শূন্য পুরাণ
মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল বিপিন। বিপিন রাম। পা এর দিকে তাকিয়ে ছিল সে প্রতিমার। মাটির প্রতিমার ছায়া পড়েছে মাটিতে। ভোরের আলো আসছে একটু একটু। সেই আলো আকাশকে জড়িযে আছে যেন। আলো ছুঁয়েছে মন্দিরের চূড়া। আর অন্ধকার গর্ভগৃহ.... যেন সেখানে চাপা পড়ে আছে কতো গোপন কথা..। ভোরের আলো সেখানে পৌঁছতে পারছে না। বাইরে দেউরির উঁচু মাথায় পত্পত্ করে ওড়ে উজ্জ্বল নিশান। নিশান দেখতে বড্ড মাথা উঁচু করতে হয়। অত মাথা তুলতে পারে না বিপিন। ঘাড় গুঁজে চলা তার অভ্যেস হয়ে গেছে। অভ্যেস মতো হাতটা নির্বিকারভাবে মাথায় গিয়ে ঠেকে। চৌকাঠের থেকেও দূরে দাঁড়িয়ে দেবী দর্শন করে বিপিন। তার পা এর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে "আহা পা, জিনিসটো কম নয় কো! সুধা দিদির পা খানি এমনপারা ছেল্"....। আলতা পরা ছেলো না মোট্টেও কিন্তুক এমন ছেলো.।..কেমন সে, নিজের কাছেই বলতে পারে না। স্বীকার করে
বিপিন থই নাই "... কেমন সে সনুমদুরের মতো। সমুনদুরের ঢেউ এর মতোই সে এসেছিল। ভাঁটির টানের চলিয়ে গেলো..."।
বিপিনের খুব অস্থির লাগে। সরে আসতে গিয়ে প্রায় ধাক্কা লেগে যাচ্ছিল দরবারি ঠাকুরের সঙ্গে..। দরবারি ঠাকুর ফল ফলারি সাজিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, বিপিনকে দেখে কেমন থমকে গিয়ে সরে গেল...। অন্য দিন হলে বিপিন একটু মস্করা করতো.. এই সব ছোঁয়া ছানা নিয়ে। আজ, এই ভোরবেলায় সে সব আর ইচ্ছে করলো না.. সে সরে গেল।
প্যাণ্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে বুক পকেটে রাখল বিপিন। অন্য দিন পোষ্যের মতো তার গায়ে হাত বুলিয়ে একটু আদর করে যণ্তর টাকে... মন বলেএই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে.. .মান দিয়েছে ...অন্নও দিয়েছে। ..কিন্তুক আজ পরথম এই তিরিশ বচ্ছর বয়সে বিপিন সেটা করলোনা। তার মন দুব্বল হয়ে আছে। কুথাকে গেলো সুধা দিদি। ঘরকে গেলো নি...কে খবর দিবে?
প্রান্তিক
সীমান্তের এই শহর ঘেঁষা অঞ্চলে কত লোক করে কম্মে খায়। এই মন্দির ছুঁয়ে বেঁচে বর্তে আছে কতজনা। বিপিন সেসব কিছুই পারলনা। কত নোক তো ট্যাক্সি চালায়, অটো চালায়, দোকান চালায়,! যুগল ঠাকুরের মতো কতো লোকে ঘাটে বসে থাকে কতো নোক. কত্তো নোক.. তাদের সোমসারটো চলে অমনি করে... বিপিনের সেসব কিছুই নাই। তার শুধু আছে মুবাইল আর দ্বৈতপতি পাপার নির্দেশ। তাই, সে অপেক্ষা করে শুধু,কখন আসে নির্দেশ! বাইকটা রাস্তায় এনে দাঁড় করায় বিপিন... টুকটাক দোকানগুলো খুলতে শুরু করেছে... চুলাতে আগুন দিয়ে দোকানদার ভবদাদা ডাক দেয় তাকে.. "চা খাইলে বাহনটাক থুয়ে আসোহ..."
