গল্প - দেবাশিস ধর



মনের বাঘ  


                                                                                                 

সাত সকালেই মোবাইলটা বেজে উঠলেও ধরতে পারা গেলনা। কললিস্টে দেখলাম বন্ধু সুহাসের নাম। করোনা ভাইরাসের অতিমারির এই দুঃসহ দিনগুলোতে পরিচিতদের পরস্পরের সাথে ঘনঘন খবরাখবর করাটা সবারই প্রায় অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আনলিমিটেড টকটাইমের দৌলতে বার্তালাপ অকারণে দীর্ঘায়িতও হচ্ছে। অবশ্য আমার মত বছর সাতেক আগে রিটায়ার হওয়া লোকের কাছে সময় বিলকুল উদ্বৃত্ত। আবারো মোবাইল বেজে উঠলো, অন্যপ্রান্তে সুহাসের সহধর্মিণী মন্দিরার উদ্বিগ্ন গলা- প্রায় কেঁদে ফেলার মতোই। সুহাস নাকি কাল থেকে খাওয়া ঘুম প্রায় ত্যাগ করেছে করোনা আতঙ্কে। 'দিন আগে ছেলে পুনে থেকে ফোনে জানিয়েছিলো ওর ঠিক পাশের ফ্ল্যাটেই একজন করোনা আক্রান্ত হয়েছে। পরশু গুয়াহাটি থেকে মেয়ে বলেছিল ওর শ্বশুর মশাইর শরীরটা কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছেনা। এসব শুনেই বন্ধু আমার ভয়ানক আপসেট হয়ে পড়েছিল। গতকাল ভোরে আবার ওদের বাড়ির একদম কাছের মুদিখানার বয়াস্ক দোকানদার কোভিড হাসপাতালের আইসিইউ-তে গত হয়েছেন। সুহাসকে কিছুতেই আমার সঙ্গে কথা বলানো গেলনা। 


অথচ দিনকয়েক আগেই ফোনে সুহাস আমাকে করোনা ঠেকাতে বিশেষ একটি হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেয়েছি কিনা, গরম জল খাচ্ছি কিনা ইত্যাদি হাজারো সওয়ালে জেরবার করেছে। আমিই বরং রসিকতা বলেছিলাম- 'বুড়োদেরতো কেউ পাত্তাটাত্তা দেয়না বরঞ্চ করোনাই আমাদের পছন্দের তালিকায় একদম উপরের দিকে রেখেছে। তবে তুমি দুহাতের আঙ্গুলে যে ডজনখানেক স্টোন ধারন করেছো সেগুলোই তোমায় বাঁচিয়ে দেবে' শুনে সুহাস হেসে ফেলেছিল। সেই মানুষই কিনা এখন একবার বলছে- আমার জ্বরজ্বর লাগছে, পরক্ষণেই আবার বলছে- আমি এত ঘামছি কেন। মন্দিরা থার্মোমিটার লাগিয়ে দেখেছে সব স্বাভাবিক কিন্তু অস্থিরভাব যাচ্ছেনা।ভাগ্যিস সুহাস খবরের কাগজ লকডাঊনের শুরু থেকেই বন্ধ করে দিয়েছে নাহলে আমাদের এই পাঁচ লাখ লোকের শহরে গতকাল একদিনে বিরাশিজন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন জানলে আর দেখতে হত না। প্যানিক অ্যাটাক বলেই মনে হচ্ছে। মন্দিরাকে মৌখিক সাহস যুগিয়ে আর সুহাস যেন টিভি না খোলে সেই পরামর্শ দিয়ে ফোন ছাড়লাম। খুবই চিন্তার বিষয়। কিছু একটা করতে হয়। কর্মসূত্রে বিশেষ পরিচিত ডাক্তার রায়কে ডায়াল করলাম, আড়াইমিনিট ধরে করোনা সংক্রান্ত নির্দেশ, উপদেশ শুনিয়ে নারীকন্ঠ জানালো- মোবাইল সুইচড অফ। আবার কল করেও একই উত্তর পেলাম। ভারী মুশকিল হল- কি করা যায়? কেমন যেন  একটা অসহায়তাবোধ আমাকে জাপটে ধরতে চাইছে। আচ্ছা সুহাস আবার জমির আলী হয়ে যাবেনাতো? কে এই জমির আলী?  

