গল্প - নবনীতা


অবশেষে

 

 

)
 
তনয়ার জীবনের আজ একটা বিশেষ দিন৷ যদিও এমন দিনটি যে আসতে পারে সে ধারনা তার ছিল না৷ কিন্তু এমন একটি দিনের ইচ্ছে কি তার ছিল না মনের গভীরে কোথাও? একটা ঘরে  তাকে একা বসিয়ে ছেলে মেয়েগুলো যে কোথায় গেল! আশেপাশে মুহুর্তে কাউকে দেখতে পেল না তনয়া৷ বেনারসীটা একটু সামলে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় সে৷ দেওয়াল জুড়ে থাকা বিশাল আয়নাটির বুকে ফুটে ওঠে একটি সদ্য যুবতীর ছবি৷ সিঁদূর, চন্দন, ফুল, বেনারসিতে ভেসে যায় সেই যুবতীর অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত ...
 
 
)
 
সদ্য কলেজ পাশ করেছিল তনয়া৷ পাড়ার লোকজন আর আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে এত সম্বন্ধ আসতে থাকল যে অতিষ্ঠ হয়ে তনয়ার বাবা একটু তাড়াহুড়োতেই  মেয়ের বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছিলেন৷ আর্থিক ভাবে খুব একটা স্বচ্ছল কোনদিনই ছিল না তনয়ার পরিবার৷ তদুপরি আরো দুটি ভাই বোন ছিল তনয়ার পরে৷ তাদের কথা ভেবেই হোক অথবা বাবার মানসিক চাপ কমাতেই হোক শহরের নামকরা ব্যাবসায়ী পরিবারের বড় ছেলের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে একপ্রকার নিমরাজি হয়েছিল তনয়া৷
 
 
কি বলা যায় একে আত্মত্যাগ, স্বার্থত্যাগ নাকি ভাগ্য? শুধু ভাগ্যের পরিহাসেই কি জীবনের সব সখ আহ্লাদ, চাওয়া পাওয়াকে তাড়াতাড়ি তালা চাবি দিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল বাইশ বছরের তনয়াকে?
 
 
অয়ন ...তনয়ার বর, প্রথমদিকে নিজেকে খুব উদারমনস্ক  প্রমান করার চেষ্টা করলেও ধীরে ধীরে ভেতরের কুৎসিত মানসিকতা তনয়ার সামনে বেড়িয়ে পড়তে থাকে৷ সম্পূর্ণ শরীরভোগী একটা মানুষ ছিল সে৷ খালি শরীর পেলে শুয়রের মতো ঘোৎঘোৎ করত৷ ব্যস৷ রসবোধ বলে কোনোকিছু ছিল না লোকটার৷ অন্তত তনয়ার কাছে এমনই  ছিল অয়নের ব্যবহার৷ বিয়ের পর থেকে কোনোদিনও ভালো করে একটু গল্প পর্যন্ত করেনি তনয়ার সাথে সে৷ কখনও জানতে চায়নি তনয়ার ভালোলাগা -মন্দ লাগা, পছন্দ -অপছন্দের বিষয়৷
  
অয়নদের তিন পুরুষের পারিবারিক ব্যবসা৷ হার্ডওয়ার আর গারমেন্টসের৷ শহরের নামকরা ব্যবসায়ীদের মধ্যে ওরা একজন৷ তবে যত সহজে বিয়েটা হয়েছিল বিয়ে করে আসার পর এই বাড়ির পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া তনয়ার জন্য তত সহজ হয়নি৷ প্রতি পদে পদে শ্বশুর বাড়ির লোকজনদের কুসংস্কার, অশিক্ষা, রুচিহীনতা তনয়ার সংসার করার পক্ষে বাধ সাধে৷ প্রতিটি বিষয়ে নিজেকে বাড়ির উপযুক্ত  প্রমাণ করতে হত তনয়াকে৷ বিয়ের কিছুদিন যেতেই এক রাতে অয়ন মাত্রাতিরিক্ত  মদ গিলে, বান্ধবী সহযোগে বাড়ির গেস্টহাউসে ঢুকলে তনয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে৷ শাশুড়িকে বিষয়ে বললে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে উল্টে বলেন,
 
