গল্প - সজল কুমার মাইতি


জি ডির হয়রানি


পাজামা পাঞ্জাবি পরে কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে  কৃষ্ণকান্তকে বেরতে দেখে মনোবীনাদেবী বলে উঠলেন "এখন কোথায় বেরুচ্ছ?"

"একটু স্টেট ব্যাংকে যাব। হাইকোর্ট ব্রাঞ্চে। ওই এন পি এস অ্যাকাউন্টটা অনলাইন করার জন্য।"

"স্নান করে খেয়ে যেতে পারতে? রান্না তো হয়ে গেছে। রাস্তা ঘাটে কখন কি হয়? কলকাতার রাস্তায় ফেরার কোন ঠিক আছে?" মনোবীনার মনের আশঙ্কার প্রকাশ।

"না না। কতটুকু সময় লাগবে? এসে স্নান করে খাব।"

কৃষ্ণকান্তের বয়স ষাট ছুঁই ছুঁই। রিটায়ারমেন্টের বছর খানেক  বাকি। ট্যাক্স বেনিফিট পাওয়ার জন্য এন পি এস অ্যাকাউন্ট খোলা। স্টেট ব্যাংকের লোকাল হেড অফিস হাইকোর্টের কাছেই। সম্বৃদ্ধি ভবন। এক নম্বর স্ট্রান্ড রোড। এই ব্রাঞ্চকে হাইকোর্ট স্পেশাল ব্রাঞ্চ বলা হয়। এই ব্রাঞ্চে কৃষ্ণকান্তের অ্যাকাউন্ট খোলার একটা ইতিহাস আছে। কৃষ্ণকান্ত তখন মাস্টার ডিগ্রী পাশ করে ইউনিভার্সিটির ফেলোশিপ পেয়েছে। পিএইচডি করার জন্য। নিয়মিত ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে যাচ্ছে। পি এইচডির পড়াশোনা করছে। কৃষ্ণকান্ত ন্যাশানাল লাইব্রেরিতে এতটাই নিয়মিত যে মেন বিল্ডিং এর রিডিং রুমের কাউন্টারের ভদ্রলোক কৃষ্ণকান্তকে দেখলে আর নাম জিজ্ঞেস করেন না। নিজ থেকে কার্ড বের করে ফেলেন। সেখানে অনেক বই পড়তে পড়তে সে জানতে পারে যে স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার সর্ব প্রথম নাম ছিল 'ব্যাংক অফ বেঙ্গল' পরে এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'ইম্পিরিয়াল ব্যাংক' 1955 সালের পয়লা জুলাই স্বাধীন ভারতে জাতীয়করনের মাধ্যমে এই ব্যাংকের নাম আবারও পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে এই ব্যাংকের নাম ওই তারিখ থেকে স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় সরকারি ব্যাংক। ইতিমধ্যে কৃষ্ণকান্ত উত্তরবঙ্গের এক কলেজে অধ্যাপনার চাকরিতে জয়েন করেছে। পূজোর ছুটিতে দেশের বাড়ি যায়। দেশের বাড়িতে বড়দিদি একদিন বলেন "ভাই, দেখতো এটা কি? আলমারির মধ্যে পেলাম।" কৃষ্ণকান্ত দেখে একটা ছোট্ট লম্বাটে ধরনের পাসবই। ওপরে প্রায় আবছা হয়ে যাওয়া লেখা। ইম্পিরিয়াল ব্যাংক। ভেতরে পাতায় ব্যালান্স আটশো টাকা সতের পয়সা। দিদি আবার জিজ্ঞেস করেন "এটা কি? কিছু বুঝলি?"

