বই কথা - সুব্রত ভট্টাচার্য


পাঠ প্রতিক্রিয়া


আসামে নাগরিকত্ব হরণের দহনলিপি



লেখক- কমল চক্রবর্তী,
প্রকাশক- কথা বিকল্প পরিবার, 
শিলচর- ৭৮৮০০১
পৃষ্ঠা – ১৯৬, মূল্য ১০০ টাকা


এন আর সি, ডি ভোটার,  ডিটেনশন ক্যাম্প  এর নামে অসমে বাংলাভাষী  মানুষের ওপর যে নির্যাতন, হয়রানি চলছে তা আমরা কিছু কিছু পত্রপত্রিকাতে পেয়ে থাকি। খুব কম সংবাদই জাতীয় সংবাদ পত্রগুলিতে প্রকাশ হয়। সামাজিক মাধ্যমেও অনেক মানুষের খবর আসছে। অসমে ২০১৬ সালে নতুন সরকার আসবার পর  এই হয়রানি আরও ভয়ঙ্কর আকার ধারন করেছে। কিছু বাংলা সংবাদপত্রে এসব খবর ছেপেছে কিন্তু অন্যান্য সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে খুব কম।


অসমের শিলচরবাসী সমাজকর্মী কমল চক্রবর্তী, বেশ কয়েক বছর হলো বিভিন্ন মানুষকে সাথে নিয়ে এই বিপন্ন মানুষগুলির বিপদে ছুটে বেরাচ্ছেন। ডিটেনশন ক্যাম্প, ট্রাইব্যুনাল অফিস, নির্বাচনী অফিস, কলকাতা, গুয়াহাটী, বরাকের বিভিন্ন শহরে তিনি ছুটে বেরাচ্ছেন তাদের আইনি সহায়তা বা অন্যান্য সহায়তার জন্য।


মানুষগুলির প্রতি সরকারি হয়রানি কতটা নিষ্ঠুর এবং অমানবিক এবং আরও বিভিন্ন ঘটনা তিনি তুলে এনেছেন দুই মলাটের ভেতরে। পড়তে পড়তে বোঝা যায় এই ভারতীয় মানুষগুলির প্রতি সরকারের ব্যাবহার কতটা অমানবিক। একটি দল প্রচার করেন যে তারা হিন্দুদের উন্নতির জন্য কাজ করে চলেছেন অথচ দেখলে বোঝা যাবে নির্যাতিত মানুষগুলির ৭৫ শতাংশই হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাদের একমাত্র অপরাধ তারা গরীব এবং বাংলাভাষী।


১৯৬ পৃষ্ঠার এই বইকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ২২ টি কেস স্টাডি আলাদা ভাবে আলোচনা করা করা হয়েছে। যে মানুষগুলির বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতা অমানবিকতা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তারা হলেন-

১) সুলেখা দাস, ঠালিগ্রাম ২)বানেসা বেগম, উধারবন্দ ৩)চন্দ্রধর দাস,ধলাই ৪)অজিত দাস, আমরা ঘাট ৫)জয়দেব দাস,বদরপুর ৬)সীতা রী, বড়খোলা ৭)দুলাল পাল,ঢেকিয়াজুলি ৮) সুখদেব রী, হাইলাকান্দি ৯)কমরুল হোসেন, উধারবন্দ ১০)মিনারা বেগম, শাহনারা বেগম উধারবন্দ ১১) দুলুবি বিবি, উধারবন্দ ১২)সাধন মালাকার, সুনীল রায়, নুরুল নেসা, ডিমা হাসাও জেলা ১৩)গীতা নমঃশূদ্র, পাথারকান্দি ১৪)মোমিরান নেসা ,গোয়ালপাড়া ১৫) রাশমিনারা বেগম, গোয়ালপাড়া ১৬) আশরাফ আলি, ময়নারানি সিং, নগাও ১৭) নরেশ কোচ , গোয়ালপাড়া ১৮)সত্য কুমার দাস, কাছাড় ১৯)সীমা বর্ধন, কাছাড় ২০) সিদ্দেক আলি, ডিমা হাসাও জেলা ২১) আরতি দাস, কাছাড় ২২) রেনু কালিন্দি, কাছাড়।


