মল্লিক মেডিক্যালস
শীতের সন্ধ্যা। এখন রাত প্রায় সাড়ে নটা। রাস্তায় লোকজন খুব বেশী নেই। ডাক্তার অভীক বসুর চেম্বারের বাইরে জনা চারেক রোগী বাইরের চেয়ারে, বেঞ্চে বসে আছে। মল্লিক মেডিক্যালস এর একপাশে ডাক্তার বাবুর চেম্বার। অন্যদিকে ওষুধের দোকান। দোকানের মালিক রতন খাতায় রোগীর নাম লিখে রাখে। খাতা দেখে একে একে রোগীর নাম ডাকে। তারপর রোগী একা অথবা বাড়ীর লোক সহ ঢুকে যায় ডাক্তার বাবুর চেম্বারে।
ডাক্তারবাবু চেম্বারে আসেন সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। তার আগেই চেম্বার পরিস্কার করে সাজিয়ে রাখতে হয়। ডাক্তারবাবু এসে একটু সময় নেন। তারপর রোগীদের পাথাতে বলেন একে একে।
দোকানে রতনের কাজ অনেক। রোগী চেম্বার থেকে বের হলে প্রেস্ক্রিপসন দেখে ওষুধ দেয়। খাবারের নিয়ম বলে এবং প্যাকেটে লিখে দেয়। ওষুধের দাম গুনে রাখে ক্যাশ বাক্সে। শেষ হবার আগেই ওষুধের নাম লিখে রাখে বড় খাতায়। পরদিন আবার অর্ডার দিতে হয় সেই সব ওষুধের।
কখনও নিজের লোক এলে তাকে তাড়াতাড়ি দেখাবার ব্যাবস্থা করতে হয়। দুপুরে আর একজন ডাক্তার বসেন। তার বেলাতেও নিয়ম মোটামুটি একই। এসব কাজে রতনের একজন সহকারী আছে। সে রতনকে সাহায্য করে।
চেম্বার খালি হতেই রতন রোগীর নাম ধরে ডাকলো । রোগীর সাথে আসা ভদ্রমহিলা হাত তুলে দেখালেন। তারপর রোগী নিয়ে ভদ্রমহিলা ঢুকে গেলেন ডাক্তার বাবুর চেম্বারে।
রোগী ডাক্তারবাবুর সামনে বসতেই ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন – আপনার অসুবিধা কি ?
রোগীর সাথে আসা ওনার স্ত্রী অসুবিধাগুলি বলতে যাচ্ছিলেন। ডাক্তারবাবু তাকে থামিয়ে দিলেন – ওনাকেই বলতে দিন। রোগীর পরনে প্যান্ট সার্ট তার ওপর পুরোনো ফুল সোয়েটার, গলায় মাফলার। রোগী এক এক করে তার অসুবিধাগুলো বলছিলেন।
ডাক্তারবাবু তার ভেতর থেকে কয়েকটা কথা প্রেসক্রিপশনের বা দিকে লিখে ফেলছিলেন। স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে তিনি রোগীর বুক পিঠ পরীক্ষা করলেন। ডাক্তারবাবু হেসে বললেন – আপনি এত চিন্তিত কেনো ? এইটুকু জ্বরে এত চিন্তা করলে চলবে?
ডাক্তারবাবুর কথা শুনে রোগী এবং তার বাড়ীর লোকের মুখে একটা স্বস্তির ছবি ফুটে উঠলো। মাঝে মাঝেই একটা বেখাপ্পা কাশি হচ্ছিলো রোগীর। মুখে রুমাল দিয়ে কোনও ভাবে সামলাচ্ছিলেন।
ডাক্তারবাবু এবারে আবার প্রেসক্রিপসন হাতে তুলে নিলেন। রোগীর নাম বয়স জিজ্ঞাসা করলেন। রোগীর নাম শুনে এবং মুখ দেখে কেমন যেন পরিচিত মনে হলো ডাক্তারবাবুর। একটু থমকে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন।
- আপনি কি করেন ?
