অনুবাদে অনুভবে (প্রবন্ধ) - সুস্মিতা কৌশিকী



এক রাত, সিলভিয়া প্লাথ:

 

                     

 

কবিতাগুলো দৃষ্টির অতলে গিয়ে হারিয়ে যায় না বরং মাথায় চেপে বসে 

'কোন কবিতা?' 'কার কবিতা?'

আচ্ছা শোনাচ্ছি তোমাকে  --- 

 

 

Mad girl's love song (ক্ষ্যাপাটে মেয়ের প্রেমগান)

 

আমি চোখ বুজে ফেলি আর পৃথিবীটা ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে

পলক তুলতেই ফিরে পায় সব প্রাণের স্পন্দন

মনে হয় তোমাকে গড়ে তুলেছি মননে।

 

 

লাল নীল আলো ছেড়ে তারারা ঢুকে পড়ে নাচ ঘরে 

কোথা থেকে খামখেয়ালী আঁধার ঘনায় তখন 

আমি চোখ বুজে ফেলি আর পৃথিবীটা ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।

 

 

স্বপ্ন দেখি তুমি ডেকে নাও মায়ামুগ্ধ আমাকে আনন্দ সঙ্গমে

আর গাও চন্দ্রাহতের গান , উন্মত্ত তোমার চুম্বন

মনে হয় তোমাকে গড়ে তুলেছি মননে।

 

 

স্বর্গচ্যুত হয় ভগবান, আগুন ম্লান হয় নরকে 

দেবদূত আর শয়তানেরা একযোগে করে গমন

আমি চোখ বুজে ফেলি আর পৃথিবীটা ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।

 

 

কল্পবিলাসী আমি ভাবি যে পথে গেছো আসবে ফিরে

কিন্তু বেড়েছে বয়স আমার, ভুলে গেছি তোমার নাম এখন

মনে হয় তোমাকে গড়ে তুলেছি মননে।

 

 

বরং যদি ভালোবাসতাম আগুন পাখিটিকে

বসন্ত দিনে তার সশব্দ হতো আগমন 

আমি চোখ বুজে ফেলি আর পৃথিবীটা ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।

 

 

'এই, এটা কি ভিলানেল?'

 

হ্যাঁ। ১৯ পংক্তির ভিলানেল। পাঁচটি স্তবক তিন পংক্তির আর শেষের স্তবক চতুষ্ক। 

 

তুমি দেখো--- প্রথম স্তবকের প্রথম তৃতীয় পংক্তি দুটি ফিরে ফিরে আসছে। প্রথমটি ফিরছে দ্বিতীয় চতুর্থ ষষ্ঠ স্তবকের তৃতীয় পংক্তি হিসেবে। আর প্রথম স্তবকের তৃতীয় পংক্তিটি ফিরে আসছে তৃতীয় এবং পঞ্চম স্তবকের তৃতীয় পংক্তি হিসেবে এবং শেষ স্তবকের চতুর্থ পংক্তি হিসেবেও

 

'ভিলানেল নিয়ে আরো একটু বলো প্লিজ..

 

'ভিলানেল' শব্দটি এসেছে ইতালীয় 'ভিলানেলা' থেকে যার অর্থ গ্রাম্য নাচ, গানের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে। এই 'ভিলানেলা' আবার নেওয়া হয়েছে 'ভিলানো' শব্দটি থেকে যার অর্থ পল্লীবিষয়ক।

 

প্রথম প্রথম এই ধরনের কবিতার থিম কিন্তু ছিল নেহাত দেহাতি, গ্রাম্য মাঠঘাট, পশুপালন ইত্যাদি। বিশেষ কোনো ফর্মহীন।

 

'কিন্তু এই মাত্র যে কবিতাটি তুমি শোনালে তাতে তো পল্লীবিষয়ক কিছু পেলাম না। বরং ব্যক্তিকেন্দ্রিক যন্ত্রণা কোথায় যেন আধুনিক নাগরিক জীবনের একাকিত্বের যুগযন্ত্রণা সঙ্গে মিশে গিয়ে বিরাট এক -সুখের বার্তা দিচ্ছে। আমি এই কবি তাঁর কাব্য জগত সম্পর্কে জানতে চাই। আমাকে বলো, বলো --- '

 

