লকগেট
"হামার একটা নদী আছিলো...এমুন নদী। তুরতুর করে সেমন নদী। নাই ...নদী নাই... সে বাউদিয়া হইলো.."
"কী কস্, কী কস্ ফজি!!"
ফজিরণের সামনে খোলা বই, রঙীন পাতা আর পাতাজোড়া একখানা আস্ত নদী। বাচ্চাটাকে দেখার জন্য জিনি দিদি রাখলো তো ওকে।
"আক্কেল নাই তুর...করস্ কী? আবোদা এক্কেরে..., বাচ্চাটা গেটের দিকে যায় দ্যাহস্ নি! কী কমু তোরে ?"
রান্নার মাসি বিজু এসে য্যান্ ঝাপটা মারে..
ফজিরণ সম্বিত পেয়ে জিভে কামড় দেয়। "ঘুম ধরলো তো এটটু.. তাই তে বুঝির না পাঙ"-- 'হ্ বুঝির না পাঙ' রান্নার মাসি ভেংচে ওঠে। "তয় ধরলু কেনে কামটা...? তোর বাচ্চা দেহার কাজ ট্যাহা বেশি; তা আমারেই সব কয়্যা দিবার নাগে"?
ফজিরণ এসব শোনে না। সে ততক্ষণে ঝাঁপ দিয়ে বাচ্চাটাকে ধরে ফেলেছে.. "অয় অয় মোর মাঠা নাকি রে.. খেলিম্ খেলিম্.. আয় কেনে মোর ঠে"।
দুবছরেরর বাচ্চাটা খিলখিল হাসে, যেন্ কূলকূল কূলকূল নদী। ফজিরণের পয়তিরিশ বছর বয়সটা তখন কেমন যেন উনিশ কুড়িতে এসে ঠেকে। সাঁঝ বিয়ালে তবে ফেরে জিনি দিদি। তখন ব্যাগ গোছায় ফজি--
"খাবার নিবি না?"
"নাহ্, বাপটো কালি বাজার কইল্...।"
"তা রাঁধলো কে?"
"কে আঁধিবে? মুই যাঙ আগত, তবে স্যান্... সক্কালে আঁধার থাকইতে উঠলুঙ... বাপটাক্ কছুঙ কুপি ধরাই দিবার... মাটাক উঠায়্যা মাগুর মাছের ঝোল আন্ধিয়াই বাইর হইম... মাটাক উঠাবার গিয়া দেখি বিছানায় মুতি ধুছে...। পোস্কার করি দেখং বেলা হবার ধরইছে..... বাপটাক্ কলুঙ ভাত আঁধি খাও, রাতোত্ আসিয়া আন্ধিব এলায়।"
"তোর মার জ্বরটা এখনো আসছে?"
"না না, এখন না হয় জ্বর দিদি... খালি দুবলা হয়্যা গেছে... আর চখুত্ না দেখিলে মানুষ যেবা হয়-- কোনোমতে ডাকিবার পাইলে এমন না হয়। আন্ধার রাতত দিশা না পায়... মনে করছে বাইরে... তা বিছানায়..."
একটু দাঁড়া ফজি। একটা ওষুধ দেব। আর শোন্ দুটো আপেল নিয়ে যাস। কাল আসিস বাবা তাড়াতাড়ি .. কাল আবার ইনস্পেকসন্ আছে।"
না করঙ.. না করঙ দেরি দি। আসিম্... না আসিলে, কামাই না কইলে খাওয়াত নাই ...ফজি হাত উল্টায়।
"দেখিস বাবা, তোর তো ফোনটোনেরও ব্যাপার নেই। বিজলিমাসিও কাল আগেই চলে যাবে বলে রেখেছে।"
"না করেন চিন্তা.. আসিম্ , আসিম্"।
ঘরে থাকইবার কে চায়? ফজিরণ ঘরে একটুরও থাইকবার চায় না। এই ঘরে কতো আরাম,কী শান্তি! বাচ্চাটাকে নাড়িচাড়ি ফজিরণ খী ভাল্ যে পায় ....। সারাদিন ঐ আন্ধার ঘরে থাকবার মনই না চায় ...