"হ্যাঁ। এটা ইম্পিরিয়াল ব্যাংকের পাসবই। বাবার নামে। আটশোর মত ব্যালান্স দেখছি। কলকাতা যাওয়ার সময় নিয়ে যাব। দেখি কি করা যায়।"

এরপর কলকাতা আসার সময় কৃষ্ণকান্ত পাসবইটা সঙ্গে নিয়ে এল। কলকাতায় কৃষ্ণকান্তের একটা ঠেক আছে। কলকাতায় এলে এখানে থাকে। থাকা খাওয়া দাওয়া সবেরই বন্দোবস্ত আছে এখানে। ছুটিতে এখান থেকে লাইব্রেরিতে যায়। তা একদিন পাসবই নিয়ে স্ট্রান্ড রোডের স্টেট ব্যাংকের মেন ব্রাঞ্চে হাজির হয়। দোতলায় উঠে দেখে বড় করে লেখা 'May I help you' বোর্ড টাঙানো একটি কাউন্টার। কৃষ্ণকান্ত সেখানে গিয়ে কাউন্টারে বসা এক ভদ্রলোককে পাশবইটা ধরায়। বলে "দেখুন তো এই পাসবইটা কি এখানকার?" কাউন্টারের ভদ্রলোক পাসবইটি উল্টে পাল্টে দেখেন। তারপর কৃষ্ণকান্তের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন " পাসবই আমাদের ব্রাঞ্চের। আপনি একটা কাজ করুন।"

"কি করতে হবে এখন?"

"আপনি এই পাসবইটি নিয়ে সোজা বাঁদিকে চলে যান। দেখবেন ওল্ড অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট। সেখানে যজ্ঞেশ্বর বাবু আছেন। তাকে এই পাসবইটা দেখাবেন। তিনি আপনাকে সাহায্য করবেন। "

ওনার কথামতো কৃষ্ণকান্ত যজ্ঞেশ্বরবাবুর কাছে হাজির হয়। পাসবই দেখায়। পাসবই দেখে যজ্ঞেশ্বরবাবু কৃষ্ণকান্তকে বসতে বলেন। আর বলেন " আপনাদের জন্য তো আমরা বসে আছি। এগুলো দিতে পারলে আমরা বেঁচে যাই।" কৃষ্ণকান্ত উৎসাহ আর ধরে রাখতে পারে না। জিজ্ঞেস করে " টাকাটা ফেরৎ পাওয়া যাবে তো?" 

"হ্যাঁ। আপনাদের টাকা দেওয়ার জন্য তো আমরা বসে আছি। লিখে নিন কি কি কাগজ লাগবে।" যজ্ঞেশ্বরবাবুর কথামত একটা কাগজ নিয়ে কৃষ্ণকান্ত লিখতে থাকে কাগজপত্রের লিস্ট। লেখার কাজ শেষ হতেই কৃষ্ণকান্ত নমস্কার জানিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যায়। আবার দেশের বাড়ি গিয়ে কাগজপত্র জোগাড় করে এনে ব্যাংকে জমা দেয়। এরপরেও কিছু ছোট খাটো ব্যাপারে কাজটা আটকে ছিল। একদিন ব্যাংকে যজ্ঞেশ্বরবাবুকে কৃষ্ণকান্ত একটা প্রস্তাব দেয় " আচ্ছা দেখুন। একটা কাজ যদি করি তাহলে আপনাদের আর অসুবিধে হবে না।"

"কি কাজের কথা বলছেন?"

"আমি যদি একটা অ্যাকাউন্ট এখানে খুলি। আর সেই অ্যাকাউন্টে আপনাদের হিসেবমতো যা দেয় হয় তার চেয়ে বেশি অ্যামাউন্ট জমা রাখি তাহলে তো অসুবিধে থাকার কথা নয়।"

"হ্যাঁ, তা করা যেতে পারে। আমি আমার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি।" যজ্ঞেশ্বরবাবু কৃষ্ণকান্তের অনুমতি নিয়ে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শ করতে চলে যান। কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসেন। কৃষ্ণকান্তের উদ্দেশ্যে বলেন "আপনার প্রস্তাবে কর্তৃপক্ষের কোন সমস্যা নেই। কিন্তু অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য আপনার একজন ইনট্রোডিউসার লাগবে।"

"ঠিক আছে। তাই হবে।"

কৃষ্ণকান্তের এক খুড়তুতো জামাইবাবু কলকাতা হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করেন। তার এক সহকর্মীর এই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট আছে। তাকে দিয়ে ইনট্রোডিউস করিয়ে তবে এই ব্যাংকে কৃষ্ণকান্তের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এই হল কৃষ্ণকান্তের এই ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার ইতিহাস।