তোমার অনুধাবনকে কুর্ণিশ না করে উপায় নেই। তুমি একদম ঠিক ধরেছ। ক্ষ্যাপামি, প্রেম আর কবিতার আখরে ছড়িয়ে থাকা বিষণ্ণতা যেন এক বিন্দুতে এসে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙে গেছে এখানে। মিশে গেছে জীবনের তারুণ্য কবিতার গোধূলি সন্ধ্যায়।

 

কথাগুলি এক  তরুণীর বিরহগাথা। ভেঙে যাওয়া ইতিবৃত্ত। অদ্ভুত বিষণ্ণতার নীল কালিতে নিব চুবিয়ে লেখা এই কবিতা।  মেয়েটি হয়তো তার প্রেমিককে হারিয়েছে, কিন্তু প্রেমের দাগ তো মুছে যায়না অন্তর থেকে। হৃদয়ের কোণায় কোণায় সেই পরাগ ছড়িয়ে পড়ে, তাকে করে তোলে উন্মাদপ্রায়। সে স্বপ্ন দেখছে, কাঁদছে, প্রত্যাশা করছে। পরমুহূর্তে সেই প্রত্যাশার সুরম্যপ্রাসাদ নিজেই ভেঙে খন্ড খন্ড করে ফেলছে। কারণ সে জানে--- যে যায় সে ফিরে আসবে বলে যায় না। তার পৃথিবীটা তাই হৃদয়ের বিষণ্ণ ইশারায় ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। জীবনানন্দ বলেছিলেন : প্রেম ধীরে মুছে যায় ... 

 

আসলে ঠিক সব হৃদয় থেকে মুছেও তো যায় নাতাই  মাথার ভিতর নাছোড়বান্দা পোকার মতো গেঁথে থাকে আর কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। 

 

'হায়! কেউ কেউ হয়তো এভাবে হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে।'

 

আর সবচেয়ে অদ্ভুত কথা কি জানো ১৯৫৩ -তে প্রকাশিত এই  কবিতার এই তরুণী, কবির আত্মনির্মাণ বলে মনে হয় অথচ তখনও তাঁর জীবনে সেভাবে প্রেমের সাক্ষাৎ- হয়নি। এরপর বহুবার তিনি যেন নিজের বুকের রক্ত দিয়ে রাঙিয়ে তুলেছেন তাঁর সব কবিতাগুলোকে। সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে কনফেশনাল পোয়েট্রি (Confessional Poetry) তাঁর কবিতা আসলে তাঁর যাপনের শাব্দিক প্রকাশ--- হাইলি পারসোনাল জঁর (a highly personal genre) ক্রমাগত ব্যক্তিগত পরিসর থেকে নিজস্ব আবেগ সঞ্জাত কবিতা লেখা চলত। তাই কবিতা পর কবিতায়  স্বপ্ন, মনন, আঁধার, চন্দ্রাহত, বিষণ্ণতাপ্রেমহীন যৌনতা, ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষা, ট্রমা, ডিপ্রেশন -এর  প্রকাশ  আলটিমেটলি তাকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরবে যে সে এগিয়ে যাবে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে তার কাব্যপ্রতিভার সমৃদ্ধতম সময়ে।

 

'তোমার এই আলোচনায় আমি আরো আকৃষ্ট হয়ে পড়ছি। কে এই কবি? তার কাব্যের ভুবনটিতে নীরব ভ্রমণের আগে আরো একটু শুনে নিতে চাই, বলো আমাকে ---'

 

আচ্ছা আচ্ছা বলছি।

 

তার আগে আর একটা কবিতা পড়ে নিই ---

 

 

The Couriers (ক্যুরিয়ারগুলি)

 

 

পাতার প্লেটের উপর শামুকের কথা?

এটা আমার কথা নয়। গ্রহণ কোরোনা।

 

 

বন্ধ কৌটোর ভিতর অ্যাসেটিক অ্যাসিড?

একেও গ্রহণ কোরোনা। ততটা আন্তরিক নয়।

 

 

স্বর্ণ অঙ্গুরীয় তাতে সূর্যের কারুকার্য?

