চিতা জ্বলছে। একটি বট গাছের তলায় গিয়ে বসে গাঞ্জা দিয়ে বানানো একটা সিগারেটে ধরান। নেশার ঘোরে সারারাত সেই গাছের তলায় পড়ে থাকেন মহাদেব। পরের দিন শ্মশানের কিছু সাধু এসে তাঁকে চিনতে পেরে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে। মহাদেবের শরীর তখন আগুনে পুড়ছে।  হাসপাতালে বেড অবধি জোটে না তাঁর। মেঝেতে পরে থাকে দুদিন অবহেলায়। অবশেষে মৃত্যু ঘটে মহাদেবের।
 
 
 কৈলাশে মহাদেবের মৃত্যুর খবর পৌঁছোয় দিন কয়েক বাদে। স্ত্রী দুগ্গা কে খবরটা সাহস করে বুদ্ধিমতী কন্যা স্বরসতী দেয়। লক্ষ্মী স্বামী নারায়ণের সাথে বাপের বাড়ি এসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ভাইদের সামলাতে। তবে কান্নায় ভেঙে পড়লেও দুগ্গা জানেন এখন ছেলে মেয়ের দায়িত্ব কেবল তাঁর। স্বামীর মৃত্যু শোকে বয়ে গেলে চলবে না। শক্ত থাকতে হবে ছেলে মেয়েদের মুখের দিকে চেয়ে। স্বামীর কাল অশুচ না মিটলে পুজোয় বসা যাবেনা। যা জমানো রয়েছে তাই দিয়ে চলতে হবে একটা বছর। মহাদেবের মিষ্টি ব্যবহারের জন্যে তাঁদের সকলে খুব ভালোবাসতো। তাই বাপের বাড়ি আর পাড়ার প্রতিবেশী দের বাড়ি থেকে সারা বছর টুকটাক সাহায্য যা আসে তাই দিয়েই কেটে যায় একটা কঠিন বছর। অসীম ধৈর্যের সাথে দুগ্গা কেবল অপেক্ষা করেন আগামী দূর্গোৎসবের।
 
 
২০২২ সাল। পঞ্জিকা দেখেন দুগ্গা। অক্টোবর মাসে প্রথম সপ্তাহে সপ্তমী পড়েছে। এখন সেপ্টেম্বর। মর্তে চিঠি পাঠান বাড়িতে। মর্তের খবর নিতে আর কবে বাপের বাড়ি যাবেন সেটা জানতে। সপ্তাহ খানেক বাদে চিঠির উত্তর আসে। 
 
 
"মা দুগ্গা,
 
আশাকরি সন্তানদের নিয়ে তুমি কুশল আছো। আমরা সকলে গত দুটো বছরের তুলনায় অনেকটা ভালো আছি। মর্তে সুখ শান্তি ফিরছে ধীরে ধীরে। মরণ রোগের হাত থেকে আশা করা যায় এই বেলা মুক্তি পেয়েছি সকলে। আর যে সত্যি নেয়া যাচ্ছিলো না।  যাইহোক চিঠি তে তুমি জানতে চেয়েছো কবে আসবে। তা মা নিজের মুখে তোমায় এই কথা যে কোনোদিন বলতে হবে তা যে কোনোদিন ভাবিনি। এখানে পুরোহিত মশাই রা বলছেন তোমার মর্তে না আসাই ভালো। ওনাদের মতে শাস্ত্রে আছে যে বিধবাদের নাকি পুজো হয়না। তাতে নাকি সকলের অমঙ্গল হয়। আমরা অপারক মা। পারলে ক্ষমা করে দিও। ভালো থেকো।সুস্থ থেকো। 
 
ইতি ---
বাবা।
"

 

 



Comments