 

সেই ছোটবেলায় একবার মামার বাড়ি গিয়ে জমির আলীর আশ্চর্য ঘটনা শুনেছিলাম। উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত গ্রামের আনেক বাড়ির মত আমার মামাদেরও বাড়ির উঠানের দু'পাশে লম্বা মাটির ঘর ছিল যেগুলোর চাল ছন দিয়ে ছাওয়া থাকত। গরমের দিনে এই ছনের ঘর আরামদায়ক হলেও সাপখোপের ভয় ছিলো। প্রতি দু'বছর অন্তর চালের পুরানো ছন ফেলে নুতন ছন লাগানো হত। কামলাপাড়ার জমির আলী এই কাজের জন্য বাঁধাধরা লোক ছিল। ছন,বাঁশ,নারকেলের দড়ি যোগাড় করে জমির আলীকে খবর দিলেই হল। আগেরবার জমির তার তরুন ভাইপোকে নিয়ে এসেছিল সহায়ক হিসাবে। জমিরের বেজায় বকবকানির স্বভাব- কথা ছাড়া সে এক মুহূর্ত থাকতে পারেনা। পুরানো ছন ফেলে বাশের বাখারির কাঠামোর উপর নূতন ছন লাগানোর কাজ চলছে। ভাতিজা উঠান থেকে ছনের বান্ডিল, টুকরো করা দড়ি চাচার কাছে চালে ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছে এবং নিরন্তর বকা খেয়ে চলেছে জিনিসগুলো ঠিকমত চাচার হাতের কাছে পৌঁছচ্ছেনা বলে। একবারতো ছনের গোছা বাখারির উপর সাজাতে গিয়ে সেই গোছার ভিতরেই খানিকটা মোটা একটা দড়ির টুকরো হাতে ঠেকলো, উপর থেকে দেখতে না পেলেও জমির বুঝলো দড়িটা এক ভাঁজের জায়গায় অন্তত দু'ভাঁজ থেকে গেছে। মাথা ঘুরিয়ে ভাতিজাকে তিরস্কারে ব্যস্ত জমির আসল কাজে বেখেয়াল হয়ে ছনের গোছার নীচে হাতে লেগে থাকা দু'ভাঁজের দড়ির টুকরো দিয়েই কাঠামোর সাথে ছন বাঁধতে গিয়ে বাঁহাতের তালুতে বাঁশের বাখারির জব্বর খোঁচা খেলো। সামান্য রক্তপাতও হল। ভাতিজা কাছের ঝোপঝাড় থেকে কি এক বুনোগাছের পাতা এনে হাতে ডলে ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলে জমির আবার কাজে লেগে গেল।               

     

বছরদুয়েক পরে আবার ডাক পড়ায় জমির আলী ভাতিজাকে নিয়ে হাজির হল। দুজনে চালের দুইপ্রান্ত থেকে পুরানো ছন খোলা শুরু করলো, ভাতিজার দিকে বাঁশের কাঠামো বেরিয়ে এলে হঠাৎ সে চিৎকার করে তার চাচাজানকে ডাকলো। চিৎকার শুনে বাড়ির সবাই উঠানে ছুটে এল। দেখা গেল বাখারির সাথে ছনের দড়ি বাঁধার এক জায়গায় একটি নাতিদীর্ঘ সাপের কঙ্কাল গিঁট মারা অবাস্থায় লটকে আছে। জমির আলী আর্তনাদ করে উঠলো- 'হায় আল্লাসেইদিন আমারে সাপেই কামড়াইছিল। আমি অরে ব্যথা দিছি 'আমারে পুরা বিষ না ঢাইল্যা ছাড়ছে নাকি। আর্তনাদ করতে করতেই জমির আলী বাঁহাতের তালু ডান হাত দিয়ে চেপে ধরে চালেই বসে পরলো। দেখতে দেখতে জমির অলীর বাঁহাত ফুলে গেল, সাপের কামড়ের অন্যান্য লক্ষণও ফুটে উঠলো। ভাতিজা ততক্ষণে বাহুতে দড়ির বাঁধন লাগিয়ে দিয়েছে। ধরাধরি করে আচ্ছন্ন জমিরকে উঠানে নামিয়ে ওঝা ডেকে আনা হল। কিন্তু জমির আলীকে আর একদিনের বেশী বাঁচানো গেলনা।      

 

সুহাসও করোনা আতঙ্কে জমির আলী হয়ে যাবেনা তো? না তা'হবেনা কিছুতেই- আমরা আছি। মোবাইলের দিকে হাত বাড়াই- ডাক্তার রায়কে এবার যে পেতেই হবেই।     

Comments

  1. ভালো লাগলো l বর্তমান সময়ে অনেকটাই প্রাসঙ্গিক l

    ReplyDelete

Post a Comment