তা সেই সুবাদে কৃষ্ণকান্তের এই ব্যাংকেই সেভিংস অ্যাকাউন্ট ছাড়াও পি পি এফ অ্যাকাউন্ট আছে আবার এন পি এস অ্যাকাউন্ট এই ব্যাংকেই। সেই এন পি এস অ্যাকাউন্ট অনলাইন করার জন্য কৃষ্ণকান্ত ব্যাংকে এসেছে। লিফটে সাত তলায় উঠে ডানদিকের দরজা ঠেলে ঢোকে। প্রথমের সিটে বসা ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে "আচ্ছা, এন পি এস কে দেখেন বলবেন প্লিজ?"

"সামনের দিকে সোজা যে ভদ্রলোক বসে আছেন। উনি।"

কৃষ্ণকান্ত সোজা সামনে এগিয়ে যায়। সামনের সিটে বসা এক ইয়ং ভদ্রলোকের সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে " আপনি কি এন পি এস দেখেন?"

"হ্যাঁ। একটু বসুন।"

মিনিট দশেকে হাতের কাজ শেষ করে ভদ্রলোক কৃষ্ণকান্তকে জিজ্ঞেস করেন "হ্যাঁ বলুন। কি বলছিলেন?"

"আমার এই এন পি এস অ্যাকাউন্টটা অনলাইনে কনভার্ট করতে হবে। অনলাইন হলে আমার অনেক সুবিধে। এই বয়সে বারে বারে এত দূরে ব্যাংকে এসে টাকা জমা দেওয়া আমার পক্ষে সত্যিই কষ্টের। তাই দয়া করে যদি এই অ্যাকাউন্টটা অনলাইন করে দেন আমার অনেক উপকার হয়।"

"হ্যাঁ দেখছি।" এই কথা বলে ভদ্রলোক নিজের মোবাইলে কাউকে ফোন করেন। পরিচিত কেউ। অন্য কোন ব্রাঞ্চের মনে হল কথাবার্তা শুনে। কিভাবে অনলাইনে কনভার্ট করা যায় তা নিয়েই কথা হচ্ছিল। কিছুক্ষণ কথা হওয়ার পর মোবাইল রেখে ভদ্রলোক কৃষ্ণকান্তকে বলেন "বুঝতেই পারছেন এটা একেবারে নতুন। এই ব্যাপারে তল্লাটে দু একজনই জানেন। সেইজন্য জেনে নিচ্ছিলাম।"

"আদৌ হবে তো এটা?" করুণ মুখে কৃষ্ণকান্তের জিজ্ঞাসা।

"হ্যাঁ। হয়ে যাবে। তবে একটু সময় লাগবে। আপনি আপনার অ্যাকাউন্টের জেরক্স কপিগুলো আমাকে দিয়ে যান। আমি করে দেব। দিন দুয়েক পর ফোন করে জেনে নেবেন।।"

"তখন অনলাইনে আমি সবকিছু করতে পারব?"

"হ্যাঁ। তবে এন পি এস এর সাইটে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে নিতে হবে। নিজের মতো পাসওয়ার্ড নিয়ে নেবেন। তারপর অনলাইনে সব করতে পারবেন। ব্রাঞ্চে আসার দরকার পড়বে না।"