নদী পার হয়ে,তার পাশ দিয়ে ঘরে ফেরে ফজি। নদীর বুকখান খাঁ খাঁ করে, ক্যানে বা! শুকনা, জল নাই নদীর ..ফজির ঢক যেন্। পাশ থাকি আন্ধারে কে যেন্ ডাক পাড়ে "ফজি রে!!" "কে?" ফজির শুকনা বুকখান্ খালি করি একখান্ শ্বাস পড়ে। নদীর মাঝখান দিয়া ভারি বাতাস যায়.... শাঁ শোঁ, শাঁশোঁ বাতাস। আর ফজি ভাবে তখন মনভোলার কথা।
মনভালো মানসিখান্ ঠিক কেমন বুঝির না পায় ফজি। কখন কী কয় না কয় ! তবে একখান কথা মনে মনে স্বীকার হয় ফজি। মনের কথা কওয়া যায়; এমুন একখান মানসি। কইলে মনখান ভাল্ হয়। সেই করি কওয়া যায় যেন্ নিজেরেই কওয়া... মনভোলা শোনে কী শোনে না; বোঝে কী বোঝে না ঠাওর পাওয়া নাযায়!কিন্তুক কইলেই শান্তি। মনভোলা কিছুর না কয়। ফজির মন আবার খালি খালি নাগে-- কেহ কারো না হয়। কেউ নাই,কেউ নাই ফজির। সে একা।
শয়তান মনভোলা মিস্তিরির কাজে নিয়্যা ফাঁকি দিল। হঠঠাত্ করি কাজ ছাড়ি কোনঠে গেলো। কাজ ছাড়া ফজির চলে না.. উয়ায় জানে ভাল্ করি.. তবু পুছ করিলে কয় "এখন কুনো কাজ নাই।" নিজে অন্য দ্যাশে যায়্যা ভাল্ করি কামাই করি আনে-- বউ ছাওয়া বেটি নিয়্যা মজ্জায় আছে। খালি ফাঁকির কথা কয় 'কাম নাই।' ফজিকে নরম পায়্যা সব মানসি সচায় মিছায় কথা কয়। এই দিকে আরো জ্বালা ..মার ব্যাটাগুলা শয়তান.... বাপ্ মাকে না দ্যাখে।বাপটা বড় ভাল্। মাটো কাণ্দে.. চক্ষুত্ না দ্যাখে। ফজি দূরে কামাই করির যাবার না পায়.. যাবার পাইলে কবে চলি যাইতো.. মনভোলার থাকি দূরেই যাবার চায় ফজি।
মনভোলা লুক্ ভাল্ না হয়। ফজির কথা কে আর শুনে? নদীর দিকে তাকায়্যা শুকনা চখুত্ পানি আসে ফজির।
বিয়্যা হইছিল কুন্ দূরে। তাতেও সুখ না হয়। স্বামীটা কোটে গেইল্ খবর নাই। সেই আসাম হতি ফিরি আসিয়া কাম কইরবার গেল ফজি,তেই দেখিল মিস্তিরি মনভোলাক্। কেমন যেন্ আউলবাউল মানুষ। থাকি থাকি গান করি উঠে। চুপ করি থাকে।কখনো গল্প করে কতো... সবাই শোনে। ফজির ভালোবাসা হইল। পঞ্চায়েত মানে না সেইসব। ফজির বিয়াও হইছে..তাল্লাক্ হয় নাই। সে তো বেওয়াও না হয়। তার মইধে্র আন্ জাতের ভিতিরে কাম...। কেউ না মানে। মনভোলাকে ধরি নিয়া দূরে গেল ওর বাড়ির নোক। বিয়া দিল। মনভোলা আপত্তি করে নাই। মনভোলার ভাষা নিল ফজি। তার ভাব নিল ভাষা নিল,তবু তার ধর্ম পেল না। ঘর পেল না । কোথায় যে তার ঘর ...কোথা থেকে যে সে আসিল... কুনঠে্ সে যাবার চায়.... ফজি নিজেই বুঝির না পায়! মনভোলা ফিরি আসি ফজির দিকে দ্যাখে ফির কিছুর না কয়। সব ভুলি গেছে নাকি মনভোলা?শয়তানের হাড্ডি ...। শুধু ফজিরণ কিছু ভুলির না পায়। নদীর কাছে যায় ফজিরণ। কথা কয় আপন মনে..খানিক জিরায়...
ডাক আসে ফের ..."ফজিইইই"। কে ডাকায়, ফজি নদীর দিকে যেতে থাকে। শুকনা নদী হঠঠাত্ খলবল খলবল করি উঠে.....। জল আসে, জল আসে হঠঠাত্... যেন্ সব ভাসি নিবার চায়....