- বড়লোক বাড়ির ছেলেরা এসব একটু আধটু করবেই বৌমা, মেনে নিতে শেখো৷ 
 
- ভীষণ আশ্চর্য হয়ে তনয়া বলেছিল,
 
- তারমানে শ্বশুরমশাইয়েরও এসব ব্যাপার আপনি সহ্য করেছেন
 
চোখে এক দুর্বাশা দৃষ্টি এনে তনয়ার শাশুড়ি সেই যে গোসা হলেন৷ আর তাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হল না কোনোদিনও৷ অয়নের সাথেও দূরত্ব বাড়তে থাকে তনয়ার৷ মায়ের প্রশ্রয়ে নিতান্ত অসংযমী জীবন যাপন করে চলা অয়ন মায়ের কথা শুনে তনয়ার সাথে নিতান্ত দুর্ব্যবহার শুরু করেছিল৷
 
 
বিয়ের সবে একবছর হয়েছিল৷ এরই মধ্যে চোখের নীচে কালি, গলার পাশে কালশিটে দাগ পড়ে তনয়ার৷ এসব কিছু লুকোতে বাইরে যাওয়া এমনকি বাপের বাড়ি যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছিল তনয়া৷ অথচ এমন জীবন তো কোনো মেয়ে  চায় না৷ বিশেষত তার  যদি কোনো দিক থেকে খামতি না থাকে৷ কেমন সুন্দর ছিল তাকে দেখতে! কলেজে তার পেছনে  কত কত ছেলেই না তাদের সময় অপচয় করেছে৷ কত গুণ ছিল তার৷ তনয়ার ইচ্ছে ছিল পড়া শেষ করে কলেজে চাকরী করবে৷ কিন্তু কোথা থেকে কি হয়ে সব এলোমেলো হয়ে গেল৷
 
 
এভাবেই চলছিল জীবন৷ তনয়া একপ্রকার মেনেই নিয়েছিল যে এভাবেই চলতে হবে তাকে এর থেকে কোনোভাবে মুক্তি নেই তার৷ এমন সময় একটা হাল্কা শীতল বাতাসের মতো সুজয় আসে তনয়ার জীবনে৷ সুজয়....অয়নের মামাতো ভাই৷ নতুন চাকরি পেয়ে দেখা করতে আসে পিসির বাড়ি৷ অয়নের মা তার পিসি৷ যেহেতু  বাড়িতে থেকেই সুজয় তার কলেজর পড়াশুনা করেছে৷ সুতরাং চাকরি পেয়ে প্রথমেই সে আসে সুখবরটা দিয়ে  সবার সাথে দেখা করতে৷ তাছাড়া চাকরীর পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে একবছর সমস্ত পৃথিবীর থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ছিল সুজয়৷ সেই সময় বিয়ে হয় অয়নের৷ তাই সুজয় উপস্থিত হতে পারেনি তখন৷ নতুন বৌদির সাথে পরিচয় করাটা তাই অবশ্য কর্তব্য ছিল সুজয়ের৷ তবে সুজয়ের আর একটা পরিচয়ও ছিল৷  সুজয় ছিল তনয়ার ব্যাচমেট৷ বিষয় আলাদা হলেও একই কলেজে তিনবছর পড়াশুনা করেছে তারা৷ মুখ চেনা ছিল ভালোমতোই৷ আর মেয়েদের যে একটা সহজাত ক্ষমতা থাকে প্রেমের দৃষ্টি বোঝার তার জন্য তনয়া বুঝত কলেজের আরো বেশ কিছু ছেলের মতো অথবা তাদের থেকেও বেশি এক ভালোলাগার মনোভাব ছিল  সুজয়ের চোখে  তনয়ার  প্রতি৷
 
