অনুগল্প - শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত নিয়োগী

অপত্য

এবারেও হেরে গেল সুচেতা। এই নিয়ে তিনবার। IVF এর ফোর্থ স্টেজ এসে  স্বপ্নটা আবার ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। কাউন্সিলিং করাতে  একমাস পরে ডঃ মুখার্জির কাছে যেতে হবে। ততদিন বেড রেস্ট আর মনের সমুদ্রে তোলপাড়। আবেশের মুখটাও তাকে ভীষণ ভাবে কষ্ট দেয়, সুচেতা বোঝে হাসি দিয়ে আবেশ আড়াল করে ওর না পাওয়ার যন্ত্রণাটাকে। হা-হুতাশে একটা মাস পার করে, নিজেকে আবার কর্মব্যস্ত জীবনে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি নিল।



স্কুলে জয়েন করার জন্য গাড়ি থেকে নেমে ধীর পায়ে স্টাফ রুমে গিয়ে বসল সুচেতা।স্টাফরুমটা এখনো ফাঁকা, একটু পরেই সহানুভূতিতে আরও দমবন্ধ লাগবে ওর। নরেনদা মাত্র দরজা খুলছে আর একটি-দুটি করে ছেলে মেয়ে গুটি গুটি পায়ে স্কুলে ঢুকছে। দুর্বলতাটা আছে, কপালে বিন্দু ঘাম জমেছে। ফ্যানটা চালিয়ে, বোতল খুলে কয়েক ঢোক জল খেয়ে সামনে তাকিয়েই দেখে, ফোকলা দাঁতের মাড়ি বের করে টাটকা সাদা একটা গোলাপ আর কোঁচড় ভর্তি করে পেয়ারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রিনি-- "তোমার জন্য খুব মন খারাপ লাগতাছিল দিদিমুণি, বড় মাষ্টারকে একদিন জিগাইলাম, বলছে তুমি আজ আসবা, তাই তোমার লাইগ্যা আনছি। তোমার শরীল খারাপ, মা কইছে। কি হইছিল গো?" ----একশ্বাসে বলে গেল মেয়েটা।



গলায় চাপা কান্নার দলা পাকাল, চোখের কোনায় জল। কি উত্তর দেবে!! বুঝবেইনা তো একরত্তি মেয়েটা। আবার সরু সুরে রিনি বলতে লাগল -"এবার তোমারে কবিরাজের কাছে নিয়া যামু, তোমার সব অসুখ সাইর্যা যাইব। তুমি না আইলে আমার মন খারাপ লাগে গো, কষ্ট হয়। আমার কেলাসের সবারই কষ্ট হয় গো। তোমার অসুখ হইছে জানলে আমার আরও কষ্ট হয়। সেদিন মা'রে নিয়া বড়বাবার মন্দিরে বাতাসা দিয়া আসছি, কইছি--দিদিমুণির সব অসুখ সারাইয়া দাও বাবা।"



একমুহূর্তে চাপা কান্নাটা সরে গিয়ে মনের আকাশে হাসি খেলে গেল। দিনের পর দিন এতগুলো টাকা খরচ হয়েছে ট্রিটমেন্ট এর জন্য, মরীচিকার পিছনে বৃথাই ছুটেছে সুচেতা আর আবেশ। অপত্য স্নেহের ভান্ডার তো তার সামনে এসেই আজ ধরা দিয়েছে। গর্ভই কি সব! নিষ্পাপ ভালোবাসা দিয়েই তো গড়ে ওঠে সন্তান সুখ--আজ মর্মে মর্মে  বুঝেছে।  দুহাতে বুকে টেনে, জড়িয়ে ধরে আদর করতে থাকে রিনিকে। মুহূর্তে ঠিক করে ফেলে স্বপ্নে গড়া সব স্নেহ-ভালোবাসায় আজ থেকে ভরিয়ে দেবে রিণিকে। আজ যে ওর কোলে জন্ম নিল অপত্য - সুখ - ভালোবাসা, ----পূর্ণ হল সুচেতা।

Comments

Post a Comment