গল্প - সজল কুমার মাইতি



এক সিরিয়াল স্ক্রিপ্ট রাইটারের কাহিনী 

 

দীপ্তদীপ বাবা মায়ের বড় আদরের সন্তান। একমাত্র সন্তান বটে। পড়াশোনায় খুব ভাল নাহলে খুব খারাপ কখনও ছিল না। দীপ্ত আবার কখনও খুব একটা মিশুকে ছিল না। অনেকের মতে কিছুটা ইন্ট্রোভার্ট। কিছুটা উদাসী মনের। প্রকৃতি বিলাসী বটে। ছোটবেলা থেকে কবিতা, গল্প লেখার অভ্যাস তৈরি হয়ে গেছে দীপ্তর। বিভিন্ন সাহিত্য প্রতিযোগিতায় বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে দীপ্তর লেখা। বাবা মায়ের টানাটানির সংসারে দীপ্তর এই সাহিত্য চর্চা যদিও বিলাসিতার সামিল। তা সত্বেও বাবা মা ছেলের এই নেশায় কোনরূপ বাধা হয়ে দাঁড়ান নি। ছেলের ইচ্ছে পূরণে সাধ্যমত প্রয়োজন মেটানোর ব্যাপারে তাদের উৎসাহ বরাবর ছিল। এইসব কারণে ছেলে বাবা মায়ের প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধায় কোনদিন ঘাটতি দেখা যায় নি। নিজের ইচ্ছে সখের বিষয়ে সিরিয়াস থেকে মা বাবার প্রতি যথেষ্ট দায়িত্বশীল থেকেছে। তাদের ইচ্ছা পূরণে কোন অবহেলা করেনি। মফস্বলের কলেজে পড়েও বি পরীক্ষায় প্রথম শ্রেনীতে পাস করেছে। মা বাবার মুখ উজ্জ্বল করেছে। 

দীপ্ত বি তে এত ভাল ফল করা সত্বেও মাষ্টার্স করার দিকে না গিয়ে পুরোপুরি সৃজনশীল কাজের মধ্যে নিজকে নিমজ্জিত করে। কবিতা, গল্প, উপন্যাস লেখায় মগ্ন হয়ে যায়। মা বাবা একদিন রাতের খাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেন " হ্যাঁ বাবু, এবার কি করবি?"

" এম পড়ার ইচ্ছে নাই। আমার লেখালেখিতেই পুরো সময় দিতে চাই।"

" ঠিক আছে বাবা। তোমার যা ইচ্ছে তাই হবে। আমরা তো কখনও ছেলের ইচ্ছেয় বাধা দিই নি।"

" না বাবা। তোমার বয়স হচ্ছে। সংসারের প্রতি আমার তো একটা দায়িত্ব আছে। তোমরা আমার সব শখ আল্লাদ পূরণ কোরেছ। আমার ইচ্ছেতে কখনও বাধা হও নি। আমার কর্তব্যের কথা আমার সব সময়ই মনে থাকে। তার চেষ্টা করছি। আমার লেখাগুলো বই আকারে প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। তাছাড়া আমার লেখা বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশের চেষ্টা করছি। এগুলো হলে কিছু টাকা আসবে আশা করছি। তখন সংসারের কিছুটা সুরাহা হবে।"

" বাবা, তোর মন যেমনটি চায় কর। অন্য চিন্তা এত করার দরকার নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভগবানের কৃপায় সব হবে বাবা।"