মিথ্যে। মিথ্যে আর তীব্র বিষাদ।

 

 

পাতার উপর তুষার, পবিত্র

পাত্র, কথা বলছে আর সশব্দে ফেটে পড়ছে

 

 

এগুলো সবই রয়েছে আল্পস পর্বতের

নয়টি কৃষ্ণ শৃঙ্গে।

 

 

দর্পণগুলির ভিতর কিছু অস্পষ্টতা 

সমুদ্র চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে নিজস্ব ধূসর

 

 

প্রেম, প্রেম, আমার ঋতু।

 

 



 

ইনি বিশিষ্ট কবি ঔপন্যাসিক, বিদূষী সিলভিয়া প্লাথ। সাহিত্যের রথী মহারথী থেকে শুরু করে সাধারণ পাঠক সকলেই তাঁকে এক নামেই চেনে। কারণ তাঁর জীবন আর সাহিত্য এক বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে আর সেই বিন্দুর নাম বিষণ্ণতা, সেই বিন্দুর নাম আঁধার।  'Our sweetest songs are those that tell of saddest thought'-- মনে আছে তো?

 

 

'হ্যাঁ। শেলি, ওড টু স্কাইলার্ক।'

 

গুড --

 

সিলভিয়া প্লাথ জন্মেছিলেন ২৭ -শে অক্টোবর, ১৯৩২ সালে  আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসের উইনথ্রপে। বাবা অটো প্লাথ মা অরেলিয়া প্লাথ এর জেষ্ঠ্য সন্তান সিলভিয়া। ভাই ওয়ারেন বছর তিনেকের ছোট। অটো প্লাথ পন্ডিত মানুষ, লেখাপড়া নিয়ে থাকতে ভালোবাসেন। কিছুটা উদাসীন নিজের শরীর - স্বাস্থ্য সম্পর্কে। তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক, একজন কীট বিজ্ঞানী।  

বাবার মেধার উত্তরাধিকার পেয়েছিলেন সিলভিয়াও। লেখাপড়ায় ভালো মেয়েটি  মাত্র আট বছর বয়সেই বোস্টনের হেরাল্ট পত্রিকার শিশুদের বিভাগে নিজের কবিতা প্রকাশে সমর্থ হয়।

 

তাই? তাহলে তো খুব ছোট থেকেই প্লাথ সাহিত্যের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে শুরু করে ছিল, তাই না?'

 

হ্যাঁ। একদম তাই। এরপরের দিনগুলোতেও তিনি লেখা চালিয়ে যেতে থাকেন এবং সমসাময়িক পত্রিকাগুলোতে তাঁর লেখা প্রকাশিত হতেই থাকে। 

 

কিন্তু খুব দ্রুত এই উজ্জ্বল সময়েই নেমে আসে দুঃখের কালো মেঘ। ১৯৪০ - পিতার মৃত্যু সিলভিয়ার জীবনে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলেছিল। আসলে বাবার সঙ্গে সিলভিয়ার সম্পর্কটাও ছিল বড় অদ্ভুত। অথরিটেটিভ বাবার শাসন তার পছন্দ ছিল না  তেমন, কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর নিজের খাতায় লিখে রেখেছিল Electra on Azalea Plath স্বামীর মৃত্যুর পর অরেলিয়া সপরিবার ওয়েলেসলি-তে বসবাস শুরু করেন। সেখান থেকেই সিলভিয়ার হাইস্কুল জীবনের শুরু।

 

স্কুলের পর সিলভিয়া স্মিথ কলেজে ভর্তি হন ১৯৫০ সালে। মেধাবিনী এই ছাত্রীটি দ্য স্মিথ রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি আমেরিকান কবি ডিলান থমাস এর ভক্ত ছিলেন সে সময় থেকেই। 

 

কলেজ - পড়াকালীন সময় থেকেই  সিলভিয়া ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের স্বীকার হন। দ্বারস্থ হতে হয় মনোচিকিৎসকের। এসময় বস্টনের প্রখ্যাত মানসিক হাসপাতাল ম্যাকলিনে কর্মরত রুথ বার্ণহাউস  ছিলেন তাঁর মনোচিকিৎসক। একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টার পর প্লাথকে আনা হয়েছিল চিকিৎসার জন্য, সেইসঙ্গে ছিলো ম্যানিক ডিপ্রেশনের লক্ষণ।

 

হাসপাতালের চিফ সাইকিয়াট্রিস্ট  এরিখ লিণ্ডারম্যান মনে করেছিলেন, কোন মহিলা চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললেই সিলভিয়া সবচেয়ে উপকৃত হবে। তিনিই রুথের হাতে তুলে দিয়েছিলেন সিলভিয়ার দায়িত্ব।