এই মানুষগুলি সকলেই ডিটেনশন ক্যাম্পে ছিলেন। কয়েকজন এখনও বন্দী আছেন আর কয়েকজন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন । বাকিরা জামিনে মুক্ত, তাদের কেস চলছে বিদেশী ট্রাইবুনালে। এরা সকলেই ভারতীয় কেউ স্থায়ী বাসিন্দা, কেউ জন্মেছেন এই দেশেই, কেউ বা এসেছেন ১৯৬০, ৬১ বা ৬৪ তে। জন্মের প্রমান পত্র নেই, তখন দেবার ব্যাবস্থাও ছিলো না। কারও বা নামে সামান্য বানান ভুল।


কয়েকজনের সময়মতো ট্রাইবুনালে হাজির না হবার জন্য অথবা নথি গ্রাহ্য না হবার জন্য ঠাই হয়েছে ডিটেনশন ক্যাম্পে। বার বার গ্রাম থেকে ট্রাইবুনালে হাজির হবার বা আইনি লড়াই লড়ার আর্থিক ক্ষমতাই নেই অনেক মানুষের। জাতীয়তাবাদী দলগুলির চাপে তারা সরকারি হয়রানির শিকার।


শিলচরে এন আর সি মানুষদের সাহায্যের জন্য পাশে দাঁড়িয়েছিল বেশ কিছু সংস্থা তাদের কথাও উঠে এসেছে আলোচনায়। বিভিন্ন সময়ে লেখক কমল চক্রবর্তীর সাথে যোগাযোগ হয়েছে বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী হর্ষ মান্দার এবং তিস্তা শেতলাবাদের। তাদের কাছে বেশ কিছু নথিপত্র পাঠিয়েছেন। তাদের সাহায্যে কিছু মানুষ মুক্তি পেয়েছেন। CJP র অসম শাখার নেতা জমশের আলি এবং তার সহকর্মীদের নাম উঠে এসেছে যারা সারা বছর অসহায় মানুষগুলির মুক্তির চেষ্টা করে যাচ্ছেন।


ডিটেনশন ক্যাম্পের অমানবিক ব্যাবস্থা এবং চিকিৎসার অপ্রতুলতার কথা আলোচনা হয়েছে। বার বার অভিযোগ করা সত্বেও ব্যাবস্থার বিশেষ উন্নতি হয়নি। ব্যবস্থা দেখতে আসা একদল সমাজসেবীকে আটকে দিয়েছেন রাজ্য সরকার। আমসুর লড়াইয়ের সুফল খানিকটা পেয়েছেন মানুষগুলি।


বিভিন্ন সরকারি নিয়মকানুন নিয়ে লেখক আলোচনা করেছেন যাতে মানুষের সুবিধা হয়। পশ্চিমবঙ্গে মানুষের কিভাবে বিভিন্ন নথি রাখা প্রয়োজন তা নিয়ে আলোচনা করেছেন। কংগ্রেস বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ, বিধায়ক দিলীপ পাল বিভিন্ন সময় নির্যাতিত দের হয়ে কথা বলেছেন এবং পাশে দাঁড়িয়েছেন। অন্যান্য বিধায়ক, সাংসদরা নির্যাতিত দের পক্ষে কিছু বলা থেকে বিরত ছিলেন অথবা খুব কমই বলেছেন।


বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া এই খবরগুলির ব্যাপারে অনেক বুদ্ধিজিবী মৌন। খুব অল্প মানুষই প্রতিবাদ করেছেন। জাতীয়তাবাদীরা চান যে কোনও ভাবে যেন বাংলাভাষীরা হয়রানির শিকার হোন।


ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের চুক্তি ভিত্তিতে নিয়োগ হয় ।অনেক সরকারী সুবিধা তারা পান। বিচারক হিসেবে তাদের অভিজ্ঞতা কম। বেশী বিদেশী প্রমান করতে পারলে তাদের চাকরীর মেয়াদ বৃদ্ধি হয়। অবসর প্রাপ্ত বিচারপতিদের ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ হলে মানুষের সুবিচার পাবার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।


অসমে ২০১১ সালের মার্চ মাসের সরকারি তথ্য অনুযায়ী ১৯৯৬ থেকে ২০১০ এর ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডি ভোটার হিসাবে পাঠানো মামলার সংখ্যা ২,২১,৯৩৬ টি। দীর্ঘ ১৩ বছরে নিস্পত্তি হয়েছে ৮৩,৪৭১ টি মামলা। এর মধ্যে মাত্র ৫৫৭৭ জন বিদেশি প্রমান হয়েছেন। শতকরা হিসেবে ৬.৫ %। বাকী বিপুল সংখ্যক মানুষ হয়রানির শিকার। তারা বছরের পর বছর অপমান, বঞ্চনা এবং গ্লানিময় জীবন কাটাতে বাধ্য হয়েছেন।