আজ নিয়ে চারদিন হলো ছুটি নিয়ে বসে আছে জিনিয়া। ফজির খবর নেই। রান্নার মাসি খবর নিয়ে ফিরেছে ফজি বাড়ি নাই। ফজি আর আসে না। বিজলি মাসি বলে "নদী নদী কইর্যা ভাইস্যা গেলো নাকি? সত্যি গো মন্ বড় কু ডাকে।" শুনে শিউরে ওঠে জিনিয়া।
তবে সে আর বসে থাকতে পারে না। খোঁজখবর করে নতুন লোকের। সদ্য কথা বলতে থাকা তিতি মাঝে মাঝে খোঁজে ' ফপি কই'? স্বপ্ন দেখে, কেঁদে ওঠে । তার চোখের জলের বাণ ডাকে ফজির জন্য।
ট্যুর থেকে ফিরে সমীরণ বলে " ফজির কেস্ শুনলে জিনি?" নাহ্ জায়গাটা খুব গোলমেলে হয়ে যাচ্ছে। এবার ট্রান্সফারের চেষ্টা করতেই হবে...আমি সেই কবে থেকে বলছি.. তুমিই কেয়ার করো না। বড্ড দুশ্চিন্তা হচ্ছে। একেই বাড়ি থেকে এত দূরে থাকা..."
"ফজির কথা কীরকম শুনে এলে শুনি"? অন্যমণস্ক জিনিয়া বলে 'কী শুনলে? মনভোলার কথা তো।!'
"হ্যাঁ। তাই তো শুনলাম।"
"মনভোলাকে চেনো তো তুমি। সেই যে আমাদের পুরোনো কোয়ার্টারে জলের লাইন ঠিক করলো লোকটা...."
"হ্যাঁ হ্যাঁ। লোকটা তো কণ্ঠিধারী ভক্ত গোছের । সে? বাবা ...তলে তলে এতো?"
"তুমি বিশ্বাস করো ফজিরণের এই হারিয়ে যাওয়ায় মনভোলার হাত আছে?"
"অসম্ভব কিছু নয়। হতেই পারে। আর মনভোলাও তো উধাও..."
"না। হতে পারে না। মনভোলার কী স্বার্থ ফজিকে সে সরিয়ে দেবে?"
"আরে, মনভোলার বৌ তো বলছে ফজির মনভোলার সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিল .."
"তা যদি থাকেই, তাহলে কী কেউ এভাবে??.".....
"সব প্রশ্নের উত্তর হয় না জিনি। মানুষের মন কখন কী করে বসে,কিছুই বলা যায় না।"
খটকা জেগে থাকে। রহস্য বয়ে চলে নদীর মতোই। কে সরালো ফজিকে? মনভোলা, তার বউ, পঞ্চায়েত নাকি অন্য কেউ??? কোথাও কী নিজেই চলে গেল ফজি একা একা ? ভেসে গেলো ?
কোনো চিন্তাই ঠিক ফর্মূলাতে চলে না। জীবনে সব সমস্যার সমাধান হয় না। কোথায় যেন গিঁট পড়ে যায়,আর খোলেনা। ফজিরণকে কিছুতেই আর ভুলতে পারে না জিনিয়া।
হয়তো, খুব তাড়াতাড়িই তাকে ফিরে যেতে হবে। নদীও এমনই বইবে। ফজিরণের কথা শুকনো গভীর নদীগর্তে বিলীন হবে একদিন। কখনো নদীর বুকখানা দিয়ে শোঁ শোঁ বাতাস বইলে দুখী ফজির কথা উঠবে গৃহস্থ উঠোনে। কথা বয়ে যাবে লতা পাতা নানা আখ্যান ব্যাখ্যানে।
জিনিয়া সেদিন এখানে থাকবে না। তিতিও হয়তো কিছুটা বড় হয়ে যাবে। সেদিনও নদীর বেডে কাছাকাছি, খুব কাছাকাছি দুই সখীর মতো.. হয়তো নদীকে জড়িয়ে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে থাকবে ফজিরণ। কেউ একদিন হয়তো তাকে আবিষ্কার করবে খুব গভীরে গিয়ে....; হয়তো সেদিন হঠাৎ বাণ ডাকবে নদীতে... কিংবা সেদিন মৎস্যকন্যার মতো হয়তো নিজেই ভেসে উঠবে ফজিরণ, বলবে "ডাকাইছিলেন?"
কে দেখতে পাবে তখন তাকে?.. মনভোলাই শুধু নাকি আরও কেউ কেউ?
Comments
Post a Comment