ব্যাংক অফিসারকে নমস্কার জানিয়ে কৃষ্ণকান্ত বেরিয়ে আসে। ব্যাংকের চারটে লিফটের একটি খারাপ। বাকি তিনটের একটি নিচে নামছে। বাকি দুটি সবে নিচ থেকে ওঠা শুরু করেছে। অগত্যা কৃষ্ণকান্ত সাত তলার বিরাট কাচের জানালা দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে গঙ্গাকে দেখে। এত উঁচু থেকে পুরো গঙ্গা কেন? হাওড়ার ওপার পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গঙ্গার বুকে একটা স্টিমার ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। কয়েকটি নৌকা যেতে দেখা যাচ্ছে। একটা পাখির দল সার বেঁধে উড়ে যাচ্ছে। ঝলমলে রোদ্দুর গঙ্গার বুকে রিফ্লেক্ট করে চকচকে ঝলকানির ছবি তৈরি করছে। ঐতো ওটা গঙ্গার বুকে ভেসে থাকা সেই হোটেলটা না? সরি, ওটা তো ফ্লোটেল। ফাইভ স্টার হোটেলের চেয়ে কিছু কিছু ব্যাপারে দামি। কতক্ষণ এভাবে দেখছিল ঠিক নেই। কৃষ্ণকান্তের সম্বিৎ ফেরে কেউ একজন এসে জিজ্ঞেস করে "দাদা, পি পি এফ ডিপার্টমেন্টটা কোন দিকে?" হাতের ইশারায় কৃষ্ণকান্ত দেখিয়ে দেয়। পর পর দুটো লিফট এসে দাঁড়িয়েছে সাততলায়। হুড়মুড়িয়ে কৃষ্ণকান্ত লিফটে উঠে পড়ে। নীচে নেমে একবার ভাবল উবের ধরে বাড়ি ফিরে যায়। পরক্ষণেই মত পরিবর্তন করে ভাবে এখন তো বাস খালি। বাসে করেই যাই।

 বাবুঘাটে হেঁটে এসে কৃষ্ণকান্ত উল্টোডাঙার বাস ধরে। মনে মনে ভাবে উল্টোডাঙায় নেমে অটো ধরে বাড়ি ফিরে যাব। বাসের পেছনের লম্বা সিটের একটাতে জায়গা পায়। তাতেই বসে। সঙ্গে সঙ্গে বাস ছেড়ে দেয়। বাসে বসে থাকতে থাকতে একটু ঝিমুনি এসে যায়। বাস ঠিক রাজাবাজার ক্রস করেছে এমন সময় কৃষ্ণকান্তের ঘুম ভেঙে যায়। হঠাৎ পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিয়ে দেখে পকেটে মোবাইল নেই। প্রথমে ভাবলো হয়তো পড়ে গেছে। উঠে বাসের সিট, সিটের নীচ সব জায়গায় খুঁজে দেখে। কোথাও নেই। পাশের ভদ্রলোক নিজের মোবাইল এগিয়ে দিয়ে বললেন "আপনার নাম্বারটা বলুন?" কৃষ্ণকান্ত নিজের নাম্বার বলে। ভদ্রলোক নিজের মোবাইল থেকে ফোন করেন। অপরপ্রান্তে এক মহিলা কন্ঠ শোনা যায়। কৃষ্ণকান্ত যেই ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করে "এই মোবাইল আপনি কোথায় পেলেন?" পর মুহূর্তে ফোন সুইচড অফ হয়ে। আর কোন যোগাযোগ করা যায় না। তখন বাস কাঁকুড়গাছি রেলব্রীজ ক্রশ করছে। একবার ভাবলো এখানে নেমে যাই। একটু ভেবে দেখলো উল্টোডাঙায় নামলে সুবিধে। কারণ থানা উল্টোডাঙার কাছেই। মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিতে নিতে বাসও উল্টোডাঙা পৌঁছে গেছে। কৃষ্ণকান্ত বাস থেকে নেমে পড়ে। থানার খোঁজ করে। জানতে পারে থানা এখন শিফট করে পনেরো নম্বর বাস স্ট্যান্ডের উল্টোদিকে চলে গেছে। অগত্যা  হাঁটতে হাঁটতে কৃষ্ণকান্ত থানায় পৌঁছয়। দোতলায় উঠে দেখে এক পুলিশ অফিসার বসে কিছু লিখছেন। কৃষ্ণকান্তকে দেখে জিজ্ঞেস করেন "কিছু বলবেন?"

"আমার একটা এফ আই আর নিতে হবে।"

"এফ আই আর না জি ডি? আপনি কি লিখে এনেছেন?"

"না।"

"তবে জি ডি করতে হবে। আপনার কি হয়েছে?"

"আমার মোবাইলটা পকেট থেকে চুরি হয়ে গেছে।"

"কখন জানতে পারলেন?" কৃষ্ণকান্ত মনে মনে চিন্তা করে নেয়। ভাবে রাজাবাজার বললে যদি কোন ঝামেলা হয়। সেজন্য বলল "উল্টোডাঙায় বাস থেকে নামার পর।"

"উল্টোডাঙায় কোথায় নেমেছেন?"