 

প্রত্যেকদিন থেরাপি সেশন  দিতেন রুথ তাকে। ইনসুলিন ইনজেকশন চলতো নিয়মিত। তবুও তার মন থেকে আত্মহত্যার চিন্তা সরানো যাচ্ছিল না। রুথ তখন সিদ্ধান্ত নেন ইলেকট্রোকনভালসিভ থেরাপি দেওয়ার। মাত্র দুটো সেশনেই কাজ হয়েছিল, অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছিলো সিলভিয়া। এরপরই তাকে হাসপাতাল থেকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হলে সে বোস্টন ছেড়ে নিজের শহর স্মিথ ফিরে যায়। কিন্তু রুথের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে সবসময়ের জন্য। রুথের ভাষায় "I saw her everytime she came to Boston. I kept in touch with her all the time."

 

এবারে স্মিথ কলেজ থেকে ফুলব্রাইট স্কলারশিপ সহ গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি নিয়ে প্লাথ ভর্তি হলেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এ। সেখানে ১৯৫৫ সালে তিনি পেলেন গ্ল্যাসকক প্রাইজ তাঁর কবিতা two lovers and a Beach -- comber by the Real এর জন্য। পেলেন আরো ছোটখাটো কয়েকটি পুরস্কার।


 



 

কেমব্রিজ থাকাকালীনই ১৯৫৬ -তে প্লাথের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় আমেরিকার আরেক বিখ্যাত কবি টেড হিউজের। সংক্ষিপ্ত প্রেম পর্বের পর সে বছর জুন মাসে তারা বিয়ে করেন। নবদম্পতি উষ্ণ গ্রীষ্মকালীন হানিমুনটা কাটান ফ্রান্স স্পেনের সোনালী সূর্যের নিচে। খুব দ্রুত গতিতে চলতে থাকে তাঁদের লেখার কাজ, যেন খুব তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেলতে হবে অনেক কাজ, যেন খুব দ্রুত ফুরিয়ে যেতে পারে আনন্দঘন দিনগুলো।

 

গিভ মি ব্রেক প্লিজ। কিন্তু তুমি কোথাও যেও না। আমি এখুনি ফিরে আসছি ....

 

হাইএকটা ছোট কবিতা পড়ছি, শোনো ---

 

 

Contusion (বিভ্রান্তি)

 

 

ফিকে বেগুনি রঙের বন্যা এখানে 

বাকি সব রঙ ধুয়ে গেছে 

মুক্তোর শুভ্রতা শুধু বাকি

 

 

পাহাড়ের সুচারু খাদে 

সমুদ্র জোর করে ঢুকে পড়ে

এক মহাশূন্যতা বিছিয়ে

 

 

অনেকটা মাছির মতোন

দেওয়াল বেয়ে নেমে যায়

যার পতন চিহ্নিত রয়েছে

 

 

হৃদয় রূদ্ধ হয়ে আসে 

সমুদ্র গড়িয়ে যায়

আয়নাগুলো পড়ে থাকে নির্বাক

 

 

কি মনে হচ্ছে? সেই এক ভাঙা ভাঙা ইমেজ। ছোট ছোট বাক্য। পাহাড়, গিরিখাত, ধূসর সমুদ্র, বেদনার নীল রঙ, মুক্তো দর্পণের প্রতীকী ব্যবহার

 

না, সিলভিয়ার প্রথম দিকের সব কবিতাই এমন ছিল না। বেশ কিছু কবিতায় ন্যাচারাল ইমেজারি লক্ষ্য করা যায় যেমন ধরো এই স্তবকের প্রথম লাইন দুটোতে :

 

The figs on the fig tree in the yard are green;

Green, also, the grapes on the green bibe

Shading the brickred porch tiles.

The money's run out.

