পিকনিক
- ১ -
জায়গাটা ভীষণ চেনা চেনা লাগছে ব্রততীর।
ভীষণ...৷ কেন যেন মনে হচ্ছে এখানে আগেও এসেছে সে৷ এই জায়গার সাথে তার কিছু একটা সুখ-স্মৃতি যেন জড়িয়ে আছে৷ কিন্তু কিছু মনে করতে পারছে না৷ আসলে স্মৃতিশক্তির আর দোষ কি! কতরকম রোগভোগে জেরবার হয়ে আছে সে গত কয়েক বছর ধরে। এই সত্তর পেরিয়ে যাওয়া বয়সে যে এমনভাবে পিকনিকে আসতে পারবে সেটাই তো আশ্চর্যের৷
তবু 'শেষবেলা' -এর উদ্যোগে কতগুলো বেলা শেষের মানুষের মুখে কিঞ্চিৎ হাসি এসেছে৷
'শেষবেলা', শহরের একেবারে প্রান্তিকে অবস্থিত ছিমছাম একটি বৃদ্ধাবাস৷ জনা ত্রিশ বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নিয়ে এদের ছোট্ট সংসার৷ সবাই নিজের মতো মানিয়ে গুছিয়ে থাকে৷ নির্বিবাদে, নির্ঝঞ্ঝাটে থাকা মানুষগুলোকে জীবনের শেষবেলায় একটু শান্তির খোঁজ দেওয়াই, এই সংস্থার আপ্রাণ চেষ্টা। ব্রততী এখানে সবে একমাস হল এসেছে৷
গাড়ি থেকে হইহই করে নামছে দেবব্রত৷ শেষবেলার ম্যানেজার৷ ভীষণ প্রাণবন্ত ছেলে৷ সারাক্ষণ বৃদ্ধাবাসের পরিবেশে একটা প্রাণ ঢেলে রাখার দায়িত্ব যেন অলিখিত ওর ঘাড়েই৷ যে কোনো প্রয়োজনে বা যে কোনো আয়োজনে ...দেবব্রত ডাক পড়ে সবার আগে৷ আজ সারাদিনও যে পিকনিকের আসর ওই মাতিয়ে রাখবে তা বলাই বাহুল্য৷
চোখ ফেরায় ব্রততী৷ জায়গাটা ভারী সুন্দর৷
প্রকৃতি কি অকৃপণ এখানে! যতভাবে পেরেছে ঢেলে সাজিয়েছে যেন৷ একদিকে পাহাড়, জঙ্গল, সামনে দিগন্ত জুড়ে সবুজ হলুদের রঙিন আঁচল বিছিয়ে রাখা৷ ঐপাশে নদী৷ আর নদী পেরিয়ে হাল্কা জনবসতি। তার পেছনে আবার নীল পাহাড়ের উঁকি ঝুঁকি৷ ছবির মতো সাজানো সব। এমন ছবির মতো প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে বরাবর ভালোবাসে ব্রততী৷
বৃদ্ধাবাসের কেয়ারটেকার রমেন, বড় একটা ত্রিপল পেতে তার উপর দুটো মাদুর বিছিয়ে দিয়েছে মাঠের একদিকে দেবব্রতর নির্দেশে৷ সবাই বয়সের ভাড়ে নুব্জ কুব্জ। তাই আস্তে আস্তে জায়গাটা ভরে গেল অচিরেই৷ ব্রততী ওখানে গেল না৷ বেশি কথা, বেশি লোকজন তার ভালোলাগে না কোনকালেই৷ এখানে এসে পর্যন্ত কারো সাথেই কথা বাড়াইনি৷ সবাই তাই আড়ালে তার অহংকার,দেমাক এসব নিয়ে কথা বলে৷ বলুক গে৷ তাতে কিছু যায় আসে না ব্রততীর৷ বরং সে মনে করে এসব বললেই ভালো৷ অন্তত বেশি গায়ে পড়ে মিশতে আসবে না কেউ৷
গুটিগুটি পায়ে নদীর ধারে যায় সে৷ একটা পাথর ঘেষে, ব্যাগ থেকে পেপার বের করে, পেতে বসে৷ নদী তার খুব প্রিয়৷ মানুষের জীবনতো নদীর মতোই অনেকটা৷ খালি বয়ে চলা৷ খালি নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া৷ দু দন্ড দাঁড়াবার সময় নেই৷ কখনও কখনও কোনো ঘাটে মন বাঁধা পড়ে যায়... কিন্তু উপায় থাকে না কিছু৷ শুধুই সমুদ্রের খোঁজে অনন্ত চলাই জীবন৷
পেছনে এসে কখন যে দাঁড়ায় দেবব্রত, বুঝতে পারে না ব্রততী৷
"ম্যাডাম আপনি আজকেও আলাদা হয়ে থাকবেন সবার থেকে!"
কথা শুনে পেছনে তাকায় সে৷ হাল্কা হাসি মুখে ফোটানোর চেষ্টা করে৷
"তুমি তো জানো দেবব্রত আমার বেশি কথা বলতে...."