পুরানা দিনে ফিরতে চায় না বিপিন ,ভাবতে চায় না। তবুও, গেরামের থেকে খপর আসে... বোনের বিহার ট্যাকা দিতে হোবে... .বিপিনের বাপ নাকি উঁচু ঘরানার ছিল ...তবু, তাদেরকে ছেড়ে চলে যায় আর কুনোদিনও খপরটো করে নাই... সমাজও তাদের ঠাঁই দেয় নাই। বিপিনের মা এই শহরে আসিয়া মন্দিরের দেউরি পোস্কারের কাজ পায়। তারপর ফের বিযা করে সোমসার পাতে একজনার সঙ্গে..সেও এ মন্দিরের রাখোয়ালি করতো...। একদিন সেও মারা গেলো।বিপিনদের ঘর হল কিন্তুক জাত গেলো। বিপিন খাতায় কলমে হোল বিপিন রাম। এইজন্যই বিপিনের খুব রাগ ছিল। ইখন নাই। মন্দির পর্যন্ত যে যেতে পারে সে তা শুধুই দ্বৈতপতি পাপার দয়ায়। নাহলে একোদিন চোরা চাল বিক্কিরি থেকে খাদানে নেমে সোনা তোলা কী না করেছে বিপিন! তার কুনো বাচ্চাবেলা নাই।সব সময়ই সে বড়ো...সব সময়েই তার দায় দায়িত্ব শুধু.. বিপিন টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব সারে..। দশবছর বয়স থেকেই সে দায়িত্ব করছে... পুরানা দিন তার কাছে বড়ো দুঃসার।
বরং যেদিন সে টেরেনে উঠে পালাচ্ছিল পকেটমারি করে ...চোদ্দ বছর বয়স তখন তার ..তখন তাকে বাাঁচালেন পাপা, বল্লেন কাম করিবি? বিপিন চিনতো তাকে। তাই ঘাড় কাত্ করে সে। তারপর সে কতো কাম করিলো.. সব পাপার জন্য। বিপিনের জীবনে তর্জনী তুলে জেগে আছে দ্বৈতপতির নির্দেশ...। ন্যায় অন্যায় কবে হারাযে গেলো...সেসব ও আর ভাবে না বিপিন।
নিজের ছায়া পেরিয়ে বড় দেউরিতে উঠে আসে ... মার কথা মনে পড়ে হঠাৎ করে।বিপিনের মা সাবিত্রী দেউরি পরাষ্কার করতো... বিপিন চৌকাঠ অবধি গেছে। এর পরে চৌকাঠ পার হবে তার সন্তানরা। বিপিন এইজন্মেই শুধে নিবে সব। আর একটু পার হলেই সে,, তারা দেবী মূর্তির কাছে যাবে। ছুঁয়ে ফেলতে পারবে মূর্তির শরীর...!! কিন্তু একটা জ্বর জ্বালার মতো অসোযাস্তি তার শরীরকে পুড়ায়। কুথাকে গেল সুধা দিদি??
সুধাকে আনে নি বিপিন। এনেছিল আর কেউ.. বিপিন নির্দেশমতো তাকে ইস্টেশন থেকে আনতে গিয়েছিল। দেখল সেখানে চেনা মেয়ে অচেনা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সুধা বাউরি তো তারই গেরামের মেয়ে, শুনেছিল.. তবে সে চেনে না তাকে.. দেখেও নাই কখনো। সে নাকি এসেছে ইঞ্জিনি না কি হয়ে...মন্দিরের কাজ করম দেখভাল্ করবে..মন্দির নাকি নতুন করে তৈয়ার হবে...। সুধাদিদি দাঁড়ায় ছিল গোপালের ঢক পায়ে পা রেখে বাাঁকা হয়ে ...। অনেক মেয়েকে অনেক বার পৌছে দিয়েছে পাপার কাছে। জেনেই করেছে....অনেকবার; ইচ্ছে না করলেও করেছে... কেননা পিছনে ফিরে দেখতে চায় নি বিপিন আর... সে সামনের দিকে যেতে চায় ..তাকে নিয়ে পাপাও লড়াই করেছে অনেক... তাকে সামনে রেখে ভোটে লড়াই করেছে.. ...বহূত লড়াই করে জিতে গেছে দ্বৈতপতি ...আর বিপিন পৌঁছে গেছে মন্দিরের দেউরি পেরিয়ে। আদায় করেছে চৌকাঠ অবধি যাওয়ার অধিকার। লড়াইটা পাপাই করেছেন আর বোড়ে সেজে মৌন বিপিন অর্ডারটো মেনে নিয়ে চলেছে ....
সুধা দিদি কী সুন্দর গান করে!! পাগলপারা গান। পশ্চিমের আকাশের মতো রঙ সুধাদিদির আর চুল! ...ঘন কালো চুল টঙে তুলে সুধাদিদি কথা বলল পরথম গাড়িতে চডে, বিপিন নামটো, রাইট...দ্বৈতপতি স্যর বলি দিছেন...ভেরি হ্যাণ্ডসাম...ভেরি ট্রু! ইউ আর সো হ্যাণ্ডসাম ..সো লেটস গো...গাড়ি চলতে চলতে গান আর কথা চলতে থাকে। পাপার ঘর থেকে তার থাকপার জাগায় পৌঁছায়ে দিয়ে বাহনে উঠে ফিরতি পথে বিপিন মনে মনে ভাবে এমতি কন্যা কখনো দেখে নাই সে।
সেই সুধাদিদি হট্ত্ করি গেলো কুথাকে...যদি তার আসার খপর থাকতো তোবে বিপিন কোবে তাকে বারণ করিত। দুশ্চিন্তা তেও একটু হাসি পেলো বিপিনের ...কি করিয়া দিতো খপর. সে কী সুধাদিদির নম্বর জানিতো! ...আর একখন দুইদিন ধরি বন্ধ বলে সুধাদিদির মুবাইল! রাগে শরীলটো কেমন পারা করে বিপিনের। কেনে আহিল? ইখন কেমতে ফিরিবে সে!!?
