অণুগল্প - শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত (নিয়োগী)


প্রতিমা

 

ভোর ভোর উঠে পড়তে হবে কাল। ঘুম তো হবেই না,শুধু রাত শেষের অপেক্ষা।  রাতটুকু এপাশ ওপাশ করেই কাটল প্রায়। সময়মতো উঠে ঘরের টুকিটাকি কাজ সেরেই শাওয়ারের নীচে দাঁড়াল ধৃতি। চায়ের কাপ হাতে উজান রোজকার মতো আজও বাগানে, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই বেডরুমে এসে আদর করে জাগিয়ে তুলেছে মিষ্টিকে  "ওয়েক আপ মামান, সাজুগুজু করে আমরা তো পূজো করতে যাব। সব্বাই তোমাকে আদর করবে, দেখি তো মাম্মা তোমার জন্য কোন ড্রেসটা রেডি করে রেখেছে।সাজের কথাতেই মিষ্টির চোখের ঘুম উধাও, টলমল পায়ে পাপার হাত ধরে ওয়াশরুমে যেতে যেতেই মাম্মার দিকে চোখ গেল...."গুড মর্নিং   মাম্মা".....

 

"গুড মর্নিং সোনা, আমার মিষ্টি সোনা"

 

সাড়ে সাতটা বাজে, ব্যস সব কম্পলিট করে বেড়িয়ে পড়ল ওরা, বোল্টন থেকে ম্যাঞ্চেস্টার যেতে প্রায় আধ ঘন্টা লেগে যায়। ওখানে মিঃমুখার্জীর বাড়ির দুর্গা পূজোটা ১০/১২ টা ফ্যামিলির কাছে নিজের ঘরের পূজো হয়ে গেছে। বেশ কয়েক বছর আগে সমীর মুখার্জী নিজেই বাড়িতে পূজোটা শুরু করেছিলেন। তারপর ম্যাঞ্চেস্টার, বোল্টন, ওল্ডহ্যামের  ১০/১২ টা ফ্যামিলি যখন "বাঙালীয়ানা" এসোসিয়েশন  তৈরী করল তখন থেকেই তারা একসাথে মুখার্জীবাড়িতেই দুর্গাপূজোটা করে। 

 

ঠাকুর মশাই চলে এলেই তাড়া দেবেন, যা পাংচুয়াল---অবশ্য বাকি সবাই তাই। আসলে জায়গার অভ্যেস। তবে উজানের  কিন্তু এটা এসেছে সেই রামকৃষ্ণ মিশনে পড়াকালীনই।ঠাকুরমশাইয়ের সাথে হাতে হাতে ওদের এই "বাঙালীয়ানা"   সব মেয়ে-বৌ সুন্দর করে পূজার আয়োজন করে হৈ হৈ করে। 

 

ধৃতির ভাবনায় এল ওদের প্রথম U.K তে আসার কথা, সাত মাসের মিষ্টিকে নিয়ে ওরা এসেছিল, এখন তো মহারানীর তিন বছর হয়ে গেল। পাকা পাকা কথা সারাদিন আর সাজুগুজু। 

 

সমীর মুখার্জী উজানের পিসির দিকের রিলেটিভ, তাই এখানে ওনারাই বড় ভরসা। আর পূজোর আনন্দটাও সেখানেই। আজ অষ্টমীতে তাড়াহুড়োটা একটু বেশী।  এটুকুই তো পাওয়া, দেশ ছেড়ে এই বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিজেদের মতো করে, চারটে দিন ওরা দেশের মাটির গন্ধটা যেন প্রাণভরে  অনুভব করে।

 