 
প্রথম দর্শনেই তনয়াকে দেখে চমকে ওঠে সুজয়৷ আরে ... যে তার কলেজ জীবনের ক্রাশ৷ তনয়া৷ যার কথা ভেবে কত রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে সে৷ যার একবার তাকানো তার সারাদিনের এনার্জি টনিক ছিল৷ সেই শেষে অয়ন দার বউকিন্তু একি চেহারা হয়েছে তার! দাদার ব্যবহারও সুজয়ের চোখে লাগে৷ ভীষণ অ্যালকোহলিকদের মতো লাল চোখ, জড়ানো কথা৷ যদিও বরাবর খুব লাগাম ছাড়া জীবন ছিল দাদার, ভাই হিসেবে সেটা সে জানত৷ কিন্তু বিয়ের পর তো সবার পরিবর্তন হয়৷ যাইহোক 'দিন থেকে সে বিদায় নিল ঠিকই নিজের কর্মক্ষেত্রে কিন্তু মন পড়ে থাকল তনয়ার দিকেই৷ শুধু একটা কাজের কাজ সে করে গিয়েছিল৷ তনয়াকে তার অফিস বাড়ির ফোন নাম্বার ঠিকানা একটা কাগজে লিখে দিয়ে গিয়েছিল৷ তখনও মোবাইলের  চল হয়নি৷ একদিন বেশ রাতের দিকে বেজে উঠল সুজয়ের রেসিজেন্সের ফোনটা৷ ফোনের ওপারে ছিল তনয়ার কান্নাভেজা গলা৷ সেই শুরু ...তারপর কখনও  দিনে আবার কখনও রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ল্যান্ডফোনেই অল্প স্বল্প কথার মাধ্যমে বাড়ছিল ওদের বন্ধুতা৷ গভীর হচ্ছিল এমন এক অবৈধ সম্পর্ক, যার অনুমোদন বোধহয় স্বয়ং ভগবানই দিয়েছিল৷  সুজয় প্রথমটা  দাদার বউ হিসেবে ইতস্তত বোধ করলেও জীবনে একমাত্র সিরিয়াসলি ভালোলাগার মেয়েটির দুঃখ তাকে সেই মনোভাবে টিকে থাকতে দেয়নি বেশিদিন৷ একটু একটু করে সুজয়ের আবারো পুরোনো দুর্বলতা ফিরে আসে তনয়ার প্রতি৷ 
 
 
তনয়া অন্ধকার জীবনে কোথায় যেন একটু আলোর খোঁজ পায়৷ কেনো যেন তার ইচ্ছে হয় আবারো নতুন করে বাঁচার৷ এভাবেতো তাকে কেউ কখনও জানার চেষ্টা করেনি৷ এভাবে তাকে কেউ বুঝতে চায়নি কোনিদিনও৷ খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করত সুজয়কে তনয়ার৷ ভেসে যেতে ইচ্ছে করত কখনও কখনও   নিষিদ্ধ সম্পর্কের চোরা স্রোতে৷ কিন্তু না পারেনি তারা৷ অথবা সেভাবে চায়নি কেউ কোনোদিনও৷ বৌদি হিসেবে যেমন মাত্রা ছাড়াটা উচিত মনে করেনি তনয়া৷ তেমনই ভালোবাসার মানুষটির উপর কখনই জোর খাটাতে চায়নি সুজয়ও৷ এভাবেই একরকম কেটে যাচ্ছিল তনয়ার জীবন৷ 
 
 
সালটা ২০০০৷ একদিন তনয়া বুঝতে পারে তার শরীরে নতুন অতিথির উপস্থিতির কথা৷ ভীষণ খুশির খবরটা তনয়া প্রথমেই জানায় অয়নকে৷ তনয়া ভেবেছিল এবার হয়তো তার শ্বশুর বাড়িতে সম্মান খানিক বাড়বে৷ এবার হয়ত তার প্রতি শ্বশুরবাড়ির  লোকেদের অত্যাচারের মাত্রা কিছুটা কমবে৷ কিন্তু অয়নকে খবরটা জানানোর  পরেও তার খুব একটা তাপ উত্তাপ লক্ষ্য করা যায় না৷ তারপর  শাশুড়িকে জানালে তিনি বলেন 
 