দীপ্ত কলকাতা রওনা দেয় লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া ক্যারিয়ার গড়ার উদ্দেশ্য নিয়ে। কিছু দিনের মধ্যে এই সংগ্রামের উত্তাপের আঁচ দীপ্ত অনুভব করতে শুরু করে। বিভিন্ন প্রকাশকদের দোরে ঘুরতে ঘুরতে দীপ্ত কঠিন বাস্তবের কিছুটা আন্দাজ পায়। দিন থেকে সপ্তাহ। সপ্তাহ থেকে মাস। মাস থেকে বছর কেটে যায়। কেউ আশার বানী শোনায় না। দিন কে দিন হতাশার দোরগোড়ায় পৌঁছতে থাকে। হতাশাগ্রস্ত দীপ্ত পরাজিত সৈনিকের মতো মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়ার। কলকাতায় থাকা খাওয়ার সংস্থান কিছু নেই। এই অবস্থায় এক অবাঙালি প্রযোজক নরোত্তম ধানুকার সঙ্গে পরিচয় হয় দীপ্তর। দীপ্তর কিছু লেখা ধানুকা সাহেব দেখেন। বলেন " দীপ্তবাবু, আপনার লেখার হাতটা কিন্তু যথেষ্ট ভাল। তবে বাস্তব হল কপাল না খুললে এই দিয়ে পেট চালানো সত্যিই কঠিন। তবে আমি আপনাকে একটা উপায় বাৎলে দিতে পারি। আপনি ঠিক করুন সে পথ মেনে নেবেন কিনা?" 

"কি বলুন?"

"টিভিতে যে সকল সিরিয়াল হয় তার স্ক্রিপ্ট লিখতে পারবেন? আমি যতটুকু বুঝেছি আপনার লেখায় একটা সাবলীল ভাব আছে। আপনি চেষ্টা করলে পারবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।"

এই কথা শুনে দীপ্ত কিছুক্ষন চুপ করে থাকে। দীপ্তকে চুপ করে থাকতে দেখে ধানুকা সাহেব বলে ওঠেন " দীপ্তবাবু, কি এত ভাবছেন? লাইফে দাঁড়াতে গেলে একটু আধটু কম্প্রোমাইজ করতে হয়। রাস্তা নোংরা বলে আপনি হাঁটা ছেড়ে দেবেন? পায়ে নোংরা লাগলে পরে ধুয়ে  সাফ করে নেবেন।"

ধানুকার এই টনিকে মনে হল কাজ হয়েছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপ্ত বলে " অগত্যা আর কিই বা করার আছে? আগে তো পেটের যোগান, পরে মান সম্মান। কিন্তু, এই দায়িত্বই বা কে দেবে?"

" সে ব্যবস্থা না হয় দু একটা কেসে আমি করে দিতে পারি। মাঠে নেমে তো দেখুন?"

অগত্যা দীপ্তর জীবন একটি প্রাগমেটিক মোড়ে এসে ধাক্কা খেয়ে তার পথ পরিবর্তন করে। নিজের মন বিবেকের সঙ্গে তীব্র লড়াই করে অবশেষে মনস্থির করে স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য। 

সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখায় দীপ্তর হাতেখড়ি হল ধানুকা সাহেবের জনপ্রিয় চ্যানেলে একটি নতুন সিরিয়ালের মধ্য দিয়ে।

সিরিয়ালের নাম 'করুনাসিন্ধু মা দয়াময়ী' কিছুটা ঐতিহাসিক কিছুটা আধিপৌরানিক বিষয় মিশিয়ে সম্পূর্ণ কাল্পনিক কাহিনী। কাহিনী শুরুর অনেক দিন আগে থেকেই চ্যানেলে রিপিট বিজ্ঞাপন চলছে। প্রতিটি চালু সিরিয়ালের মাঝে মাঝে সেই বিজ্ঞাপনের লড়াই নিরন্তর চলছে। ভাল বাজেটের সিরিয়াল, তার প্রচারে তেমনি জাঁকজমক। কম করে পাঁচ দিনের টেলিকাস্ট রেডি রাখা দরকার। অতএব দীপ্তর ওপর দায়িত্ব বর্তেছে ওই কয়েকটি টেলিকাস্টের স্ক্রিপ্ট লেখার। 