 

 

সারি সারি ডুমুর গাছে ঝুলে আছে সবুজ ডুমুর

আঙুরের ক্ষেতে সবুজ আঙুরের ছবি, কী ভীষণ স্পষ্ট আর সতেজতাই না

 

 

কিন্তু আস্তে আস্তে তাঁর মানসিক অবসাদ আত্মহত্যার প্রবণতা তাঁর কবিতায় কায়া শব্দ দুটোই পাল্টে দেয়। ব্যাপারে অবশ্য  কবি রবার্ট ওয়েল এবং কবি অ্যান সেক্সটন এর ভূমিকা প্রভাব ব্যাপক। দুজনেই প্লাথ কে উৎসাহিত করতে থাকেন জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কবিতা রচনার ক্ষেত্রে।  অ্যান সেক্সটন এর হাইলি পারসোনাল কনফেশনাল স্টাইল প্লাথকেও সাহায্য করেছিল নারীবাদের স্বতন্ত্রস্বর গড়ে তুলতে।  মনে রেখো, রিবার্থ (rebirth) আর উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট (women - empowerment) প্লাথের কবিতার অন্যতম লিগ্যাসি। 

 

নারী ল্যাজারস - তুমি এর সন্ধান স্বাদ পাবে :

 

 

Lady Lazarus  (নারী ল্যাজারস)

 

 

আমি আবার করেছি এটা

প্রত্যেক দশকে একবার

আমি এটা করে থাকি

 

 

এক বিস্ময়-চলন, আমার ত্বক

এতো ফর্সা যেন নাৎসি ক্যাম্পে ইহুদির

আমার ডান পায়ের পাতা

 

 

একটি পেপার ওয়েটের মতো ভারি

আমার বৈশিষ্টহীন মুখমন্ডল

যেন ইহুদিদের লিনেন কাপড়ে ঢাকা

 

 

খুলে ফেল পটি

ওহ্ তুমি আমার প্রতিপক্ষ

আমি কি ডরাই তোমাকে?

 

 

নাক, চোখের কোটর, দাঁতের পাটি?

টকে যাওয়া নিঃশ্বাস

মুছে যাবো দিনের আলোয়

 

 

দ্রুত, খুব দ্রুত মাংস 

আমার কবরের মধ্যে ক্ষয়ে যাবে

ফিরে আসবে আমার দেহে

 

 

এবং আমি হবো আরো একবার হাসিখুশি নারী

আমি সবেমাত্র ত্রিশে

আর বিড়ালের মতো নয়বার মরতে চেষ্টা করেছি

 

 

এটা তৃতীয় বার

কী ভীষণ লজ্জা

এভাবে প্রত্যেকটা দশককে নষ্ট করে ফেলা

 

 

লক্ষ লক্ষ উজ্জ্বল আলোদান

আখরোট চিবানো জনতা দেখতে চাইছে

আমার কফনটি খুলে ফেলছে

 

 

তারপর খুলে গেল মোড়ক আমার হাত পায়ের পাতা

দারুণ বিবাদমান

মহাশয়, মহাশয়াগণ দেখুন

 

 

দেখুন আমার হাতদুটো

আমার জঙ্ঘা 

আমি হাড়- চামড়ায় ঢাকা কাঠামো কেবল

 

 

তবু আমি তো সেই, অভিন্ন নারী

দশ বছর বয়সে প্রথম ঘটেছিল

সেটা ছিল নিছক দুর্ঘটনা

 

 

দ্বিতীয়বারের কথা বলছি 

এটা সুসম্পন্ন করতে এবং যাতে ফিরে আসতে না- হয়

আমি ঠিকঠাক সেঁটে দিয়েছিলাম

 

 

নিজেকে ঝিনুকের মধ্যে কয়েদ করে নিয়েছিলাম

তারা আমাকে ডাকছিল ---- ডাকছিল

আর আমাকে ঝিনুক থেকে মুক্তোর মতো আলাদা করছিল

 

 

মারা যাচ্ছি

অন্য সব কিছুর মতো এটাও একটা শিল্প

আমি নিপুণ কৌশলে সম্পাদনা করেছি

 

 

নরকের অনুভূতি

সত্যের অনুরূপ

অনুমান করতে পারি তুমি বলবে আমাকে ডাকছে

 

 

একটা কক্ষের মধ্যে এটা করা খুব সহজ

এটা সহজ একই জায়গায় স্থির থাকা

একটা নাটকীয় ভঙ্গী

 

 

ফিরে আসা দিনের প্রশস্ত আলোতে

একই শরীরে, একই মুখ নিয়ে

সেই পুরনো বিভৎস কোলাহলে

 

 

একটা বিস্ময়

এক ঝটকায় আমাকে ফেলে দেয়

আমি সকলকে ভর্ৎসনা করি

 

 

আমার ক্ষতদাগে সকলের দৃষ্টি

আমি উদ্বুদ্ধ করি আমার হৃদয়ের কথা শোনার জন্য

এটা সত্যিই ধুকপুক করতে থাকে

 