অসমে ১৯ লক্ষ মানুষের নাম এন আর সি থেকে বাদ পড়েছে। ১২ লক্ষ মানুষ বাংলাভাষী হিন্দু। এদের অনেকের পরিবার এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা, কারোও পরিবার ৫১, ৬১ তে এসেছেন। তবুও বিভিন্ন কারণে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে। অসমে বিয়ে হওয়া পশ্চিম বঙ্গের অনেক মহিলার নাম এন আর সি তে ওঠেনি অন্য রাজ্যের নথি গ্রাহ্য না করার জন্য। অনেক পরিবারের একজন বা দুজন মানুষের নাম ওঠেনি বিভিন্ন জটিলতার জন্য। তারা জানেন না দেশের মানুষ হয়েও আরও কত বার তাদের পরীক্ষা দিতে হবে।


কেন্দ্রিয় সরকারের ৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৫ সালের নোটিফিকেশনে বলা হয়েছে যে বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ যারা ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৪ পর্যন্ত ভারতে এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব দেবার জন্য। অসম সরকার এ ব্যাপারে নির্যাতিতদের পাঁচটি প্রমানপত্র দিতে বলেছেন। এখন প্রশ্ন দেশভাগের পর প্রানভয়ে পূর্বপাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা ভারতে পালিয়ে আসবার সময় সার্টিফিকেট কার থেকে আনবেন? হামলাকারীদের কাছ থেকে নাকি পূর্বপাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে? সারটিফিকেট কি এখানে প্রাসঙ্গিক? নাকি ন্যায় পাবার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করে রাখা? আদালতেই এই সমস্যার সমাধান হবে আশা করা যায়। যে কোনও নথি অথবা স্বীকারোক্তি এখানে মেনে নেওয়া প্রয়োজন। অভিজ্ঞ মানুষের বলছেন সি এ এ তে ও মানুষকে এভাবে বঞ্চিত করা হবে।


পশ্চিমবঙ্গেও কিছু মানুষ এন আর সি চাইছেন। কিন্তু বর্তমান নিয়মে তারাও হয়রানির শিকার হবেন। পুরোনো নথি জোগাড় করতে তাদের বার বার সরকারী অফিসে এবং আইনজীবী দের কাছে ছুটোছুটি করতে হবে। হিন্দু বলে তারা এক্ষেত্রে আলাদা সুবিধা পাবেন না।


লেখক শ্রী চক্রবর্তী বিভিন্ন কেস স্টাডির সাথে কোর্টের অর্ডার, নির্যাতিতর ছবি, বিভিন্ন নথির কপি দিয়েছেন। এতে গুরুত্ব বেড়েছে। এ বই থেকে নতুন প্রজন্মের ছেলে মেয়েরা বিস্তারিত জানতে পারবে এতে নিজের এবং অন্য মানুষের ভীষন সাহায্য হবে।


বইটির প্রচ্ছদ সুন্দর, ছাপা ঝকঝকে, দাম পাঠকের আয়ত্তের মধ্যে। যারা মানবাধিকারে বিশ্বাস করেন, মানুষের পাশে দাঁড়াতে চান, এন আর সি র নিয়ম কানুন জানতে চান তাদের এই বই সংগ্রহে রাখা বিশেষ জরুরী। সংগৃহীত মুল্য লেখক ব্যায় করছেন নির্যাতিত মানুষগুলির পুনর্বাসনের জন্য।



যোগাযোগের ঠিকানা – কমল চক্রবর্তী, স্পন্দন এপার্টমেন্ট, ফ্ল্যাট নং সি টু, কুরমী বাংলো রোড, অম্বিকাপট্টি, শিলচর-৭৮৮ ০০৪। কাছাড়, আসাম। ফোন নং – ৬০০১৩ ৯৬২০৮, ৯৪৩৫০ ৭৩৯৩৬। ইমেল - kamalchakraborty.70 @gmail.com.
প্রকাশক- ৯০৮৫৫ ৭৪৬৫৯ ।

Comments

  1. "কথা লহরী" সাহিত্য পত্রিকা গোষ্ঠী কে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা। আমার প্রথম প্রকাশিত বই নিয়ে আলোচনা করার জন্য।

    ReplyDelete

Post a Comment