গল্প - অর্পিতা রায় চৌধুরী


জামাইষষ্ঠী

  

বাইশ বছর বয়েসে যখন সুচিত্রা দেবী স্বামীকে কর্কট রোগে হারালেন তখন জোজো সবে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। ব্যাংকে জমানো প্রায় সমস্ত অর্থকড়ি শেষ হয়ে গিয়েছিলো স্বামীর চিকিৎসায়। শ্বশুর শাশুড়ি গত হয়েছেন। সুচিত্রার বাবা প্রয়াত আর মায়ের কোনোরকমে দিন চলে ছেলে বউয়ের আশ্রয়ে। শ্বশুর বাড়ি আর বাপের বাড়ির বংশের সেই উপচে পড়া আত্মীয় স্বজনের ভিড় ক্রমশ কর্পূরের মতো উবে গেলো মাস খানেকের মধ্যে। পাড়ার প্রতিবেশী বন্ধু বান্ধব সবাই যেন হঠাৎ করেই ভীষণ রকম ব্যস্ত হয়ে উঠলো। মা আর জোজোর অন্ধকার ঘরে কেবল দীর্ঘশ্বাস। অবশেষে পেটের দায়ে হাত থেকে খুলে রাখা সোনার বালা নোয়া বেঁচে ঘরে তুললেন নতুন সদস্য। সেলাই মেশিন।

  

এখন সুচিত্রা দেবীর বয়েস প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই।জামাইষষ্ঠী উপলক্ষে জোজো মায়ের কাছে জামাই সহ আসবে বলে সপ্তাহ খানেক ধরে আয়োজন চলছে। জোজো চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে সুখের দিন দেখেছেন সুচিত্রা। অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে ভাড়া বাড়ি থেকে দু কামরার ফ্ল্যাট। কয়েক বছর হল নিজের সেলাইয়ের দোকান দিয়েছেন।

  

তবে সুচিত্রা দেবীর জামাইষষ্ঠী পালন নিয়ে পরিবার পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে হৈচৈ কান্ড।চারদিকে কৌতুহল অফুরান। একদিন ভাইয়ের বউ ফোন করে জিজ্ঞেস করেই ফেললো,"দিদি তোমার ভাই বললো জোজো আসছে।সে তো খুব ভালো খবর গো। তা ইয়ে মানে জামাইষষ্ঠী করছো শুনলাম,মানে ঠিক....."

  

জোজো আইটি কম্পানি তে চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়েছে বছর সাতেক হল। সেখানেই আগের বছর বিয়ে করেছে একসাহেব কে। ভিডিও কলে সুচিত্রার সাথে প্রায়ই কথা হয় ওদের। বিদেশী হলেও ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে শিখেছে উইলিয়াম। বেশ মজার ছেলে। জোজোর অফিসেই চাকরি করে। খবরটা পেয়ে প্রথমে বেশ একটু হতবাক হয়ে গুরুতর আপত্তি জানিয়েছিলেন সুচিত্রা। তবে শেষে মত দেন বিয়েতে। বাপ হারা জোজোর ভালো থাকাটাই সব থেকে বেশি মূল্যের বলে মনে হয়েছিলো ওর সেদিন।

 

 

আজ দু বছর পর জোজো স্বামী নিয়ে দেশে আসছে মায়ের সাথে দেখা করতে। সুচিত্রা দেবীর সাথে উইলিয়ামের এই প্রথম সামনা সামনি সাক্ষাৎ। আদরের জোজোর ভালোবাসার মানুষ বলে কথা। নিশ্চয়ই কিছু একটা তো ওর মধ্যে দেখেছে জোজো। জোজোর ভালো নাম অনির্বাণ কর্মকার। বাড়িতে সবাই ওকে আদর করে জোজো বলে ডাকে।

  

ছোট থেকেই জোজো পাড়ার বাকি ছেলেদের থেকে ভিন্ন। বাবা গত হওয়ার পর থেকে খুব একটা কারুর সাথে কথা বলত না। পড়াশুনা তে চিরকাল মেধাবী হওয়ায়, সুচিত্রা কে কখনো সেই ব্যাপারে চিন্তা করতে হয়নি। সমস্যা ছিল অন্য জায়গায়। মুখ চোরা ছেলেটি স্কুল টিউশন বাদে সারাদিন কাটাত নিজের ঘরে গল্পের বই পড়ে। কিছুতেই সুচিত্রা ছেলের মনের কথা বুঝতে পারতেন না। অসহায়র মতো একা বসে প্রয়াত স্বামীর কথা ভেবে কাঁদতেন।

  

কলেজে ওঠার পর হঠাৎ জোজো একদিন মা কে জানায় যে তার এক বন্ধু রাত্রে তাদের বাড়িতে থাকবে, পরীক্ষার পড়া করবে একসাথে। অবশেষে ছেলের বন্ধু জুটেছে শুনে মায়ের আর আনন্দের শেষ থাকে না। নিজের হাতে বাজার হাট করে ছেলে আর তার বন্ধুর জন্যে রান্না করেন। সেই রাত্রে দুই ছেলে কে নিয়ে বেশ অনেকক্ষণ ধরে গল্প করতে করতে খাবার খেলেন। জোজো এত মজার মজার কথা বলতে পারে উনি জানেনই না। এত কিছু জানে জোজো? ছেলে কে যেন নতুন করে চিনতে শুরু করলেন সেদিন। বহুদিন পর যেন একটু নিশ্চিন্ত হলেন সুচিত্রা। অভিষেক প্রায়েই আসতো ওদের বাড়ি। সুচিত্রাও অপেক্ষা করে বসে থাকতেন কবে অভী আসবে আর ওরা সবাই মিলে গল্প করবে। বিধবা হওয়ার পর থেকে কথা বলবার মানুষ খুব একটা কেউ ছিল না। অবকাশও ছিল না অহেতুক গল্প করবার।

 

সাত বছর হল জোজো চাকরি সুত্রে বিদেশে। যাওয়ার মাস চারেক আগে বেশ ধুম ধাম করে জলপাইগুড়ির জমিদার বংশের মেয়ের সাথে বিয়ে হয় অভীর। সুচিত্রা লক্ষ করেছিলেন অভীর বিয়ের পর জোজোটা কেমন জানি মন মরা হয়ে থাকে। অনেকবার ছেলে কে বিয়ে করার কথা বলেছেন, কিন্ত সে রাজি হয়নি। চার মাস পর ক্যানাডা চলে যায় ও।

  

দুদিন বাদে উইলিয়াম কে নিয়ে দেশে আসছে জোজো। ঘটা করে জামাইষষ্ঠী করবেন সুচিত্রা দেবী। বিয়েটা তারা ওই দেশেই সেরে নিয়েছে বলে লোক ডেকে খাওয়ানোর সুযোগ হয়নি তার। এবার কোনো ত্রুটি থাকবে না আয়োজনে। নিমন্ত্রিত দের তালিকায় প্রথম নাম লিখেছেন অভিষেক সেনগুপ্ত আর রেশ্মি সেনগুপ্ত।


বিজ্ঞাপন 


Comments