নদীর ধারে গিয়ে সব ঘাটে রেখে উন্মুক্ত বিপিন নদীতে ঝাঁপ দেয়... চিৎ সাঁতার দিতে দিতে যুগল ঠাকুরের কথা মনে পড়ে। ঘাটের ধারে তিলক কাটি পয়সা নেয় যুগল ঠাকুর; দশবার করি কথন গায়.. বিহা করও কতোবার বলিছে যুগল ঠাকুর। বিপিন হাসে। যুগলের কথনে কয়বার সে শুনেছে এক কবিয়ালের কথা... খোল বাজাইছে কবিয়াল, নাচিছে তার রমণী। ভুল হচ্ছে কবির শোলোকে, কে মিলায় দিতেছে ছন্দ....কুনো ঈশ্বর বা কন্যা কুনো.... বিপিন যেন চোখের সামনে নাচের ঘূর্নি দেখে...চোখ বুজে দেখে কোনো পদ্মাবতীর পা। কেমতে ফিরিবে..?! উপুড় সাঁতারে পাশ কাটাতে থাকে ছোট ছোট ঢেউ... বিপিন ভাবে যুগল বলেছিল সাধকের পারা জীবন হয় কবিয়ালের....তখন কুনো কষ্ট গায়ে নাগে না... বড় কঠিন সে সাধনা। বিপিনের সেই সাধনা নেই। শুধু সুর ভালো লাগে তার..তাই দিয়ে কী হবে?কেমতে পাবে তারে?
যুগল ঠাকুর বড় সুন্দর কথা বলে..তার ঘরটোও সোন্দর... তার অল্প অল্প সব...শুধু সুখের ভারা বেশি! বিপিনের তেমন ভাগ্য কই? তার জেবনে শুধু দ্বৈতপতির নির্দেশ তর্জনি তুলে আছে। নির্দেশ মানবে বিপিন কিন্তুক চৌকাঠের আগল পার হবে সে,হবেই। তারপর চলে যাবে অন্য কুথায়...না না কুথাকে যাবে আর...বিপিনের চিন্তা থই হারিয়ে জল তোলপাড় করে....
পারে আসতেই মুবাইল ঘড় ঘড় করে....খুব তাড়াহুড়ো করে নিজেকে ঠিক করে নেয় বিপিন। মুবাইল টো ছুঁড়ে দিবে মনে করেও নিজেকে সামাল দেয় বিপিন.... নিয়তির মতো ওপার থেকে নির্দেশ আসে থেমে থেমে... বিপিনও দম নেয়...তারপর নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলে ফেলে... সুধা দিদির খবরটো করিবার চাই! ফোন কেটে যায়। থেমে যায় নির্দেশ।
সাতদিন ধরে বিপিনের খোঁজ করে পায় না যুগল ঠাকুর বিপিনের সঙ্গীদের পুছ করলে তারা হাত উল্টায়। একদিন নদীতে ভেসে ওঠে গলিত শব....ডোমরা তাকে চড়াতে এনে সৎকারের আয়োজন করে...সেদিন খুব সকাল করে স্নান সেরে পুজোর জোগাড় করবে বলে ঘাটে গেছে যুগল...দ্যাখে এক খুবলে খাওয়া শরীর...অন্যদিন হলে সে সরে আসতো,আজ পারলো না। পা দুখানা খুব চেনা লাগে যুগলের।বুড়ো আঙুল, সাদা নখ..খুব চেনা লাগে।
পিতৃপক্ষের
শেষ তিথি.... ভোরবেলা.... নক্ষত্রপুঞ্জ জেগে আছে.... পুণ্যতিথিতে কিছু বেওয়ারিশ লাশ সৎকার হচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ঠেলে বেরিয়ে আসে যুগল ঠাকুরের। লোকজন পেরিয়ে ঠোক্কর খেতে খেতে সে চলে যায়। নেমে যায় নদীতে... তর্পন সারে। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করে মুক্তি দিও গো ঈশ্বর! এতোদিনে বুঝি পুর্নজনম হলো গো তার! শাপ মুক্ত জীবন ছেড়ে কার ঘরে পা রাখলো বিপিন....ডুকরে উঠে যুগল ঠাকুর প্রার্থনা করে...'শাপ মুক্ত করে নতুন জেবন দিও গো হে ঈশ্বর !!
Comments
Post a Comment