 

নির্দিষ্ট মূল্যমান, বেশ উচ্চমূল্য নির্ধারণ করি

একটা শব্দ বা স্পর্শের জন্য

অথবা একবিন্দু রক্তের

 

 

কিংবা আমার চুলের মূল্য বা কাপড়ের এক টুকরো

তাই ডাক্তার

হে ডাক্তার -- আমার প্রতিপক্ষ

 

 

আমি তোমার শ্রেষ্ঠ সাংগীতিক রচনা

আমিই তোমার বহুমূল্য শিল্পকর্ম

খাঁটি সুবর্ণ সন্তান

 

 

যে গলে যায় তীব্র চিৎকারে

মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছি, জ্বলছি জীবন্ত

ভেবোনা আমি খাটো করে দেখছি তোমার যত্নশীলতা

 

 

ছাই ভস্ম

তুমি ছুঁয়ে ছেনে নিচ্ছো

মাংস হাড় কিছুই সেখানে নেই

 

 

শুধু একটি সাবান

বিবাহ-বন্ধনী আংটি

একটি সোনার নকল দাঁত

 

 

ওহ্ ঈশ্বর, ওহ শয়তান

সাবধান

সাবধান

 

 

ছাইভস্ম থেকে

জেগে উঠি লালচুলো আমি

পুরুষকে খেয়ে ফেলি, যেন তেমন কিছুই নয়, শ্বাস নিচ্ছি পরিপাটি।

 

 



 

 

১৯৫৯। ইউনাইটেড স্টেটস কানাডা ভ্রমণ সেরে  প্লাথ হিউজেস ইংলন্ডে আসেন এবং লন্ডনে সেটল্  করেন। ঘরে নতুন খুশির আগমন বার্তা। হাসিখুশি জীবনে ফুলের মতো মেয়ে ফ্রিডার জন্ম হলো। তখন বসন্ত। তখন ১৯৬০। এবছর তাঁর প্রথম সম্পূর্ণ কবিতার বই দ্য কলোসাস এন্ড আদার পোয়েমস প্রকাশিত হয়। ইটি প্রশংসিত হয় খুব।

 

দ্য বেলজার প্লাথের একমাত্র উপন্যাস এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রশংসিত সাহিত্যকীর্তি। এটি একটি আধা আত্মজৈবনিক উপন্যাসতিনি লিখলেন 'ভিক্টোরিয়া লুকাস' ছন্মনামে। লেখা যখন হচ্ছিল তখন তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের ঝঞ্ঝাপূর্ণ সময়। ১৯৬১ -তে পুনরায় প্রেগন্যান্ট হয়ে মিসক্যারেজ, ১৯৬২- তে ছেলে নিকোলাসের জন্ম। ছেলের প্রতি, সিলভিয়ার প্রতি টেড - এর দুর্ব্যবহার, পারিবারিক বান্ধবী অ্যাসিয়া ওয়েভিলের সঙ্গে টেডের  বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক --- সব মিলিয়ে সিলভিয়াকে যেন পুরে দেওয়া হল যন্ত্রণার গিলোটিনে।

 

 

এক ইন্টারভিউ সিলভিয়া বলছেন সাহিত্যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তখন পছন্দস হয় যখন  --- it was not a Kind of shut- box and mirror looking narcissistic experience । তিনি নিজের কাজে আগাগোড়া অনুসরণ করেছেন এটা। ব্যক্তিগত আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, ক্রোধ প্রকাশ করছেন একটা বড় পার্সপেক্টিভ জুড়ে। যেমন এই কবিতাটিতেই। তিনি তাঁর সদ্য মা হওয়ার ছবি আঁকতে আঁকতে শব্দকে মুঠো ভরে ছড়িয়ে দিলেন নক্ষত্রমন্ডলে।

 

 

Morning Song (প্রভাত সংগীত)

 

 

ভালোবাসা তোমাকে মূল্যবান সোনার ঘড়ির মতো করে দেয়

ধাত্রীটি তোমার পায়ের পাতার নিচে চাপড় মারে

আর তোমার চিল চিৎকার জগতের উপাদানগুলির মধ্যে জায়গা করে নেয়

 

 

