গদ্য - অর্ঘ্য দে


সপ্তপর্ণার ছায়া ও এক হেমন্ত সন্ধ্যা 

  
    
ছাতিম গাছটার কাছে এলে মনে হয় ওর শান্ত ছায়ায় হারিয়ে যাই। সপে দিই নিজেকে। গাছটাকে যেন আমার আত্মার পরমাত্মীয়। সেদিন শেষ বিকেলের আলোয় গাছটার পাশ দিয়ে টোটোয় আসতে আসতে এক অমোঘ টান অনুভব করেছিলাম। সেই অপ্রতিরোধ্য টানেই ছুটে এলাম আবার। সামনেই পূর্ণিমা, সন্ধ্যায় উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় গাছটাকে আরও মায়াবী মনে হচ্ছে। তবে এই ছায়ায় নেই কোনও শঠতা, নেই কোনও ছলনা।  
      

গ্রামের বয়স্ক মুরব্বি নীলমণির বলেছিল একবার নিতাই ডিম বিক্রি করতে হাটে যাচ্ছিল, ভোর হয়ে এসেছিল। ছাতিমগাছের পাশ দিয়ে আসার সময় তার নাকি বেঘোরে প্রাণ হারায়। কোনওদিন সে ওই পথে যায় না, সেদিন গেছল। আসলে নিয়তি! ওই শয়তানের ছায়া যখন কাউকে ডাকবে, তখন আর তাকে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তবে মৌয়ের কাকার মতো মৌও অবশ্য এইসব আষাঢ়ে গপ্পে বিশ্বাসী নয়। ওদের কথায় গাঁয়ের মানুষ যুক্তি-তক্কর থেকে অলৌকিক কিংবা অন্ধবিশ্বাসকেই প্রাধান্য দেয় বেশি।
      

ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। মাথার ওপর ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ উড়ে যাচ্ছে। চাঁদের আলো মেঘের গায়ে ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে একটা উজ্জ্বল তারা ঢুকে গেল মেঘের পকেটে। এখন হেমন্তকাল। ছাতিম গাছে সবে ফুল ফুটছে। তাতেই অপূর্ব মিষ্টি গন্ধে চারপাশ ম-ম করছে। জায়গাটার একটা অলৌকিক টান আছে। অনেকটা চৌম্বকক্ষেত্রের মতো। মৌকে মনের কথা বলার মতো এমন জায়গা পৃথিবীতে আর নেই। সারা রাত এখানেই বাসর জাগা যায়। বুকের ভিতর হারিয়ে যাওয়া গান বেরিয়ে আসবে অনভিপ্রেতভাবে। একসাথে সারাটা জীবন এই ছায়ায় স্বেচ্ছানির্বাসনে কাটিয়ে দেয়া কি যায় না? নাই বা হলো সংসার, দাম্পত্যকাল। মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার স্নায়ুর যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত মন। লোক-লৌকিকতার খাতিরে তাকে লালন করে চলা। বোঝানো যায় না ক্ষতর গভীরতা, দেখানো যায় না চোরা রক্তক্ষরণ। সিলেবাসর মতো একটা সম্পর্ককে অভ্যাস মতো আমরা বয়ে চলি। মন তো পাখির মতন। বিয়ে তো এক শেকল, তার পায়ের বেড়ি — গালিব!
       

চারদিকে জানাকি উড়ছে, গাছটার গায়ে যেন আলোর জরি বুনে দিচ্ছে। বিকেলে একটা উদ্ভট পাগলাটে লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে নাকি এই শয়তান গাছের ছায়ায় বন্দী। এই ছায়া নাকি তাকে বেঁধে রেখেছে। খুব শান্ত, নির্লিপ্তভাবে কথাগুলো বলেছিল। লোকের মুখে শুনলাম রাতে অবশ্য তার দেখা পাওয়া যায় না। কথাটা সত্যি এই মুহূর্তে লোকটা কোথাও নেই। আমার মনের জানালাটা এতক্ষণ পুরোটা না হলেও আংশিক খোলা ছিল। এবার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেল। চারপাশ কেমন যেন আরও অন্ধকার, কালো হয়ে এল। হঠাৎ আমার শীত শীত করতে লাগল। বুঝতে পারলাম বেখেয়ালে ছাতিমাগছের তলায় ছায়ার মধ্যে এসে পড়েছি। দিঘল সেই ছায়া, যার তল নেই। আমি এমন অতলস্পর্শী ছায়ায় ডুবে যেতেই চাই। কোথা থেকে যেন কিছু বাচ্চা ছেলে জুটে গেল। তাদের হাতে স্বচ্ছ পলিপ্যাকেট। জোনাকি ধরতে তারা মশগুল। হইহট্টগোলে জায়গাটার অখণ্ড নিরবতা নিমেষে খান খান হয়ে গেল। আমার উপস্থিতি তারা যেন খেয়ালই করছে না। মনে পড়ে গেল একটা সময় আমিও মামারবাড়িতে কখনও কখনও সন্ধ্যাবেলায় দলবলে জোনাকি ধরতে বেরতাম। একটা সময় ছেলেদের দল কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। জায়গাটা আবার আপনা থেকেই শান্ত হয়ে এল। আমার সমস্ত শরীর জুড়ে ঘন মসি ছায়ার স্নিগ্ধতা, শীতলতা। যুক্তি-তর্কের মতো বৌদ্ধিক বিশ্লেষণকে নাকচ করে স্বেচ্ছায় ক্রমশ আটকে যাচ্ছি অদৃশ্য ছায়ার গরাদে। মুক্তি আমার কাছে যেন এক বন্ধন, জন্ম জন্মের অভিশাপ। তার চেয়ে ঢের ভালো এই স্বেচ্ছাবন্দী।

Comments

  1. সুন্দর গদ্য। অভিনন্দন জানাই ‌

    ReplyDelete

Post a Comment