- আমার পত্রিকার ব্যাবসা। একটি ছোট বইয়ের দোকান আচ্ছে সুভাষনগরে।
ডাক্তার অভীক বসু প্রেস্ক্রিপসন লিখে ফেললেন। একটা অস্পস্ট মুখ তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
ডাক্তার বসু বছর খানেক হলো এম ডি করেছেন। শহরের তিন জায়গায় তিনি প্র্যাক্টিস করেন। ডাক্তারির ব্যাপারে বেশ সুনাম হয়েছে। ধীরে ধীরে প্র্যাক্টিস জমছে। তাদের বাড়ীও এ শহরেই। অনেকদিন শহরের বাইরে থাকায় নতুনদের সাথে পরিচয় কম।
পুরোনো মানুষেরা অনেকেই চেনেন ডাঃ বসুকে। অনেকে ডাক নামেই ডাকেন। তার বেশ কিছু বন্ধু বান্ধবও রয়েছে শহরে। বেশ মজার সাথেই প্র্যাকটিস করছেন। বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতদের তিন চারটে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আছে। সেখানে সপ্তাহে একদিন সময় দেন তিনি। বাড়িতে বাবা, মা আর দাদা। এক বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলের সাফল্যে খুশী বাবা, মা এবং পরিচিত জনেরা।
ডাঃ বসু রমেশ দাসকে জিজ্ঞাসা করলেন -- আপনি আমাকে চিনতে পারছেন ?
ডাক্তার বাবুর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। কিছুই মনে করতে পারলেন না।
ডা; বসু বললেন। আপনি কি রামকৃষ্ণপল্লীতে কখনও খবরের কাগজ দিতে যেতেন ?
- হ্যাঁ আমি তো এখনও করি মাঝে মাঝে। তবে আমার ছেলেরাই ব্যাবসা দেখে এখন। আমি কখনও কখনও দেখি।
- রামকৃষ্ণপল্লীতে মুখার্জী বাবুদের বাড়িতে ভাড়া ছিলো, বাপ্পা বলে একটি ছেলের কথা মনে আছে আপনার ?
বেশ খানিকক্ষণ স্মৃতি হাতড়ে মাথা নাড়লেন রমেশ দাস।
ছোটবেলায় ডাঃ বসুদের বাড়িতে খবরের কাগজ দিতেন রমেশদা। ছোটদের পত্রিকাগুলি পড়ার ভীষন ইচ্ছা হতো বাপ্পার। কিন্তু বাড়ীতে ছোটদের পত্রিকা মাত্র একখানাই রাখা হতো।
বাপ্পা এবং তার ভাই বোনেদের আবদার ছিলো ছোটদের পত্রিকা দেখতে দেবার। ছবিতে গল্পগুলো পড়ে ফেলবে ওরা। বাটুল দি গ্রেট, হাঁদা ভোদা বা অন্য কিছুর। ফেরার পথে রমেশদা আবার বই নিয়ে চলে যাবেন। মাঝে মাঝেই রমেশদা তাদের এই আবদার রাখতেন। কিন্তু নির্দেশ ছিলো বই এতটুকুও নোংরা করা যাবেনা। ওরা সে নির্দেশ পুরোপুরি মেনে চলতো।
রমেশদা অন্য গলিতে যাবার সময় একটি বই দিয়ে যেতেন। ওরা ভাই বোনেরা আধ ঘন্টার মধ্যে তিন চারটা ছবিতে গল্প পড়ে ফেলতো। রমেশদা আবার ফেরত যাবার সময় বইটা নিয়ে যেতেন।
স্মৃতি হাতড়ে রমেশদা অনেকখানি উদ্ধার করতে পারলেন।
- আমিই সেই বাপ্পা। আপনি যাকে অনেক বই পড়িয়েছিলেন ছোটবেলায়।
ডাক্তারবাবু আরও কিছু খোঁজ খবর নিলেন রমেশদার।
রমেশদা এবং তার স্ত্রীর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। প্রেস্ক্রিপসন নিয়ে রমেশদা উঠে দাঁড়িয়ে ভিজিট দিতে যাচ্ছিলো।
ডাঃ বসু উঠে দাঁড়ালেন। -- তোমাকে ভিজিট দিতে হবে না রমেশদা। ওটা রেখে দাও। পাশে রাখা ওষুধের থেকে কয়েকটা ওষুধ তুলে দিলেন রমেশদার হাতে। খাবারের সময় বলে দিলেন।
-
এই গুলো তুমি নিয়ে যাও রমেশদা। তোমাদের যখন যখন দরকার হবে, চলে আসবে আমার কাছে।
![]() |
বিজ্ঞাপন |
লেখাটি একটি মানবিক দলিল। ডাক্তারবাবুরাও এমন ভাবতে পারেন তা' সমাজকে জানানো ভীষণ প্রয়োজন। লেখককে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ReplyDeleteদেবাশিস ধর দা, অনেক ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মতামত এর জন্য l ভালো থাকবেন l
ReplyDeleteভাল লিখেছিস।
ReplyDeleteধন্যবাদ l ভালো থাকিস l
Deleteভাল লাগল দাদা।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ সুকান্ত l ভালো থেকো l
Delete