আমাদের কন্ঠস্বর প্রতিধ্বনিত হয়, দৃশ্যত নতুনের আগমন

তোমার দেহভাস্কর্য

শীতল অস্বস্তিকর এই ঘরে তোমার নগ্নতা

আমাদের সুরক্ষাকে নস্যাৎ করে দেয়

আমরা দেওয়ালগুলির মতো শূন্য, গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি

 

 

আমি আর তোমার মা নই

তার চেয়ে বরং যে মেঘ আয়নার মতো স্বচ্ছ

প্রতিবিম্বিত করে বাতাসের গায়ে মেঘের চিহ্নলোপ 

 

 

সমস্ত রাত তোমার মথের মতো কোমল শ্বাস

কাঁপতে থাকে গোলাপের পাপড়িতে। আমি উন্মুখ হই

এক দূরাগত সমুদ্র ঢেউ আমার শ্রবণকে আকুল করে তোলে

 

 

কান্নার শব্দ আর আমি বিছানা ছেড়ে নামতে গিয়ে হোঁচট খাই

আমার পরণে ভিক্টোরিয় যুগের মতো ফুলেল রাত্রিবাস

তোমার মুখ বিড়ালের মতো খোলা। চৌকো জানালা

 

 

ধূসর নক্ষত্রদের নিবর্ণ করে আর ঠুকরে খায়। আর তুমি মুঠোভরা সুর তুলে নাও

সুস্পষ্ট স্বরধ্বনিগুলো আকাশে উঠে যায় বেলুনের মতো।

 

 

'এরপর আর কী কী বের হলো সিলভিয়ার?'

 

 

? হ্যাঁআবার এক নতুন ভাষাপথ ধরে নতুন আঙ্গিকের কবিতা লিখতে শুরু করলেন সিলভিয়া। যা 'অ্যারিয়েল' নামে খ্যাত। 

 

 


 

 

কিন্তু হয়ে বের হবার আগেই প্রচন্ড মানসিক পীড়ায় আক্রান্ত হলেন তিনি। স্বামী টেড হিউজের তাঁকে ছেড়ে চলে যাওয়াটা প্লাথের ক্ষেত্রে অনেকটা তার বাবার মৃত্যু পরবর্তী সাংঘাতিক আঘাতের মতো বেদনার বালুচরে আছড়ে পড়ল।

 

১৯৬৩ -এর ১১- ফেব্রুয়ারির এক দারুণ শীতের কুয়াশামাখা সকালে গ্যাস আভেনের ভেতর নিজের মাথা গুঁজে দিয়ে গ্যাসের চাবিটি অন করে দিলেন। আত্মহত্যাকে সুনিশ্চিত করতে কিচেনের দরজা জানালা গুলি ভালো করে বন্ধ করে তোয়ালে গুঁজে দিতে ভোলেননি।  কারণ :

 

'Dying 

Is an art, like everything else.

I do it exceptionally well.'

 

 

এরপর সিলভিয়া প্লাথের কবিতার আরিয়েল (Ariel)প্রকাশিত হলো ১৯৬৫ সালে, অপ্রকাশিত কিছু কবিতাসহ দ্য কালেক্টেড পোয়েমস (The Collected Poems) ১৯৮১। এই ইটির জন্য তিনি পেলেন মরণোত্তর পুলিৎজার পুরস্কার। আর  তিনটে শিশুতোষ আর পরে চিঠিপত্রের সংকলন বের হয়। 

 

শোনা যায় কবির মৃত্যুর পর টেড হিউজ অনেক কবিতাই 'পরিমার্জনা' করে দেন কারণ তাতে সিলভিয়া-টেডের ফিকে হয়ে আসা দাম্পত্যের বেশ কিছু নীল, লাল, কালসিটে দাগ ছিল ....

 

পৃথিবীর দুই প্রান্তে বসে দুই বন্ধু ইন্টারনেটে জুড়ে যখন এভাবেই সিলভিয়া প্লাথকে নিয়ে আলোচনা করছে, তখন এক দেশের ভোরের আকাশ ঈষৎ কুসুমের রঙ নিয়েছে। অন্য দেশের আকাশে ......




Comments

  1. নতুন আঙ্গিকে জানা হ'ল সিলভিয়া প্লাথের অজানা সব কথা। সমৃদ্ধ হ'লাম। প্রতিটি কবিতার অনুবাদ মুগ্ধতায় মন ভরাল। ভীষণভাবে মন কাড়ল পরিবেশনা।

    ReplyDelete

Post a Comment