যেহেতু সিরিয়ালের ভিত্তি ঐতিহাসিক আধিপৌরানিক, দীপ্ত যথেষ্ট পড়াশোনা করে এপিসোডগুলোর স্ক্রিপ্ট যত্ন করে লেখে। কাল্পনিক দিকের চেয়ে ঐতিহাসিক তথ্যের ওপর ভর করেই লেখা। ধানুকা সাহেবের পছন্দ হয়। প্রথম কয়েকটি এপিসোড টেলিকাস্ট হওয়ার পর সিরিয়ারলের টিআরপি সাংঘাতিকভাবে উর্ধ্বগামী। অব্দি কোন সিরিয়ালই এই উচ্চতায় উঠতে পারে নি। সর্বকালীন রেকর্ড। সবাই খুশী। প্রোডিউসার খুশী, ডিরেক্টর খুশী, চ্যানেল কর্তৃপক্ষ খুশী। এখন এই সিরিয়াল চ্যানেলের প্রাইম টাইমে দেখানো হচ্ছে। বিজ্ঞাপনদাতার ভিড় লেগে গেছে। বিজ্ঞাপনের রেট উর্ধ্বগামী। গমগমিয়ে চলছে সিরিয়াল 'করুনাসিন্ধু মা দয়াময়ী' বালক বৃদ্ধ নারী পুরুষের মধ্যে যেন উদ্দীপনার আবেশ। দীপ্তর চোখে খুশীর ঝিলিক। মা বাবা এই খবরে যারপরনাই  আনন্দে আত্মহারা। সন্তানের সাফল্যে গর্বে মাতা পিতা গৌরবান্বিত। কিন্তু সমস্যা হল এখন আর ছেলের দেখা মেলা ভার। কারন, ছেলে এখন ভীষন ব্যস্ত। একটার পর একটা এপিসোড লেখা নিয়ে ব্যস্ততার সঙ্গে জুড়েছে নতুন নতুন সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখার প্রস্তাব।

দীপ্ত এতদিন পড়াশোনা করে পূর্ন স্বাধীনভাবে স্ক্রিপ্ট লিখছিল। একদিন ধানুকা সাহেব দীপ্তকে ডেকে বললেন " দীপ্তবাবু, আপনার লেখাকে পুরো সম্মান জানাই। আপনার লেখার কৃতিত্বে সিরিয়াল আজ এই জনপ্রিয়তায় পৌঁচেছে। কিন্তু, বোঝেন তো ! আজকালকার দর্শক ভাল জিনিস দেখতে দেখতে অনেক সময় বোর ফিল করে। সেই জন্য মাঝেমধ্যে একটু বৈচিত্র্য দরকার হয়। ওই মানে একটু আধটু মশলা দিতে হয়। ওই ধরুন, একটু আধটু গান। একটু আধটু আধিভৌতিক ব্যাপার। এই গুলি একটু ভেবে দেখুন। মনে করলে এগুলো একটু যোগ করতে পারেন।" দীপ্ত নির্বাক হয়ে বেশ কিছুক্ষন বসে থাকে। ভাবতে থাকে কি করা উচিত। মনে মনে ভাবে ' পড়েছ যবনের হাতে খানা খেতে হবে সাথে' 

" ঠিক আছে। আপনারা যা চাইছেন, তাই হবে। দেখা যাক পাবলিক কতটা খায়।"

এর পর বেশ কিছু  এপিসোড চলল। টিআরপি তে বৃদ্ধি না হলেও পতন তেমন নজরে এল না। দীপ্ত কিছু ভক্তিমূলক গান সিরিয়ালের মধ্যে জুড়ে দেয়। এটা আবার খুব পছন্দসই হল প্রযোজকের। কিছু গান সিরিয়ালের মধ্যে জুড়ে দিল দীপ্ত। ভক্তিমূলক গানে দর্শককূল একেবারেই কুপোকাত। এক ধাক্কায় টিআরপি অনেকটা বেড়ে গেল। প্রযোজক বেজায় খুশী। আরও কয়েকটি সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখার দায়িত্ব জুটে যায় দীপ্তর কপালে। নতুন উদ্যমে এই সিরিয়ালে দীপ্ত কিছু আধিভৌতিক আধিদৈবিক ঘটনা যোগ করে দেয়। এর ফলে মৃত ব্যক্তদৈববলে বেঁচে ওঠে। আবার প্রচণ্ড ঝড়ে নৌকা রক্ষা পেয়ে যায়। দর্শকদের মনের ইচ্ছে যেন এই ঘটনাগুলির মাধ্যমে রিফ্লেক্টেড হয়। দর্শক বিশেষ করে বয়স্ক দর্শকদের মধ্যে দেব বিশ্বাস আরও পোক্ত হয়ে ওঠে। বয়স্ক মহিলা দর্শকদের হাত জোড় করে প্রনাম করতে দেখা গেছে। এর প্রভাবে সিরিয়াল তরতরিয়ে চলতে থাকে। শেষ হওয়ার নামই নেই। 