ওরা পৌঁছানো মাত্রই মিঃমুখার্জি মিষ্টিকে কোলে নিয়ে ধৃতিকে পাঠিয়ে দিলেন পূজার কাজে হাত লাগানোর জন্য।  উজানকে একটু সরিয়ে.... "কি রে, ধৃতি যে এত তাড়াতাড়ি আসবে ভাবতে পারিনি, তুই আবার প্রেশার দিসনি তো?" বলেই মাধুরীকে ডেকে বললেন... "দেখো ধৃতিকে হাল্কা দায়িত্ব দাও। মেয়েটার এবার মনের অবস্থা তো  বুঝি।" মাধুরী শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের কোনের জল মুছে মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন। ওদিকে "কাম অন এভরিবডি"-- মিঠু চিৎকার করে সবাইকে ডাকছে অঞ্জলি দেওয়ার জন্য। সবাই এসে হাতে ফুল নিয়ে ঠাকুর মশাইয়ের সাথে মন্ত্র উচ্চারণ করছে, ছোট্ট মিষ্টিও পাপার কোলে বসে সবাইকে দেখে তেমনটাই করছে।   "এবার হাত জোড় করে সবাই বল " ---ঠাকুরমশাইয়ের সাথে মন্ত্র উচ্চারণ করতে করত  অঝোর ধারা ধৃতির দুচোখে বেয়ে।      

 

মা দুর্গার প্রতিমাতে, যেন ওর নিজের মায়ের মুখ দেখছে ধৃতি, মা যেন বলছে.... "কষ্ট পাচ্ছিস কেন রে মা? এই তো তোর কাছে এসেছি। আমি তো তোর সাথেই আছি রে সবসময়, চোখের জল মুছে ফেল রে মা। কি সুন্দর সেজেছিস, ঠিক আমি যেমনটি চাই।"

"শেষবারের মতো তোমার মুখটাও দেখতে দিলেনা মা! এতই তাড়া ছিল তোমার চলে যাবার? এত দূর থেকে আমি যে যেতেই পারলাম না গো, সারাটাজীবন এই কষ্টটাই আমি বয়ে বেড়াব। একটু সুযোগও দিলে নাকোভিড কত মানুষের সাথে তোমাকেও কেড়ে নিল। বাড়িতে গিয়ে কি বলে ডাকবগিয়েই কাকে আগে জড়িয়ে ধরব, বল তুমি? একলা ঘরে বাবা কত কষ্টেও  নিজেকে সামলে রেখেছে, তাও কি দেখনা মা? আজ পূজোর দিনে সবার মনে আনন্দ, কিন্তু আমার মা যে হারিয়ে গেছে।  

 

ডিসেম্বরে যখন বাড়ি গেলাম, এই লাল জামদানী টা আর তোমার নিজের  প্রিয় সেই লাল কুঁচি হাতা, সাদা ব্লাউজটা হাতে দিয়ে বলেছিলে, এটা পড়ে অঞ্জলি দিতে। প্রতি বছর  মহাষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়ার সময় নতুন শাড়ির সাথে, এই ব্লাউজটা বাদে অন্য কোনো ব্লাউজ তুমি পড়নি।

 

তবে এবার কি জানতে, তুমি আর কোনোদিনও এটা আর পড়বে না!! আমি তোমার কথা শুনেছি মা, শুধু তুমি অপেক্ষা করলে না।"

 

সবাই বাক্যহারা, মুখার্জি ধৃতির মাথায় ধীরে হাতটা রেখে বললেন, তোর মনের ব্যথাটাকে হাল্কা কর রে মা, দুর্তিনাশিনীই মা' তো তোর দুঃখ-জ্বালা  ঘুচাবেন।" --- অন্যদের বললেন, "ওকে হাল্কা হতে দাও, মাটির মা'তে নিজের হারানো মা কে পেয়ে কিছুক্ষণ ভুলে থাকুক ও। মা-মেয়ের কথা হোক প্রাণ ভরে। আমার ঘরের  অষ্টমী পূজো আজ হারানো মা আর  তার মেয়ের আবেগে পূর্ণ হয়ে উঠুক।"

 


Comments