- বেশ কথা ...তবে ছেলে চাই৷ না হলে বাড়িতে কোনো জায়গা নেই তোমার মনে রেখো৷ বাড়িতে শুধু ছেলের জন্ম দিয়েছে সব প্রজন্মের বউয়েরাই৷
 
আশ্চর্য হয়ে যায় তনয়া৷ হতাশা ক্ষোভ জানানোর একমাত্র জায়গা ছিল সুজয়৷ তার  কাছে এই আনন্দের খবরটি জানায় তনয়া৷ তার সাথে শাশুড়ির বা সুজয়ের  পিসির সাবধান বানীটিও৷ তনয়ার মাতৃত্বের সংবাদ যে সুজয়কে খুব খুশি করেছিল তা নয় তবে সে তনয়াকে বলেছিল 
 
-যদি কখনও বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ হয়ে যায় তুমি আমার বাড়িতে চলে এস বৌদি৷   দরজা তোমার জন্য চিরকাল খোলা থাকবে৷ 
 
ভীষণ মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দিয়েছিল সুজয়ের কথাগুলো তনয়াকে সেই সময়
তবে একটা ভয় থেকেই অনেক সময় মস্করা করে তনয়া বলত  
 
-হ্যাঁ আমি যাই আর তোমার বউ এলে বটি নিয়ে আমায় তাড়া করুক৷ না?
 
বউয়ের কথা উঠলেই একদম চুপ করে যেত সুজয়
 
 
)
 
অবশেষে সুজয়ের কাছেই যেতে হয় তনয়াকে৷ সত্যি দরজা খোলা রেখেছিল সুজয় তার ভালোবাসার মানুষের জন্য৷ না সুজয়ের বউ বটি হাতে তাড়া করার সুযোগ পায়নি৷ তবে মাঝে শুধু  হুগলী নদী দিয়ে গড়িয়ে গেছে গ্যালন গ্যালন জল৷ আর তনয়ার জীবনে  তৈরি হয়েছে দীর্ঘ কুড়ি বছরের সংগ্রামময় এক ইতিহাস৷
 
 
)
 
আজ সুজয়ের সাথে তনয়ার বিয়ে হয়৷ পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী দুজন প্রৌঢ় প্রৌঢ়ার মিলনের সাক্ষী থাকে কতগুলি  যুবক-যুবতী৷ আর পরিকল্পনা? সম্পূর্ণ  তৃণার৷ তৃণা, তনয়ার মেয়ে৷ হ্যাঁ মেয়েই হয়েছিল তনয়ার৷ আর কুড়িটা বছর ধরে মেয়ে তৃণাকে শুধু তার অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে না বলে, শুধু মেয়ের কথা ভেবেই শ্বশুর বাড়িতে সহ্য করেছে অনেক  অত্যাচার৷ জীবনের কুড়িটা বছর প্রাধান্য দিয়েছে মেয়ের জীবনকে৷ আর আজ আবারো মেয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতেই বিয়ের পিড়িতে বসা তনয়ার৷ সদ্য কলেজ পাশ করেছে তৃণা বন্ধু বান্ধব আর সুজয় কাকুকে সাথে নিয়ে করেছে এসবের আয়োজন৷ সুজয় তৃণার কাছে তার বাবার থেকেও কাছের, বাবার থেকেও ভরসার একজন  মানুষ হয়ে উঠেছে বিগত কুড়িটা বছর ধরে৷
   
 
তনয়ার রুপোলী সিঁথিতে লাল সিঁদূর৷ চোখে  ভারী চশমা৷ সারা ঘরে তার প্রিয় ফুল রজনীগন্ধার গন্ধ ভরানো৷ আকাশ রঙা বেনারসীতে এখনও অনন্যা তনয়া৷ তনয়ার ঠিক পেছনে এসে তার গা ঘেষে দাঁড়ায় দুজন৷ তনয়ার  সবচেয়ে ভালোবাসার দুটো মানুষ সুজয় আর তৃণা৷

 



Comments