"পি সি চন্দ্রের আগে রাস্তার ক্রসিং এ।"

"রাস্তা ক্রস করে না আগে?" এই প্রশ্নের ধাক্কায় কৃষ্ণকান্ত ধন্দে পড়ে। ভাবে কি বলা যায়। কি মনে করে বলে ফেলে "রাস্তার আগেই।" আর যায় কোথায়? পুলিশ অফিসার যেন এই উত্তরের অপেক্ষায় ছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তার জবাব "তাহলে আপনাকে মানিকতলা থানায় যেতে হবে। ওটা মানিকতলার আন্ডারে।"

"রাস্তার এদিক ওদিকের জন্য এই সমস্যা? আমার একটা জি ডি নাম্বার দরকার। সিম ব্লক করে নতুন সিম নেওয়ার জন্য লাগবে। আপনারা তো আমার মোবাইল খুঁজে দেবেন না? জি ডি নিতে অসুবিধে কোথায়?"

"আমাদের এরিয়ায় নয়। কিচ্ছু করার নেই।"

কৃষ্ণকান্ত মনে মনে ভাবে প্রায় সিনিয়র সিটিজেন হওয়া এক শিক্ষিত ব্যক্তির জন্য পুলিশের মনে যখন একটুও সহমর্মিতা নেই ! তাহলে অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সাধারণ নাগরিক নিত্যনৈমিত্তিক কি ধরনের পুলিশি ব্যবহারের শিকার হয় তা অনুমান করা যায়। যে পুলিশ আকছার অন্যায় অবিচার করে যাচ্ছে তাদের এই নিয়মের অজুহাত আর এক ধরনের অমানবিক আচরণের উদাহরণ। কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেত যদি এই বয়ঃজেষ্ঠ ব্যক্তিকে একটি জি ডি নাম্বার তার হাতে তুলে দেওয়া যেত! মোবাইল তো দিতে পারবে না। আজকের দিনে জরুরি মোবাইল সিম। তা পাওয়ার জন্য একটা জি ডি জরুরি। আর সেই টুকুর জন্য হা পিত্যেস  করে থাকা ছাড়া কোন উপায় নেই।

হতাশ কৃষ্ণকান্ত থানা থেকে বেরিয়ে একটা অটো ধরে। বলে "ভাই, মানিকতলা থানা যাবে?"

"হ্যাঁ। বুক করে যাবেন তো?"

"হ্যাঁ। ভাড়া কত?"

"পঁচিশ টাকা।"

"একটু তাড়াতাড়ি চল ভাই।"

এখন ঘড়িতে দুপুর প্রায় দুটো। অটো মানিকতলা থানার সামনে কৃষ্ণকান্তকে নামিয়ে দেয়। সরাসরি থানায় ঢুকে যায় কৃষ্ণকান্ত। দেখে এক মহিলা পুলিশ অফিসার বসে আছেন। কৃষ্ণকান্ত মহিলা অফিসারকে জিজ্ঞেস করে "আমার একটা জি ডি করতে হবে।"

"কি ব্যাপারে?"

"আমার মোবাইল চুরি হয়ে গেছে। বাসে আসার সময়।"

"কোথায় বুঝলেন চুরি গেছে?"

"কাঁকুড়গাছি রেল ব্রীজের কাছে।"

"ব্রীজ ক্রশ করে না ব্রীজের আগে।"

"না না। ব্রীজের আগেই।"

"আচ্ছা দাদা, কাঁকুড়গাছি ব্রীজের আগে কোন থানার আন্ডারে?" মহিলা পুলিশ অফিসার চিৎকার করে তার এক পুরুষ সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করেন। তৎক্ষণাৎ উত্তরে পুরুষ সহকর্মী বলেন "ওটা রাজাবাজার থানার আন্ডারে।" আসলে কৃষ্ণকান্ত ভেবেচিন্তেই বলেছিল। সে নিশ্চিত ছিল ব্রীজের আগে হলে সেটা মানিকতলা থানাই হবে। কপাল খারাপ। এবারে ভুল। তাসত্বেও কৃষ্ণকান্ত মহিলা অফিসারকে রিকোয়েস্ট করে "জাস্ট একটা ডাইরি বইতো আর কি? আমার সিম চেঞ্জের জন্য এটা জরুরি। তাই বলছিলাম দয়া করে যদি একটু জি ডি করে নাম্বারটা দেন। আমার খুব উপকার হয়। "অফিসার মাথা নেড়ে জানায় "কিচ্ছু করার নেই।"

