নবীন কলমের কথামালা : : অণুগল্প - অমৃত বক্সী


গল্প বলা কাকু


কুমার। মাঝবয়সী ভদ্রলোক। একেবারে পরিবারপ্রাণ মানুষ বলতে যা বোঝায়। তার নম্র স্বভাবে পাড়া-প্রতিবেশীরা মুগ্ধ। অত্যন্ত সৎ এবং সহায়ক মানুষ। জীবন সুন্দর ছন্দেই চলছিল পরিবারকে নিয়ে।  পরিবার মানে নয় বছরের ছেলে আর স্ত্রী। দিনের যাওয়া-আসার ছন্দের মাঝে এক রবিবার সবাই হৈ হৈ করে গাড়িতে বেরিয়ে গেল ঘুরতে।  ফেরার পথে এলো সেই মুহূর্তটা। দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনা কেড়ে নিল তার ছেলেকে।  গাড়ির এয়ার ব্যাগ বাঁচিয়ে দিল কুমারকে। হাসপাতলে জ্ঞান ফেরার পর শুরু হলো এক অন্য জীবন। এই জীবনে অসহায় কুমার একা - একদম একা। জীবনটা সেই এক রবিবারই থেমে গেল। চার বছর ধরে শুধু এগিয়ে গেল সময়। পাড়া-প্রতিবেশীরা বারবার বোঝালো নতুন জীবন, নতুন সংসার শুরুর কথা। কিন্তু শুনতে চাইতনা কুমার সেসব কথা। কাজের ব্যস্ততায় নিজের দুঃখ ভোলা শুধু এখন ওর কাছে চ্যালেঞ্জ। একদিন ফেরার পথে পথ আটকে দিল বৃষ্টি। নিরিবিলি পথের ধারে একটা বন্ধ দোকানের বারান্দায় আশ্রয় নিল কুমার। বাদেও সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল আগে থেকেই একটা ছোট্ট ছেলে। ছেঁড়া গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট। ছেলেটার মুখে একটা অদ্ভুত মায়া। এদিকে বৃষ্টি থামার নামগন্ধ নেই।  ছেলেটার সাথে একটু গল্প জুড়ে দিলো কুমার। মনমরা ছেলেটা একটু একটু করে আগ্রহ দেখালো। সেই আগ্রহ দেখে দেখে কুমার ঠিক করল যে ওকে একটা গল্প শোনাবে।  এতে দুজনেরই সময়টা কেটে যাবে। গল্প শুরু হলো, গল্প শেষ হলো। গল্প শেষে কুমার দেখল যে ছেলেটার মুখে হাসি ফুটে উঠল। মুক্তার মতো দাঁতে একদম খিলখিলিয়ে হাসি। এই হাসিটা কুমারকে চার বছর পর প্রথম একটা তৃপ্তি দিল। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমেছে বাইরে। ব্যাগ থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট বের করে দিল ছেলেটার হাতে।  কুমার সেখান থেকে বেরিয়ে এলো। সঙ্গে নিজের বুক ভর্তি করে নিয়ে এলো ছেলেটার নিষ্পাপ হাসিটা। রাতে ঘুমের আগের সময়টুকুতে কুমার শুধু ভাবছিল ছেলেটারই কথা।

 

একটা বছর পার হয়ে গেল। এই একবছর পরের কুমারের নতুন একটা পরিচয় জুটে গেছে। এখন ওর নতুন নাম 'গল্প বলা কাকু' সব বাচ্চাদের কুমার এখন নানান ধরনের গল্প শোনায় আর ছোট্ট ছোট্ট উপহার দেয়। সব বাচ্চাদের হাসিমুখের মধ্যে নিজের সেই ছোট্ট ছেলেটার হাসি মুখটা খুঁজে পেয়েছে। জীবন যেন যা কেড়ে নিয়েছিল, তার চাইতে অনেক অনেক বেশি ফেরত দিয়ে দিল ওকে।

Comments