এর মধ্যে নতুন সিরিয়ালের কাজ শুরু করে দেয় দীপ্ত। এই সিরিয়ালের মধ্যমনি গাঁয়ের দরিদ্র পরিবারের কৃষ্ণভক্ত গানপাগল এক মেয়ে। একে দারিদ্র্য তার ওপরে মেয়ের গায়ের রঙ কালো। সেই মেয়ের বিয়ের জন্য মা বাবার চিন্তার শেষ নাই। কালো মেয়ের বর তো আর জোটে না। স্ক্রিপ্টরাইটারের সৃজনশীল কলমের খোঁচায় এক ধনীর ছেলের বিবাহ বিভ্রাট ঘটে এই কৃষ্ণবর্ণ মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হয়ে যায়। তারপর একটার পর একটা 'কাহিনী মে টুইস্ট' চলতে থাকে। আর সিরিয়ালের টিআরপি এক্কেবারে উচ্চতার চরম শিখরে। স্ক্রিপ্টরাইটার দীপ্তর জনপ্রিয়তা গগনচুম্বী। নায়িকার একাধিক অকাল মৃত্যুর পরেও জীবন্ত হয়ে ফিরে আসা। এক সহজ সরল ছেলে হঠাৎ করে জাত ক্রিমিনালে পরিনত হয়ে নিজের বাবা মা ভাইদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে ওঠে। খুন রাহাজানি যেন তার 'বাঁ হাত কা খেল' দর্শকবৃন্দ যেন যা দেওয়া হবে তাই গেলার জন্য তৈরি। অলীক গাঁজাখুরী বিষয়েও তাদের যেন কোন আপত্তি নেই।

একের পর এক সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লিখে দীপ্ত আজ বাড়ি গাড়ির মালিক। অভিজাত এলাকায় বিলাসবহুল বাংলো বাড়ি। বাড়িতে একাধিক কর্মচারি। আধুনিক জীবনযাপনের কোন গ্যাজেটের খামতি নেই। আতিশয্যের চরম শিখরে আজ স্ক্রিপ্টরাইটার দীপ্ত। সাফল্য আজ তার হাতের মুঠোয়। প্রযোজকদের লাইন লেগে যায় দীপ্তকে স্ক্রিপ্টরাইটার হিসেবে পাওয়ার জন্য। যার সৃজনশীল কলমের জোরে আজগুবি কাহিনি দর্শকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মনকল্পিত ঘটনা দর্শকদের মনোরঞ্জনের সেই চাবিকাঠির একমাত্র অধিকারী স্ক্রিপ্টরাইটার সম্রাট শ্রীমান দীপ্ত। সেই দীপ্তের মনে হঠাৎ বিবেকের দংশন শুরু হল। প্রতিমুহূর্ত এই দংশন দীপ্তের হৃদয় কুরে কুরে খেতে লাগল। নিজের সঙ্গে নিজের লড়াইয়ে দীপ্ত যেন হেরে যাচ্ছিল। নাম যশ অর্থের কাছে বিবেক যেন বিক্রি হয়ে যাচ্ছিল। নিজেকে বড্ড ঠগবাজ মনে হচ্ছিল। দর্শকদের ঠকিয়ে অর্থ প্রতিপত্তি নিজের কাছে বোঝা মনে হচ্ছিল দীপ্তর। মনের শান্তি হারিয়ে যাচ্ছিল। আগে অর্থের অভাব ছিল। প্রতিপত্তি ছিল না। তবুও শান্তি ছিল, মনে সুখ ছিল। আজ দীপ্ত যেন  সেই হারিয়ে যাওয়া সুখ শান্তির খোঁজে সব ছেড়ে অজানা সুখের উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। অর্থ পার্থিব সুখ দিতে পারে কিন্তু মনের সুখ শান্তি কোথায় পাবে?

Comments