অগত্যা কৃষ্ণকান্ত কানাল রোড ধরে হাঁটতে থাকে। বেলা গড়িয়ে গেছে। সূর্য পশ্চিমে ঢলতে শুরু করেছে। নাওয়া খাওয়া কিছুই হয় নি। শ্রান্ত শরীরে রোদ্দুর মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে অবশেষে রাজাবাজার থানায় পৌঁছয়। দেখে রিপোর্টং অফিসার অন্য এক ব্যক্তির জি ডি লিখতে ব্যস্ত। তার মধ্যেই কৃষ্ণকান্ত নমস্কার জানিয়ে জিজ্ঞেস করে "আমার একটা জি ডি আছে।"

চোখ না তুলেই লিখতে লিখতে অফিসার বলেন "লিখে নিয়ে এসেছেন?"

"না। একটা কাগজ দেবেন? আমি এখানেই লিখে দিচ্ছি।"

"আপনি বেরিয়ে সোজা চলে যান। একটা পান সিগারেটের দোকান আছে। সেখানে কাগজ পেয়ে যাবেন। "

কৃষ্ণকান্ত থানা থেকে বেরিয়ে পানের দোকানে যায়। জিজ্ঞেস করে "ভাই, তোমার এখানে কাগজ পাওয়া যাবে গো?"

"কাকু, ছিল। শেষ হয়ে গেছে।"

"আর কোথায় পাব বলতে পার?"

"সামনে বাজারের দিকে দেখুন।"

কৃষ্ণকান্ত এগিয়ে যায়। পর পর কয়েকটি দোকানে জিজ্ঞেস করে। কোনটাতেই নেই। অবশেষে বাজারের ভেতরে একটা ছোট্ট বইয়ের দোকানে কাগজ পাওয়া গেল। লম্বা দিস্তা কাগজের একটি পিস। এতে দু পেজ আছে। দাম নিল দু টাকা। কাগজ নিয়ে কৃষ্ণকান্ত একটু দ্রুতগতিতে থানায় যায়। রিপোর্টিং অফিসার কৃষ্ণকান্তকে দেখে বলেন " আপনি কাগজ নিয়ে এসেছেন? এই কার্বনটা মাঝে রেখে লিখে ফেলুন।

এই বলে  রিপোর্টিং অফিসার বহু ব্যবহৃত একটি কার্বন পেপার কৃষ্ণকান্তের দিকে এগিয়ে ধরেন। কৃষ্ণকান্ত কার্বন নিয়ে কাগজের মধ্যে রেখে আজকের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখতে থাকে। লেখা শেষ হতেই কাগজখানা রিপোর্টিং অফিসারের হাতে দেয়। অফিসার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েন। যেখানে বুঝতে অসুবিধে হয় রিপোর্টিং অফিসার জিজ্ঞেস করে ক্লীয়ার করে নেন। তবে তিনি বলেন " আপনি সিমের কথা বলেছেন। তাহলে কিন্তু আই এম আই নম্বর দিতে হবে। এখন মোবাইল খোঁজা সম্ভব হবে না। "

"না না। তার দরকার নেই। একটা জি ডি নাম্বার পেলেই হবে। এই জি ডি টা দেখালে তবেই আমি নতুন সিম পাব।"