"জানি" ...কথার মাঝেই বলে ওঠে সে৷ কিন্তু আপনি কি জানেন ম্যাডাম... কিছু কাজ আমাদের ইচ্ছে না থাকলেও করতে হয়৷ এটাই সামাজিক জীবের কর্তব্য৷ আর আপনি তো এখানেই থাকবেন৷ এদেরই সাথে৷ যদি এদেরই আপন করতে না পারেন, থাকাটা কিন্তু কষ্টকর হবে৷ মানিয়ে নিতে দেরি হবে৷ যাক টিফিন করুন৷"
হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে চলে যায় দেবব্রত৷
শেষ কথাগুলো মনে বিঁধতে থাকে ব্রততীর৷ দেবব্রত এভাবে বলল কেন! এতটা কঠিন তো তাকে মনে হয় নি এই ক'দিনে৷ টিফিন খেতে ইচ্ছে হল না৷ মনে হল নদী পেরিয়ে ঐ পাড়ে চলে যায়৷ কিন্তু সাহসে কুলোয় না৷ একা একাই হাঁটতে থাকে উল্টো পথে৷ জঙ্গলের দিকে৷
কিছুদূর যেতে না যেতেই পেছনে থেকে একটা চিৎকার শুনতে পায় ব্রততী ৷
"ম্যাডাম ম্যাডাম৷"
ব্রততী বুঝতে পারে এটা দেবব্রতর আওয়াজ। সবদিকে নজর তার তীক্ষ্ণ৷ ঠিক দেখে নিয়েছে ব্রততীকে৷ কিন্তু ব্রততী পিছন ফেরে না৷ হাঁটতে থাকে৷
- ২ -
সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ায় দেবব্রত৷
"কোথায় চললেন একা একা?
বলেছিলাম না এদিক ওদিক কোথাও যাওয়া যাবে না৷"
একটু অভিমান মাখা গলায় ব্রততী বলল
"একটু বনের দিকটা যাব৷ ইচ্ছে হচ্ছ৷"
প্রথমটা কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় দেবব্রত৷ চোখে মুখে একটু কপট রাগ এনেও মুহূর্তে হেসে ফেলে সে৷
হাসিটা বড় সুন্দর৷ সরল। কার সাথে যেন মিল পায় একটা ব্রততী৷ কার সাথে....!
একটা ফোন করে রমেনকে কিছু বলে দেবব্রত৷ তারপর ব্রততীকে বলে -
"চলুন৷ আমিও যাই। বন জঙ্গল আমারও ভীষণ প্রিয়৷"
ব্রততী না করে না৷ ভালোই লাগে তার৷
এখানে আসার পর থেকে এই ছেলেটাকেই একমাত্র ভালো লেগেছে তার৷ কী যেন একটা টান পায় ব্রততী ওর প্রতি৷ ওর সাথে কথা বলতে গেলে একটা মিল খুঁজে পায় কারো সাথে৷
ওরা হাঁটতে থাকে৷ জায়গাটা উঁচু নীচু৷ একটু কষ্ট হয় ব্রততীর। তবু জঙ্গল দেখার অমোঘ আকর্ষণ বরাবর৷ তাই ধীর গতিতে এগিয়ে যায়৷ গভীর থেকে গভীরে৷
শাল, সেগুন, জারুল পাশাপাশি নিবিড় দাঁড়িয়ে৷ কি উদার এখানে প্রকৃতি৷ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছোট বড় সব গাছ৷ যেন গাছেদের প্যারেড গ্রাউন্ড। কি পরম প্রশান্তি ছড়িয়ে আছে চারিদিকে৷
- ৩ -
দেবব্রত হঠাৎই বলে ওঠে
"জানেন ম্যাডাম খুব ছোট বেলা থেকে এখানে আসছি আমি৷ বাবার সাথে৷ বাবার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা ছিল এটি৷ প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে আমাকে আর মাকে নিয়ে আসত এখানে। প্রথম প্রথম আমরা খুব মজা করতাম৷ পরে একদিন কি হল জানি না৷ মা এখানে আসার কথা শুনলেই রেগে যেত৷ তবু বাবা এখানে আসা বন্ধ করত না৷ তখন আমি আর বাবা আসতাম৷
একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম কেনো এই জায়গাটা বাবার এতো পছন্দের৷ বাবা হাসল কিছু বলল না৷"
ব্রততী বলে - "হয়ত তুমি তখন ছোট ছিলে৷ তাই বলে নি৷"
দেবব্রত মুচকি হাসে৷ "হ্যাঁ, তাই হবে৷"
ওর চোখে মুখে অভিমান ঝরে পড়ে৷
দেবব্রত এগিয়ে যায়৷ অনেকটা ভেতরে চলে যায় ওরা জঙ্গলের৷
"চলুন ঐ তো সামনেই একটি টিলা আছে৷ ওই জায়গাটা থেকে আশপাশটা খুব সুন্দর দেখা যায় ৷ বাবা এসে ওখানে বসে থাকত অনেকটা সময়৷ চলুন আপনাকে দেখাই।"
টিলার কথা শুনতেই মনটা কেমন যেন করে ওঠে ব্রততীর৷ বুক জুড়ে তোলপাড় হয়৷ স্মৃতির সমুদ্রে মন্থন চলতে থাকে৷ হাল্কা কিছু ছবি ফ্ল্যাশ ব্যাকের মতো উঠে আসতে থাকে আবার মিলিয়ে যেতে থাকে৷
টিলার উপরে ব্রততীকে উঠতে সাহায্য করে দেবব্রত।
অদ্ভুত সুন্দর চারপাশটা...। কিন্তু ঠিক এইখানে আগেও এসেছে সে৷ হ্যাঁ হ্যাঁ... মনে পড়ছে তার একটু একটু... যেন বহু যুগ আগে ঘটে যাওয়া কিছু। সে আর একজন... দুজনে খুব কাছাকাছি বসা... ভালোলাগা... গল্প... হাসি... মেঘ... বৃষ্টি... রো আরো কতকিছু... খুব কষ্ট হয় বুকের ভেতর৷ মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠে ব্রততীর৷ ইদানীং এত মাথায় চাপ দিতে পারেনা সে৷
দেবব্রত চুপ করে থাকে৷ কিছু যেন একটা ভাবতে থাকে৷ ব্রততী জিজ্ঞেস করে ...
"আচ্ছা দেবব্রত তবে কি তুমি আর জানতে পারনি, কেন তোমার বাবা বারবার এখানে আসতেন৷ কেন তোমার মা আর আসতে চাইতেন না.... এসব?
দেবব্রত হাসে৷ অবিকল সেই হাসি৷ মনে পড়ে ব্রততীর৷ এ হাসি যে তার খুব চেনা৷ এ হাসির প্রেমেই যে সে পড়েছিল যৌবনে৷ এ হাসিতো অবিকল তার দেবুদার.... দেবাঞ্জন দার৷
দেবব্রত নামতে শুরু করে টিলার থেকে৷ নামতে নামতে স্বগোতোক্তির মতো বলে যায়...
"বাবা আজ পনেরো বছর হল আমায় ছেড়ে চলে গেছে জানেন৷ মা গেছে তারও আগে৷ বাবা চলে যাওয়ার পর আমি আর আসিনি এখানে৷ আসলে ইচ্ছে হয়নি৷ বাবা মারা যাওয়ার পর বাবার জিনিসপত্রের মধ্যে একটা ডাইরি পাই৷ তাতে অনেক কিছু লেখা, কিছু চিঠি, একজন মহিলার ছবি আর তার নাম, ঠিকানা ছিল৷ সেখান থেকে সবকিছু জানতে পারি৷ সবকিছু...৷
জানেন আমার বাবা আমার মাকে বিয়ে করেছিল ঠিকই কিন্তু ভালোবাসতে পারেনি কোনদিনও৷ বাবা যাকে ভালোবেসেছিল তাকে জীবনে একবার নিজের করে পেয়েছিল ঠিক এইখানে; এই টিলায়। কলেজ জীবনের শেষ বছর৷ কলেজ পিকনিকে এসে। আজকের এই দিনেই তাদের জমে উঠেছিল ভালোবাসাকে সম্পূর্ণ নিজের করে পাওয়ার স্বর্গীয় অনুভূতি৷ এই জায়গা আর ঐ টিলা আমার বাবার সব আনন্দের আর আমার মায়ের সব দুঃখের উৎস ছিল৷"
ব্রততীর টিলা থেকে নামতে কষ্ট হয়। কিন্তু দেবব্রত হাঁটতে থাকে৷ একমনে ...পেছন ফেরে না৷ ব্রততীর কষ্ট দেখে না। নাকি দেখতে চায় না!
ব্রততী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না৷ মাথা ঘুরতে থাকে তার।
"দেবব্রতওওও...." একটা জোর ডাক দেওয়ার চেষ্টা করে সে৷ "তুমি কে...? তোমার মুখে.. হাসিতে আমি কার ছবি দেখি? তোমার বাবা কে... তোমার বাবার নাম ...."
কথাগুলো গাছে গাছে ধাক্কা খেয়ে আবার যেন ব্রততীর কাছেই ফিরে আসে৷ দেবব্রতর কান পর্যন্ত পৌছায় না৷ ব্রততীর মাথা ঘোরায়, চোখে অন্ধকার নেমে আসে... আচমকা গড়িয়ে পড়ে টিলার ঢালে৷ এক নিমেষে তার চোখের সামনে জীবনের দুটো বিষম পিকনিকের চিত্র মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়৷ গড়িয়ে যেতে যেতে সে দেখতে পায় দেবব্রত একটু দূরে নির্বিকার দাঁড়িয়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে৷
কি যেন একটা পরম তৃপ্তি.... আনন্দ লেগে আছে তার চোখে মুখে৷
Comments
Post a Comment