"তাহলে এই কয়েকটি জায়গায় একটু চেঞ্জ করে দিন। " রিপোর্টিং অফিসারের কথামত জি ডির কয়েক জায়গায় একটু চেঞ্জ করে দেয় কৃষ্ণকান্ত। " দেখুন, এবার মনে হয় ঠিক আছে। " অফিসার দেখে নেন। তারপর ওই কপির ওপরের দিকে একটু ছোট্ট করে একটা জি ডি নাম্বার লিখে সই করে দেন। সিল দিয়ে দেন। জি ডির কপি হাতে যখন পেল কৃষ্ণকান্ত, তখন সূর্য পশ্চিমে গড়িয়েছে। নাওয়া নেই খাওয়া নেই ক্লান্ত অবসন্ন শরীর। সে খেয়াল নেই কৃষ্ণকান্তের। থানা থেকে বেরিয়ে প্রায় দৌড়ে একটা ট্যাক্সি ধরে। ঘড়িতে তখন বিকেল প্রায় সাড়ে চারটে। ট্যাক্সিওয়ালাকে কৃষ্ণকান্ত বলে "ভাই, একটু জলদি চল।"

"কোথায়?" ট্যাক্সিওয়ালার প্রশ্নের উত্তরে কৃষ্ণকান্ত বলে "সল্টলেক বি এস এন এল অফিস। পাঁচটার মধ্যে না পৌঁছতে পারলে অফিস বন্ধ হয়ে যাবে।"

ট্যাক্সিওয়ালা দ্রুতগতিতে সল্টলেকে ঢোকে। মাঝে কৃষ্ণকান্ত তাকে গাইড করে। বি এস এন এল অফিসের সামনে ট্যাক্সি যখন থামল, তখন পাঁচটা বাজতে দশ মিনিট বাকি। দ্রুত হাতে ট্যাক্সিওয়ালাকে পেমেন্ট করে প্রায় দৌড়ে বি এস এন এল অফিসের মোবাইল সেকশনের দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে। অফিস মোটামুটি খালি। দুজন এখনো বসে আছেন। তাদের একজনকে কৃষ্ণকান্ত সংক্ষেপে ঘটনাটি বলে। তা শুনে সেই কর্মচারী বলেন "দাঁড়ান। আগে সিমটা ব্লক করি। আপনার জি ডির কপি দেখান।" কৃষ্ণকান্ত জি ডির কপি দেখায়। বি এস এন এল কর্মচারী সেটা নিয়ে কম্পিউটারে বসে যান। সিম ব্লক করেন। তারপর বলেন "কাল এই জি ডির কপি আধার কার্ড নিয়ে আসবেন। নতুন সিম পেয়ে যাবেন।

কৃষ্ণকান্ত নমস্কার জানিয়ে বি এস এন এল অফিস থেকে বেরিয়ে আসে। ঘড়িতে তখন পাঁচটা পনের। একটা ট্যাক্সি ধরে সল্টলেকের ফ্ল্যাটে পৌঁছয়। সারাদিনের টেনশন, এদিক ওদিক ঘোরাঘুরির পরিশ্রমে বিধ্বস্ত কৃষ্ণকান্ত লিফটে উঠে ফ্ল্যাটে পৌঁছয়। কলিংবেল বাজায়। স্ত্রী মনোবীনা মেয়ে কল্পা প্রায় দৌড়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়ায়। অবসন্ন কৃষ্ণকান্ত ভেতরে ঢোকে। মা মেয়ে কৃষ্ণকান্তকে এই অবস্থায় দেখে অবাক হয়। প্রায় সমস্বরে বলে ওঠে "কোথায় ছিলে? সারাদিন ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। চিন্তায় চিন্তায় আমরা শেষ হয়ে যাচ্ছি। একটা কল তো করতে পার?" " কি করে কল কোরবো? মোবাইলটাই চুরি হয়ে গেছে।" মনোবীনাকে বলে "খাবারগুলো একটু গরম কর। আমি এক্ষুণি স্নান করে আসছি। সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি।"

কৃষ্ণকান্ত কাঁধের ঝোলা নামিয়ে রাখে। গিজারের সুইচ অন করে। বাথরুমের শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে উষ্ণ জলের অনর্গল ধারায় শরীরের ক্লেদ, ক্লান্তি ধুয়ে মুছে যায়, নির্মল হয়। অশান্ত মন শান্ত হয়। ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার টেবিলে বসে। মনোবীনা টেবিলে খাবার দেয়। ক্ষুধার্ত কৃষ্ণকান্ত খেতে খেতে সারাদিনের করুণ কাহিনী শোনায়। মা মেয়ে নির্বাক আবিষ্টতায় শুনতে থাকে।

Comments